আওয়ামী লীগ : নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জ-১ -ধরমপাশা-এমপি 'খাইমু লীগ' প্রতিষ্ঠা করেছেন! by শামস শামীম,
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন দলকে সংগঠিত করার পক্ষে নন। নিজের আখের গোছাতে মরিয়া হয়ে অবৈধভাবে বিভিন্ন সুবিধা নিতে ব্যস্ত তিনি। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের দূরে রেখে বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে এই আসনের অন্তর্ভুক্ত জলমহাল, পাথরমহাল, বালুমহাল এবং শুল্কস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সুবিধা নিচ্ছেন। শুধু বিএনপির সঙ্গেই নয়, নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরের লোকজনকেও তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার করেছেন।
নিজ এলাকা এবং দলীয় লোকদের তিনি ভয় পান! তাঁর দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র প্রকাশিত হওয়ার ভয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরের একাধিক লোককে পিএস-এপিএস করেছেন! বিভিন্ন মহালে দলীয় লোক নয়, বিএনপি এবং নির্বাচনী এলাকার বাইরের লোকজনই অবৈধভাবে চাঁদাবাজি করছে। উপরোলি্লখিত অভিযোগগুলো সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। তবে এমপি এসব অভিযোগকে মিথ্যা এবং তাঁর উন্নয়নে অন্তরায় একটি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর নির্বাচনী এলাকা তাহিরপুরের মিয়ারচর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগকর্মী আবদুস সাত্তার আজাদ জানান, দলকে সংগঠিত করা এবং এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে এমপি সাহেবের কোনো মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী লীগ নয়, তিনি বিএনপি এবং তাঁর নির্বাচনী এলাকার বাইরের লোকদের দিয়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনে 'খাইমু লীগ' প্রতিষ্ঠা করেছেন। জলমহাল, বালুমহাল, পাথরমহাল এবং এই এলাকার তিনটি শুল্কস্টেশন তাঁর দখলে। এসব স্থানে তাঁর নামে মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। তাঁর কাছে দলীয় নেতা-কর্মীদের কোনো মূল্যায়ন নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি জানের দুশমন মনে করেন। তাই বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি করে চলেছেন।
ধরমপাশা উপজেলার বিএনপি নেতা মোতালেব খান জানান, নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি এই এলাকায় সেবক হতে এসেছেন; কখনোই ব্যবসায়ী হবেন না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে তিনি এখন অবৈধভাব বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করছেন। এলাকার সম্ভাবনাময় বালুমহাল, পাথরমহাল, জলমহাল এবং কয়লা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বৈধ ব্যবসায়ীদের তিনি ব্যবসা থেকে উৎখাত করে নিজের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, গত বছর ৩ মার্চ সুনামগঞ্জ বিডি হলে অনুষ্ঠিত হট্টগোলে পণ্ড হওয়া দলের বর্ধিত সভায় ফরম পূরণ করে তিনি দলীয় সদস্য হন। এর আগে তিনি কোন দল করতেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকার কেউ জানে না। তাঁর নিজ এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বাঙালি জাতির শোকের মাস আগস্টেও তিনি তোরণ দিয়ে বিশাল সংবর্ধনা নিয়েছেন গত বছর! জামালগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ আয়োজিত গত বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এবং রক্তদান কর্মসূচিও পণ্ড করে দেন তিনি। ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল পুরনো আওয়ামী লীগার হিসেবে খ্যাত মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল তালুকদারের অফিসকক্ষ ভাঙচুর করে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা। গত রমজানে জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এমদাদুল হকের বাড়িতেও তারা হামলা চালায় বলে এমদাদ এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন। এভাবে দলীয় লোকজনই তাঁর নির্যাতনের শিকার বলে জানিয়েছেন এমদাদ। তাঁর বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ দলীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাহিরপুর উপজেলা কমান্ডার মোজাহিদ উদ্দিন চলতি বছর ১৩ জুন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার, ফাজিলপুর বালুমহাল ও পাথরমহালে অবৈধ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান এবং স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেনসহ দলীয় অনেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, এমপির