দারিদ্র্যমোচনে চাই নির্দিষ্ট নীতিমালা by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
গত ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে দারিদ্র্য থেকে দেশকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দুর্নীতি রুখতে না পারলে দারিদ্র্য দূর করা যাবে না।’ প্রশ্ন হচ্ছে—এই দুর্নীতি কিসের দুর্নীতি? অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে দুর্নীতি নাকি প্রশাসনিক দুর্নীতি? আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির প্রশ্নে উপরোক্ত দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলেননি।
তিনি বলেছেন, ‘যে দলেরই হোক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্নীতি করে কেউ রেহাই পাবে না।’ তার এই কথা থেকেই বোঝা যায়, দুর্নীতির প্রশ্নে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিই তিনি এনেছেন। এ প্রশ্নে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মহাজোট নেতা রাশেদ খান মেননের সাম্প্রতিক একটি উক্তি উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি বলেছেন, ‘মহাজোট সরকারের দিন বদলের স্লোগান আমরা বুঝতে পারিনি। এখন দিন বদলের অর্থ হচ্ছে ক্ষমতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখল ও টেন্ডারবাজির হাত বদল।’ (সূত্র : ‘আমার দেশ’ ২০ অক্টোবর, ২০০৯) রাশেদ খান মেনন এমপির এ উক্তি প্রমাণ করে মহাজোট সরকারই দুর্নীতিবাজ। তাই যদি হয় তবে মহাজোটের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের প্রশ্নে কী ব্যবস্থা নেবেন? দিন বদলের নামে তিনি যে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এই উপলব্ধি রাশেদ খান মেননের উক্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। দিন বদলের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা কি দুর্নীতির মধ্যে পড়ে না? অবশ্যই পড়ে। কেননা, নীতির বরখেলাপই হচ্ছে দুর্নীতি। সাধারণত আমরা তাকেই নীতিবান ব্যক্তি মনে করি, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। যার মাধ্যমে তা হয় না তাকে নীতিবান বলা যায় না, বলা যায় দুর্নীতিবাজ। এদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা কি ভুল হবে? দুর্নীতির জন্ম হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা থেকে। যে ক্ষমতার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই, জনগণ কর্তৃক যে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় না সেই ক্ষমতাই হচ্ছে দুর্নীতির উৎস। এদিক দিয়ে বলা যায়, এদেশে সংসদীয় শাসনের বিষয়টি ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির অধীন, রাজনীতির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণও তারই অধীন। এই ধরনের ক্ষমতাই হচ্ছে দুর্নীতির উত্স! এই উত্সমুখ বন্ব্দে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন? দুর্নীতি দমন করতে হলে এখান থেকেই শেখ হাসিনাকে যাত্রা শুরু করতে হবে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের পরিণতি দেখলে যে কেউ বলবেন, দুর্নীতি দমনের উৎসমুখ বন্ব্দ করতে শেখ হাসিনা মোটেই আগ্রহী নন। আবদুল জলিলের উত্থাপিত অভিযোগের মীমাংসা না করে তাকে ভারসাম্যহীন অর্থাত্ পাগল বলে তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে, এগুলোই হচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিচয়। জলিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আড়াল থেকে যিনি কলকাঠি নাড়ছেন তার মানসিক ভারসাম্য আছে এমনটি মনে হয় না। অথচ জলিল যা বলেছেন, সেই ধরনের অভিযোগ যদি আওয়ামী লীগের প্রতি না হয়ে বিএনপির প্রতি হতো তাহলে মনে হয় আবদুল জলিলের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট হতো না। আবদুল জলিল যদি বলতেন বিএনপির নেতৃত্ব গ্যাস রফতানির মুচলেকা দিয়েই ২০০১ সালে ক্ষমতায় বসেছিলেন এবং এই কারণে ক্ষমতায় বসেই গ্যাস রফতানির প্রশ্নে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন তারা—তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুশিই হতেন। জলিল তিরস্কৃত না হয়ে পুরস্কৃত হতেন। কিন্তু বিধি বাম, জলিল সাহেব নিজ দলের প্রতি অভিযোগ করে বসেছেন এই বলে যে ১/১১-এর ঘটনার নায়কদের সঙ্গে সমঝোতা করেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার প্রশ্নে নিজেদের পথ পরিষ্কার করেছে। আবদুল জলিলের অভিযোগের সত্যতা যে আছে সেটা শেখ হাসিনার কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজের বৈধতা তিনি দেবেন। এই কথা থেকেই প্রমাণ হয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃত রূপ। এই যখন অবস্থা তখন দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের দমন করা যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয় সেটাই প্রমাণ করে। যাহোক, এখন আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। আমাদের সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টির মূল কারণ কী? দুর্নীতি যে একটি কারণ নয় একথা আমি বলছি না, তবে মূল কারণ সেটি নয়। মূল কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতিসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। এদিক থেকে বাংলাদেশের কমিউনিসল্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দারিদ্র্যের জন্য প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামোকে দায়ী করে বলেছেন, ‘এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর তা করতে না পারলে দারিদ্র্যও দূর করা সম্ভব নয়।’ (সূত্র : ‘আমার দেশ’-১৮ অক্টোবর, ২০০৯) এই কথা বলে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সঠিক কথাটিই বলেছেন, কিন্তু কথা হচ্ছে নতুন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? এ বিষয়টি যতক্ষণ না আমরা পরিষ্কার করতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত এদেশে দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক মেরুকরণ সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামোকে বাতিল করে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রশ্নে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এদেশে অনেক দুর্বলতা বিদ্যমান। প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো দারিদ্র্য নিরসনের স্বার্থে কেন বাতিল করা অপরিহার্য এবং দারিদ্র নিরসনের স্বার্থে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো কেন জরুরি—এই দুটো বিষয় নিয়ে পরিষ্কার আলোচনা প্রয়োজন। এ প্রশ্নে স্বচ্ছ অবস্থান গ্রহণ করতে না পারলে দারিদ্র্য নিরসনের স্বার্থে জনগণের রাজনৈতিক মেরুকরণ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দোল খেতে থাকবে যেমনটি বর্তমানে হচ্ছে। দারিদ্র্য নিরসনের স্বার্থে একটা দেশের অর্থনীতিকে যেমন শক্তিশালী করা দরকার, সঙ্গে সঙ্গে উত্পাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমজীবী মানুষ তার জীবিকা নির্বাহের মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ যাতে পায় সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা দরকার। প্রথমত, একটা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে উত্পাদনের সঙ্গে জড়িত বা উত্পাদনে পুঁজি বিনিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে পুঁজির সঞ্চয় যাতে নিশ্চিত হয় সেজন্য সমাজে বিদ্যমান প্রতিবন্ব্দকতার অপসারণ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, উৎপাদনেরনিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের উত্পাদিত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করতে হবে; তৃতীয়ত, উত্পাদন ক্ষেত্রগুলো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে বা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে সব প্রতিষ্ঠানের উত্পাদিত পণ্যের বাজার অভ্যন্তরীণভাবে প্রধানত নিশ্চিত করা যায়; চতুর্থত, উত্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পদের প্রাপ্যতা এবং উত্পাদন ক্ষেত্রগুলোতে তার সরবরাহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব প্রতিবন্ব্দকতা অপসারণ করতে হবে; পঞ্চমত, উত্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা পরিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একটা দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো নেয়া সম্ভব হলে তিনটি কাজ সম্ভব হবে। (১) উত্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমশক্তি যে মূল্য সৃষ্টি করে সেই মূল্য থেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের সঞ্চয় এবং তা দেশীয় অর্থনীতিতে ধরে রাখা সম্ভব হবে; (২) উত্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমশক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ব্দকতা সৃষ্টি হবে না—অর্থাত্ শ্রমিক অসন্তোষ হবে না; (৩) দেশীয় অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত মূল্যের সঞ্চয়ের অর্থ জাতীয় পুঁজির পুঞ্জীভবনকে শক্তিশালী করা, যা বর্ধিত আকারে উত্পাদন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে নিশ্চিত করবে অর্থাত্ কর্মসংস্থানের অবারিত বিকাশকে নিশ্চিত করবে। কর্মসংস্থানের বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সমাজ থেকে বেকারত্ব দূর হবে, যা সমাজকে স্থিতিশীলতা দান করবে।
দারিদ্র্য নিরসনে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এসব নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হলেই সমাজ থেকে দারিদ্র্য নিরসন করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজনীয় এসব অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বা জনগণের রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হলে এদেশ থেকে দারিদ্র্য নিরসন খুব অল্প সময়েই সম্ভব। এসব অর্থনৈতিক নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া একমঞ্চে আবির্ভূত হলেই দারিদ্র্য নিরসনে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে প্রথিতযশা কিছু বুদ্ধিজীবী যখন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে দারিদ্র্য নিরসনের স্বপম্ন দেখান মানুষকে, তখন মনে হয় জনগণের সঙ্গে প্রতারণার এ এক নবকৌশল। প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থে প্রথিতযশা এসব বুদ্ধিজীবীর নবকৌশল যে দারিদ্র্য নিরসনে কোনো ভূমিকাই রাখবে না এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। দারিদ্র্য নিরসনের প্রশ্নে আন্তরিক হলে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয় নিয়ে এবং তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এদেশের বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয় হলে এ দেশবাসী অনেক উপকৃত হতো। এসব প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর কানে ঢুকবে না, কারণ এরা সমাজে সেই অবস্থান নিতে চায়—যে অবস্থান তাদের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিকে নিশ্চিত করে। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে এই অবস্থান সমাজে থাকবে না—এমনটা আশা করাও বোকামি বরং বুদ্ধিবৃত্তির এই সুবিধাবাদী অবস্থানকে পরাভূত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই আমাদের এগোতে হবে। দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতিমালার মৌলিক দিকগুলো নিয়ে এখন যা প্রয়োজন তা হলো প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালা কেন দারিদ্র্য নিরসন না করে দারিদ্র্য উৎপাদন করে চলেছে সেই বিষয়ে কিছু বলা। আমাদের দেশে অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিমালাকে এককথায় বলা যায়, বিজাতীয় স্বার্থের রক্ষাকারী। এই অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে এদেশে উৎপাদনে নিয়োজিত পুঁজির মালিকদের হাতে পুঁজির সঞ্চয় নিশ্চিত না হয়ে তা পুঞ্জীভূত হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে যার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয় বিভিন্নভাবে। আর এ কারণেই এদেশে কৃষি ও শিল্পের দুরবস্থা। দেশীয় শিল্পের বিকাশের প্রয়োজনে দেশীয় অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয় প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালায় নেই। প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে দেশে পুঁজির পুঞ্জীভবন নিশ্চিত না হওয়ার প্রেক্ষিতে এই দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাদের মুখে বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলতে মুখে ফেনা উঠে আসে কিন্তু তাদের বুলি বন্ব্দ হয় না। একই কারণে জাতীয় পুঁজির পুঞ্জীভবন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, যার কারণে দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বিকাশ থমকে গেছে বা প্রতি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই অবস্থা দেশে কর্মসংস্থানের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে বিধায় কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে বাজার খোঁজা আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান কাজ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কাজের প্রশ্নে আগ্রহী বাংলাদেশীয় প্রতি পদে পদে প্রতারিত হয়ে চলেছে এটা আমরা সংবাদপত্র মারফত জানতে পারি। সম্প্রতি এনার্জি সেভিং বাল্ব সংগ্রহের নীতিমালা দেশি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিক্ষুব্ধ করেছে। বাল্ব সংগ্রহের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রশ্নে এমন সব ক্লজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোণঠাসা করেছে। বাল্ব আমদানি হচ্ছে বিদেশ থেকে। এভাবে চললে দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সম্ভব নয়, সম্ভব নয় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে পুঁজির পুঞ্জীভবন নিশ্চিত করা। প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালার মৌলিক ত্রুটির দিক হচ্ছে দেশীয় সম্পদ ও দেশীয় অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর বিদেশি পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিদেশি পুঁজির সম্ফীতিকে বাড়িয়ে তোলা! অথচ দেশে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পুঁজির সম্ফীতির অনুকূলে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই শুধু নয়—ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বিদেশি স্বার্থের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিকতা আমরা রক্ষা করছি, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার অনুকূলে নয়। শাসকশ্রেণীর কোনো অংশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে বিদেশি প্রভুদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বিদ্রোহ করে যেমনটা করেছিল ১/১১-তে। এদিক থেকে দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব নীতিমালার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রযন্ত্র যাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর এ কাজের জন্য ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তে প্রয়োজন জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের। দারিদ্র্য নিরসনে আন্তরিক হলে এ প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা একান্ত জরুরি।
