আদ্দু ঘোষণা-এখনও অনেক পথ বাকি
প্রতিবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজে বাড়তি একটা আশাবাদ তৈরি হয়। অনেকেই ভাবতে বসেন, এবার নিশ্চয়ই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নেতারা অর্থপূর্ণ একটা উদ্যোগ নেবেন। সত্যি বলতে, আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ, নেপাল থেকে মালদ্বীপ পর্যন্ত মানুষের মনে একটি ঐক্যবদ্ধ ও সফল দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন বহুদিন ধরেই গুঞ্জরিত হচ্ছে। শুধু বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রই নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ সহযোগিতার একটি বিরাট ক্ষেত্র ইতিমধ্যে সার্ক দেশগুলোতে তৈরি হয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতোই শীর্ষ সম্মেলন মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না।
যে সার্ক সেই সার্কই থেকে গেল সপ্তদশ শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত। মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের আগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নানামুখী প্রত্যাশা পল্লবিত হয়ে উঠছিল। আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সহযোগিতার জন্য সাফটা বাস্তবায়নে এবার একটা কার্যকর উদ্যোগ আসুক, এ প্রত্যাশাও ছিল। আদতে সাফটার আলোচনা বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতিতেই পর্যবসিত হয়েছে এবারও। জলবায়ু পরিবর্তন এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ তো বটেই, অন্য দেশগুলোও গুরুতর হুমকির মধ্যে আছে। কিন্তু জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় অভিন্ন অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত এ ইস্যুতে আঞ্চলিক সহযোগিতার নজির মিলল না। এবারে গালভরা প্রতিপাদ্য ছিল সেতুবদ্ধ রচনার ব্যাপারে। কিন্তু সেতুবন্ধ বলতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষের মধ্যে যে অবাধ যোগাযোগ ও যাতায়াত বোঝায় তা ঘটতে পারল না। অবাধ যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার উদ্যোগও আপাতত নেই। ফলে প্রতিপাদ্য ঠিক প্রতিপাদিত হলো না। শীর্ষ নেতৃত্ব যেসব বিষয়ে একমত হয়েছেন সেগুলোর দৌড় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাগিদ ও প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত। এমন মনোভাব নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বৃহত্তর ও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক জোট গঠনের চিন্তা অলীক কল্পনা বলেও মনে হতে পারে। তবে কিছু অপ্রধান বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ আসবে বলে মনে হচ্ছে। সামান্য হলেও সেটুকুই অর্জন। প্রশ্ন হলো, সার্কের বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও কেন এখানকার নেতারা সার্ককে প্রত্যাশিত দিকে পরিচালিত করতে পারছেন না। কেউ কেউ মনে করেন, এর উত্তর হয়তো রাজনীতির মধ্যে নিহিত। দায়িত্বশীল ও সহযোগিতামূলক রাজনীতির অনুপস্থিতি সার্ক দেশগুলোর মধ্যে প্রধান সংকট তৈরি করেছে। পারস্পরিক অবিশ্বাসের নানা প্রসঙ্গও আছে। সংকীর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ এ অঞ্চলের বৃহত্তর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারপরও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে পণ্য চলাচলে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণের জন্য যে নির্দেশনা এসেছে সেটুকু ইতিবাচক। দ্বিপক্ষীয়ভাবে কিছু বাধা ইতিমধ্যে অপসৃত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সত্যি কথা বলতে, বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সাফল্যের দেখা ততোটা না মিললেও দ্বিপক্ষীয় কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে আন্তরিক ও সহযোগিতামূলক আলোচনা হয়েছে তাতে উপমহাদেশে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। সার্কের জন্যও এটি ভালো খবর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনাতেও দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো উত্থাপিত হয়েছে। তিস্তা চুক্তি বিষয়ে আলাপ হয়েছে। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুসারে অতিদ্রুত তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হোক। দ্বিপক্ষীয় নানা আলোচনার সুযোগ সার্ক তৈরি করে দিয়েছে, এটি যেমন সত্য তেমনি এ-ও সত্য যে, বহুপক্ষীয় ও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বলার মতো কোনো অর্জন এবারের সম্মেলনে নেই। কিন্তু সেখানে পেঁৗছাতে হবে। এজন্য দেশগুলোর নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু নেতাদের প্রণোদনার জন্য নাগরিক উদ্যোগের ব্যাপকতা দরকার। সার্ককে কার্যকর করতে এর বিকল্প নেই।
No comments