নিজ উপজেলা ধরমপাশার সব জলমহালে পার্টনার তিনি। তাঁর ক্ষমতাবলে জোর করে দখল নেওয়া হয়েছে এসব মহালের। গত মাসে তাঁর জলমহাল ব্যবসার পার্টনার আবদুল লতিফ নাজেল ধরমপাশার নাইন্দাবান্দা বিলে একজন মৎস্যজীবীকে পানিতে চুবিয়ে খুন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মামলা হলেও খুনিরা প্রকাশ্যে এমপির সঙ্গে ঘুরছে বলে অভিযোগ করেছে ওই মৎস্যজীবীর পরিবার। তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করেন। তাঁর নিজ উপজেলায়ও আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি নেই। তৃণমূল নেতারা তাঁর থেকে দূরে। এই উপজেলায় তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মণীন্দ্র চন্দ এবং আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর কবীর ও শামীম আহমদ বিলকিসকে দিয়ে মাঝেমধ্যে দলীয় কর্মসূচি পালন করান। তবে এসব নেতা দলকে সংগঠিত করার বদলে নিজেরাই এখন বিভিন্নভাবে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার মিছিলে নেমেছেন।
ধরমপাশা উপজেলা এমপির নিজ এলাকা। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি এলাকায় উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী হয়ে মানুষের দোয়া চান। একজন প্রবাসী নেতাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দলের মনোনয়ন পান বলে নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে সেই সময় অভিযোগ করেন। তাঁর মনোনয়নের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির কার্যালয়ের সামনে নির্বাচনী এলাকার নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ করেন। এর পরও গণজোয়ারে তিনি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে কেউ তাঁকে কখনো দেখেনি। তবে নির্বাচনের পর দলীয় দিবসগুলোতে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও দলকে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত করার কোনো উদ্যোগ নেননি।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য হওয়ার পরেই মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের প্রতি রুষ্ট হয়ে ওঠেন। জনসেবার কথা বলে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিলেও তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার জলমহাল-বালুমহাল-পাথরমহালগুলো একে একে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। তাঁর বড় ভাই মাসুদ মিয়া 'ভাই বাহিনী' গঠন করে ধরমপাশার শানবাড়ি বাজারঘাটে ধান-চাল, কয়লা ও বালু-পাথরের নৌকা থেকে চাঁদা নিচ্ছেন। তাহিরপুরে বিএনপি নেতা অলিউর রহমান বাক্কি, বোরহান উদ্দিন এবং ইউপি চেয়ারম্যান নিজামসহ একটি সিন্ডিকেটকে দিয়ে তাহিরপুরে বালুমহাল-পাথরমহাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছেন বলে নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন। একইভাবে বিএনপি নেতা আলকাছ খন্দকারকে নিয়ে তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক সমিতিও দখলে নেন।
তাঁর নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলা তাহিরপুর, জামালগঞ্জ এবং ধরমপাশায় নিজ স্বার্থেই দলীয় কোন্দল জিইয়ে রেখেছেন বলে তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ। ফলে এই তিনটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। সংসদ সদস্য হওয়ার পরও দলকে সংগঠিত করার কাজে সময় না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল ও ত্যাগী নেতারা তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন জানান, উপজেলা কমিটিগুলোর বয়স ১৬ বছর হয়ে গেছে। নতুন কমিটি গঠন এবং নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে না আসায় নেতা-কর্মীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাই দলকে সংগঠিত করার জন্য কমিটি গঠন জরুরি। ঈদের পর দল গোছানোর কাজে হাত দেওয়া হবে।
যারা তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ এনেছে, তাদের তিনি তাঁর উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, 'যারা আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-দখলবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে, তারা নিজেরাও জানে, আমি সৎ। কিন্তু বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে হবে_এই নীতিতে তারা সমালোচনা করে আমাকে উন্নয়ন থেকে দূরে রাখতে চায়।'
দলের ভেতর তার একটি সমালোচক ও অনিষ্টকারী গোষ্ঠী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এরা আওয়ামী লীগের নয়, বিএনপি থেকে এসে আওয়ামী লীগার দাবি করে দল এবং আমার সমালোচনা করছে।'