দারিদ্র্য নিরসনে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এসব নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হলেই সমাজ থেকে দারিদ্র্য নিরসন করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজনীয় এসব অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বা জনগণের রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হলে এদেশ থেকে দারিদ্র্য নিরসন খুব অল্প সময়েই সম্ভব। এসব অর্থনৈতিক নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া একমঞ্চে আবির্ভূত হলেই দারিদ্র্য নিরসনে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে প্রথিতযশা কিছু বুদ্ধিজীবী যখন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে দারিদ্র্য নিরসনের স্বপম্ন দেখান মানুষকে, তখন মনে হয় জনগণের সঙ্গে প্রতারণার এ এক নবকৌশল। প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থে প্রথিতযশা এসব বুদ্ধিজীবীর নবকৌশল যে দারিদ্র্য নিরসনে কোনো ভূমিকাই রাখবে না এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। দারিদ্র্য নিরসনের প্রশ্নে আন্তরিক হলে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয় নিয়ে এবং তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এদেশের বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয় হলে এ দেশবাসী অনেক উপকৃত হতো। এসব প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর কানে ঢুকবে না, কারণ এরা সমাজে সেই অবস্থান নিতে চায়—যে অবস্থান তাদের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিকে নিশ্চিত করে। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে এই অবস্থান সমাজে থাকবে না—এমনটা আশা করাও বোকামি বরং বুদ্ধিবৃত্তির এই সুবিধাবাদী অবস্থানকে পরাভূত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই আমাদের এগোতে হবে। দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতিমালার মৌলিক দিকগুলো নিয়ে এখন যা প্রয়োজন তা হলো প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালা কেন দারিদ্র্য নিরসন না করে দারিদ্র্য উৎপাদন করে চলেছে সেই বিষয়ে কিছু বলা। আমাদের দেশে অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিমালাকে এককথায় বলা যায়, বিজাতীয় স্বার্থের রক্ষাকারী। এই অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে এদেশে উৎপাদনে নিয়োজিত পুঁজির মালিকদের হাতে পুঁজির সঞ্চয় নিশ্চিত না হয়ে তা পুঞ্জীভূত হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে যার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয় বিভিন্নভাবে। আর এ কারণেই এদেশে কৃষি ও শিল্পের দুরবস্থা। দেশীয় শিল্পের বিকাশের প্রয়োজনে দেশীয় অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয় প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালায় নেই। প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে দেশে পুঁজির পুঞ্জীভবন নিশ্চিত না হওয়ার প্রেক্ষিতে এই দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাদের মুখে বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলতে মুখে ফেনা উঠে আসে কিন্তু তাদের বুলি বন্ব্দ হয় না। একই কারণে জাতীয় পুঁজির পুঞ্জীভবন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, যার কারণে দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বিকাশ থমকে গেছে বা প্রতি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই অবস্থা দেশে কর্মসংস্থানের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে বিধায় কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে বাজার খোঁজা আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান কাজ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কাজের প্রশ্নে আগ্রহী বাংলাদেশীয় প্রতি পদে পদে প্রতারিত হয়ে চলেছে এটা আমরা সংবাদপত্র মারফত জানতে পারি। সম্প্রতি এনার্জি সেভিং বাল্ব সংগ্রহের নীতিমালা দেশি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিক্ষুব্ধ করেছে। বাল্ব সংগ্রহের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রশ্নে এমন সব ক্লজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোণঠাসা করেছে। বাল্ব আমদানি হচ্ছে বিদেশ থেকে। এভাবে চললে দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সম্ভব নয়, সম্ভব নয় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে পুঁজির পুঞ্জীভবন নিশ্চিত করা। প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিমালার মৌলিক ত্রুটির দিক হচ্ছে দেশীয় সম্পদ ও দেশীয় অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর বিদেশি পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিদেশি পুঁজির সম্ফীতিকে বাড়িয়ে তোলা! অথচ দেশে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পুঁজির সম্ফীতির অনুকূলে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই শুধু নয়—ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বিদেশি স্বার্থের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিকতা আমরা রক্ষা করছি, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার অনুকূলে নয়। শাসকশ্রেণীর কোনো অংশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে বিদেশি প্রভুদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বিদ্রোহ করে যেমনটা করেছিল ১/১১-তে। এদিক থেকে দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব নীতিমালার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রযন্ত্র যাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর এ কাজের জন্য ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তে প্রয়োজন জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের। দারিদ্র্য নিরসনে আন্তরিক হলে এ প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা একান্ত জরুরি।
No comments