তিনি আরো বলেন, 'বিএনপির কারো সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই।'
জামালগঞ্জ
প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের অন্যতম সহযোগী রেজাউল করীম শামীম। তাঁর নির্দেশেই দলের গঠনতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিচালিত হয় জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। নিজে তো দলকে শক্তিশালী ও সংগঠিত করতে কোনো উদ্যোগ নেনই না, বরং যারা কাজ করতে চায়, সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে যখন-তখন তাদের বহিষ্কারও করেন তিনি। তাঁর মদদ পেয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা হেন কাজ নেই, যা করে না। তাঁর আশকারায় ছাত্রলীগ নেতারা ভুয়া প্রকল্পের ডিও লেটার না দেওয়ায় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে পিটিয়েছে। সাংবাদিককে মারধর করে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। খেয়াঘাট দখল নিয়ে এসি (ল্যান্ড) ও তহসিলদারকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।
নিজ দলীয় মহিলা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আসামি ধরতে গিয়ে তাঁর লোকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন বিশ্বম্ভরপুর থানার এসআই। তাঁর প্রশ্রয়ে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জামালগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দাবিদার নেতা-কর্মীরা। আর তাঁর এসব কাজের সব বৈধতা দিচ্ছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফোরামে ওই অভিযোগগুলো করেছেন আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা শাহরিয়ার।
জামালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ত্রাতা দাবিদার সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করীম সম্পর্কে কমবেশি এ রকমই জানেন জামালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারা। তিনি তাঁর দাপটবলে উপজেলা কমিটি ভেঙে দুই বছর আগে নিজ অনুগতদের দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। তবে গত দুই মাস আগে তাঁর গঠিত কমিটিকে কেন্দ্র এবং সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ 'অবৈধ' ঘোষণা করে আগের কমিটি দিয়েই কাজ চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তিনি সেই নির্দেশও মানছেন না। তাঁর একক সিদ্ধান্তের কারণে এখন দলে চেইন অব কমান্ড নেই। ফলে জাতীয় এবং স্থানীয় দিবসে নামকা ওয়াস্তে কার্যক্রম হাতে নেওয়া ছাড়া দলের আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। উপজেলা কমিটি তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো দলীয় কর্মসূচি হাতে নিতে পারছে না।
জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, 'রেজাউল করিম শামীমের কারণে আমি বৈধ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে পারি না। তিনি নিজেও কোনো কাজ করেন না, আমাদেরও কাজ করতে বাধা দেন।' তিনি আরো বলেন, 'সভাপতি করম আলী তালুকদার মারা যাওয়ার পর আমি সিনিয়র হিসেবে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হই। কিন্তু তিনি আমাকে মেনে না নিয়ে নবী হোসেনকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করেন। আমি তাঁর এই স্বৈরতন্ত্র চ্যালেঞ্জ করে কেন্দ্র এবং জেলা আওয়ামী লীগের শরণাপন্ন হওয়ার পর কেন্দ্র এবং জেলা থেকে আমাকে সভাপতি করার নির্দেশনা দিয়ে তাঁর কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।' একই কথা জানালেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিগেন্দ্র লাল রায়। তাঁরা কেউই শামীমের জন্য দলীয় কাজ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।
রেজাউল করীম শামীম বলেন, 'আমি উপজেলার টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। দলকে সংগঠিত ও তৃণমূলমুখী করতে আমি অনেক কষ্ট করেছি। আমার বাবাও ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। আমার পরিবার পুরনো আওয়ামী লীগার বলেই তৃণমূলে আমার পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাই সব নেতা-কর্মী আমার নির্দেশনায় কাজ করতে পছন্দ করেন। যারা হিংসা করে, তারাই আমার এবং আমার কর্মীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।' তবে আগের চেয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম এখন কম_এ বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, দল ক্ষমতায় থাকলে দলীয় কার্যক্রম কমে যায়। তখন সবকিছু দলের বদলে এমপিকেন্দ্রিক হয়ে যায়। তাই এখন তুলনামূলক কম কর্মসূচি নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে প্রয়াত করম আলী তালুকদারকে সভাপতি এবং রেজাউল করিম শামীমকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। একই বছর জেলা কমিটিতে রেজাউল করিম শামীম সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁর বদলে নবী হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাহিরপুর
দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল এবং নতুন নেতৃত্ব না থাকায় তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রমও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে দলীয় কার্যক্রম চোখে পড়ে না। স্থানীয় সংসদ সদস্যও এ ব্যাপারে উদাসীন। অভিভাবক এবং দলীয় দিকনির্দেশনার অভাবে তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
১৯৯৭ সালে আবদুস সোবহান আখঞ্জিকে সভাপতি এবং আবুল হোসেন খানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠিত হয়। সুনামগঞ্জ কয়লা আমদানিকারক সমিতির কমিটি গঠন এবং সমিতির কাছ থেকে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় দুই বছর আগে তাহিরপুর উপজেলা কমিটি ভেঙে আবুল হোসেন খানকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পরই দলীয় কোন্দলের জের ধরে তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়। ফলে কেন্দ্র এই কমিটি স্থগিত করে আগের কমিটি দিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়। তবে মামলাটি পরে খারিজের জন্য বাদী নিজেই আবেদন করেন। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আগে ছিটেফোঁটা হলেও দলীয় কার্যক্রম চলত। কিন্তু এখন একেবারেই কোনো কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দুজনই দলে স্থবিরতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন খান বলেন, 'এই এলাকার অন্যতম প্রবীণ নেতা আমি। কিন্তু দলের ভেতরের একটি দুষ্টচক্র আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে মামলা করেছে। পরে বাদী নিজেই তা খারিজের জন্য আবেদন করে। অথচ আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে জেলও খেটেছি।' দলের কার্যক্রম স্থবির হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, এমপি সাহেব জোর দিয়ে দল গঠনের নির্দেশ দিলে সবাই কাজের গতি ফিরে পাবে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সোবহান আখঞ্জি বলেন, 'দলের ওপর যুদ্ধাপরাধীর তকমা লাগলে কর্মস্পৃহা থাকে না। জেলা কমিটি অবৈধভাবে যে আহ্বায়ক কমিটি করেছিল, তাতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রধান করা হয়েছিল। এ নিয়ে আওয়ামী লীগপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে কেন্দ্র থেকে এই কমিটি বাতিল করে আমাকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
দল সংগঠিত করতে এমপির কোনো ভূমিকা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'এমপি সাহেব নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। দল এবং নেতা-কর্মীদের দেওয়ার মতো সময় তাঁর হাতে নেই।'
তাঁর নির্বাচনী এলাকা তাহিরপুরের মিয়ারচর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগকর্মী আবদুস সাত্তার আজাদ জানান, দলকে সংগঠিত করা এবং এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে এমপি সাহেবের কোনো মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী লীগ নয়, তিনি বিএনপি এবং তাঁর নির্বাচনী এলাকার বাইরের লোকদের দিয়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনে 'খাইমু লীগ' প্রতিষ্ঠা করেছেন। জলমহাল, বালুমহাল, পাথরমহাল এবং এই এলাকার তিনটি শুল্কস্টেশন তাঁর দখলে। এসব স্থানে তাঁর নামে মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। তাঁর কাছে দলীয় নেতা-কর্মীদের কোনো মূল্যায়ন নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি জানের দুশমন মনে করেন। তাই বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি করে চলেছেন।
ধরমপাশা উপজেলার বিএনপি নেতা মোতালেব খান জানান, নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি এই এলাকায় সেবক হতে এসেছেন; কখনোই ব্যবসায়ী হবেন না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে তিনি এখন অবৈধভাব বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করছেন। এলাকার সম্ভাবনাময় বালুমহাল, পাথরমহাল, জলমহাল এবং কয়লা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বৈধ ব্যবসায়ীদের তিনি ব্যবসা থেকে উৎখাত করে নিজের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, গত বছর ৩ মার্চ সুনামগঞ্জ বিডি হলে অনুষ্ঠিত হট্টগোলে পণ্ড হওয়া দলের বর্ধিত সভায় ফরম পূরণ করে তিনি দলীয় সদস্য হন। এর আগে তিনি কোন দল করতেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকার কেউ জানে না। তাঁর নিজ এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বাঙালি জাতির শোকের মাস আগস্টেও তিনি তোরণ দিয়ে বিশাল সংবর্ধনা নিয়েছেন গত বছর! জামালগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ আয়োজিত গত বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এবং রক্তদান কর্মসূচিও পণ্ড করে দেন তিনি। ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল পুরনো আওয়ামী লীগার হিসেবে খ্যাত মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল তালুকদারের অফিসকক্ষ ভাঙচুর করে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা। গত রমজানে জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এমদাদুল হকের বাড়িতেও তারা হামলা চালায় বলে এমদাদ এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন। এভাবে দলীয় লোকজনই তাঁর নির্যাতনের শিকার বলে জানিয়েছেন এমদাদ। তাঁর বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ দলীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাহিরপুর উপজেলা কমান্ডার মোজাহিদ উদ্দিন চলতি বছর ১৩ জুন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার, ফাজিলপুর বালুমহাল ও পাথরমহালে অবৈধ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান এবং স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেনসহ দলীয় অনেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, এমপির নিজ উপজেলা ধরমপাশার সব জলমহালে পার্টনার তিনি। তাঁর ক্ষমতাবলে জোর করে দখল নেওয়া হয়েছে এসব মহালের। গত মাসে তাঁর জলমহাল ব্যবসার পার্টনার আবদুল লতিফ নাজেল ধরমপাশার নাইন্দাবান্দা বিলে একজন মৎস্যজীবীকে পানিতে চুবিয়ে খুন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মামলা হলেও খুনিরা প্রকাশ্যে এমপির সঙ্গে ঘুরছে বলে অভিযোগ করেছে ওই মৎস্যজীবীর পরিবার। তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করেন। তাঁর নিজ উপজেলায়ও আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি নেই। তৃণমূল নেতারা তাঁর থেকে দূরে। এই উপজেলায় তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মণীন্দ্র চন্দ এবং আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর কবীর ও শামীম আহমদ বিলকিসকে দিয়ে মাঝেমধ্যে দলীয় কর্মসূচি পালন করান। তবে এসব নেতা দলকে সংগঠিত করার বদলে নিজেরাই এখন বিভিন্নভাবে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার মিছিলে নেমেছেন।
ধরমপাশা উপজেলা এমপির নিজ এলাকা। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি এলাকায় উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী হয়ে মানুষের দোয়া চান। একজন প্রবাসী নেতাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দলের মনোনয়ন পান বলে নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে সেই সময় অভিযোগ করেন। তাঁর মনোনয়নের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির কার্যালয়ের সামনে নির্বাচনী এলাকার নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ করেন। এর পরও গণজোয়ারে তিনি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে কেউ তাঁকে কখনো দেখেনি। তবে নির্বাচনের পর দলীয় দিবসগুলোতে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও দলকে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত করার কোনো উদ্যোগ নেননি।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য হওয়ার পরেই মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের প্রতি রুষ্ট হয়ে ওঠেন। জনসেবার কথা বলে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিলেও তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার জলমহাল-বালুমহাল-পাথরমহালগুলো একে একে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। তাঁর বড় ভাই মাসুদ মিয়া 'ভাই বাহিনী' গঠন করে ধরমপাশার শানবাড়ি বাজারঘাটে ধান-চাল, কয়লা ও বালু-পাথরের নৌকা থেকে চাঁদা নিচ্ছেন। তাহিরপুরে বিএনপি নেতা অলিউর রহমান বাক্কি, বোরহান উদ্দিন এবং ইউপি চেয়ারম্যান নিজামসহ একটি সিন্ডিকেটকে দিয়ে তাহিরপুরে বালুমহাল-পাথরমহাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছেন বলে নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন। একইভাবে বিএনপি নেতা আলকাছ খন্দকারকে নিয়ে তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক সমিতিও দখলে নেন।
তাঁর নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলা তাহিরপুর, জামালগঞ্জ এবং ধরমপাশায় নিজ স্বার্থেই দলীয় কোন্দল জিইয়ে রেখেছেন বলে তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ। ফলে এই তিনটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। সংসদ সদস্য হওয়ার পরও দলকে সংগঠিত করার কাজে সময় না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল ও ত্যাগী নেতারা তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন জানান, উপজেলা কমিটিগুলোর বয়স ১৬ বছর হয়ে গেছে। নতুন কমিটি গঠন এবং নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে না আসায় নেতা-কর্মীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাই দলকে সংগঠিত করার জন্য কমিটি গঠন জরুরি। ঈদের পর দল গোছানোর কাজে হাত দেওয়া হবে।
যারা তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ এনেছে, তাদের তিনি তাঁর উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, 'যারা আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-দখলবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে, তারা নিজেরাও জানে, আমি সৎ। কিন্তু বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে হবে_এই নীতিতে তারা সমালোচনা করে আমাকে উন্নয়ন থেকে দূরে রাখতে চায়।'
দলের ভেতর তার একটি সমালোচক ও অনিষ্টকারী গোষ্ঠী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এরা আওয়ামী লীগের নয়, বিএনপি থেকে এসে আওয়ামী লীগার দাবি করে দল এবং আমার সমালোচনা করছে।'
তিনি আরো বলেন, 'বিএনপির কারো সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই।'
জামালগঞ্জ
প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের অন্যতম সহযোগী রেজাউল করীম শামীম। তাঁর নির্দেশেই দলের গঠনতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিচালিত হয় জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। নিজে তো দলকে শক্তিশালী ও সংগঠিত করতে কোনো উদ্যোগ নেনই না, বরং যারা কাজ করতে চায়, সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে যখন-তখন তাদের বহিষ্কারও করেন তিনি। তাঁর মদদ পেয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা হেন কাজ নেই, যা করে না। তাঁর আশকারায় ছাত্রলীগ নেতারা ভুয়া প্রকল্পের ডিও লেটার না দেওয়ায় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে পিটিয়েছে। সাংবাদিককে মারধর করে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। খেয়াঘাট দখল নিয়ে এসি (ল্যান্ড) ও তহসিলদারকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।
নিজ দলীয় মহিলা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আসামি ধরতে গিয়ে তাঁর লোকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন বিশ্বম্ভরপুর থানার এসআই। তাঁর প্রশ্রয়ে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জামালগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দাবিদার নেতা-কর্মীরা। আর তাঁর এসব কাজের সব বৈধতা দিচ্ছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফোরামে ওই অভিযোগগুলো করেছেন আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা শাহরিয়ার।
জামালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ত্রাতা দাবিদার সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করীম সম্পর্কে কমবেশি এ রকমই জানেন জামালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারা। তিনি তাঁর দাপটবলে উপজেলা কমিটি ভেঙে দুই বছর আগে নিজ অনুগতদের দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। তবে গত দুই মাস আগে তাঁর গঠিত কমিটিকে কেন্দ্র এবং সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ 'অবৈধ' ঘোষণা করে আগের কমিটি দিয়েই কাজ চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তিনি সেই নির্দেশও মানছেন না। তাঁর একক সিদ্ধান্তের কারণে এখন দলে চেইন অব কমান্ড নেই। ফলে জাতীয় এবং স্থানীয় দিবসে নামকা ওয়াস্তে কার্যক্রম হাতে নেওয়া ছাড়া দলের আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। উপজেলা কমিটি তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো দলীয় কর্মসূচি হাতে নিতে পারছে না।
জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, 'রেজাউল করিম শামীমের কারণে আমি বৈধ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে পারি না। তিনি নিজেও কোনো কাজ করেন না, আমাদেরও কাজ করতে বাধা দেন।' তিনি আরো বলেন, 'সভাপতি করম আলী তালুকদার মারা যাওয়ার পর আমি সিনিয়র হিসেবে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হই। কিন্তু তিনি আমাকে মেনে না নিয়ে নবী হোসেনকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করেন। আমি তাঁর এই স্বৈরতন্ত্র চ্যালেঞ্জ করে কেন্দ্র এবং জেলা আওয়ামী লীগের শরণাপন্ন হওয়ার পর কেন্দ্র এবং জেলা থেকে আমাকে সভাপতি করার নির্দেশনা দিয়ে তাঁর কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।' একই কথা জানালেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিগেন্দ্র লাল রায়। তাঁরা কেউই শামীমের জন্য দলীয় কাজ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।
রেজাউল করীম শামীম বলেন, 'আমি উপজেলার টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। দলকে সংগঠিত ও তৃণমূলমুখী করতে আমি অনেক কষ্ট করেছি। আমার বাবাও ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। আমার পরিবার পুরনো আওয়ামী লীগার বলেই তৃণমূলে আমার পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাই সব নেতা-কর্মী আমার নির্দেশনায় কাজ করতে পছন্দ করেন। যারা হিংসা করে, তারাই আমার এবং আমার কর্মীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।' তবে আগের চেয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম এখন কম_এ বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, দল ক্ষমতায় থাকলে দলীয় কার্যক্রম কমে যায়। তখন সবকিছু দলের বদলে এমপিকেন্দ্রিক হয়ে যায়। তাই এখন তুলনামূলক কম কর্মসূচি নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে প্রয়াত করম আলী তালুকদারকে সভাপতি এবং রেজাউল করিম শামীমকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। একই বছর জেলা কমিটিতে রেজাউল করিম শামীম সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁর বদলে নবী হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাহিরপুর
দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল এবং নতুন নেতৃত্ব না থাকায় তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রমও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে দলীয় কার্যক্রম চোখে পড়ে না। স্থানীয় সংসদ সদস্যও এ ব্যাপারে উদাসীন। অভিভাবক এবং দলীয় দিকনির্দেশনার অভাবে তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
১৯৯৭ সালে আবদুস সোবহান আখঞ্জিকে সভাপতি এবং আবুল হোসেন খানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠিত হয়। সুনামগঞ্জ কয়লা আমদানিকারক সমিতির কমিটি গঠন এবং সমিতির কাছ থেকে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় দুই বছর আগে তাহিরপুর উপজেলা কমিটি ভেঙে আবুল হোসেন খানকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পরই দলীয় কোন্দলের জের ধরে তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়। ফলে কেন্দ্র এই কমিটি স্থগিত করে আগের কমিটি দিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়। তবে মামলাটি পরে খারিজের জন্য বাদী নিজেই আবেদন করেন। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আগে ছিটেফোঁটা হলেও দলীয় কার্যক্রম চলত। কিন্তু এখন একেবারেই কোনো কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দুজনই দলে স্থবিরতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন খান বলেন, 'এই এলাকার অন্যতম প্রবীণ নেতা আমি। কিন্তু দলের ভেতরের একটি দুষ্টচক্র আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে মামলা করেছে। পরে বাদী নিজেই তা খারিজের জন্য আবেদন করে। অথচ আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে জেলও খেটেছি।' দলের কার্যক্রম স্থবির হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, এমপি সাহেব জোর দিয়ে দল গঠনের নির্দেশ দিলে সবাই কাজের গতি ফিরে পাবে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সোবহান আখঞ্জি বলেন, 'দলের ওপর যুদ্ধাপরাধীর তকমা লাগলে কর্মস্পৃহা থাকে না। জেলা কমিটি অবৈধভাবে যে আহ্বায়ক কমিটি করেছিল, তাতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রধান করা হয়েছিল। এ নিয়ে আওয়ামী লীগপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে কেন্দ্র থেকে এই কমিটি বাতিল করে আমাকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
দল সংগঠিত করতে এমপির কোনো ভূমিকা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'এমপি সাহেব নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। দল এবং নেতা-কর্মীদের দেওয়ার মতো সময় তাঁর হাতে নেই।'
No comments