পৌনে তিন বছরে সৌদি আরবে গেছেন মাত্র ৩০ হাজার বাংলাদেশি, আর ফিরেছেন ৫০ হাজারঃ পুরোনো শ্রমবাজার বন্ধ, নতুন খোঁজ মেলেনি by আশিস সৈকত ও শরিফুল হাসান
বাংলাদেশের
জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত
প্রতিবছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ লোক দেশটিতে গেছেন। কিন্তু গত পৌনে তিন বছরে
সেখানে গেছেন মাত্র ৩০ হাজার বাংলাদেশি; আর একই সময়ে ফিরেছেন ৫০ হাজার। এই
হিসাব প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনশক্তি রপ্তানি খাতে গত তিন দশকের মধ্যে এমন
বিপর্যয় আর হয়নি।
বাংলাদেশের
দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। দুই বছর ধরে দেশটিতে
জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ। একই অবস্থা কুয়েতেও। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই
দেশটিও এখন বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। অথচ আগে গড়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার
থেকে ৪০ হাজার বাংলাদেশি সেখানে যেতেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই তিন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সব ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দাবি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই তিনটি শ্রমবাজার ধরে রাখতে সরকারের চেষ্টার পরও কোনো সফলতা আসেনি।
শুধু সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও কুয়েতই নয়; লিবিয়ায়ও লোক পাঠানো বন্ধ। ইরাকে অনেক সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও বাস্তবতা উল্টো।
আর নতুন শ্রমবাজার খোঁজার চেষ্টায়ও সফলতা নেই। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকার পাঁচটি কমিটি করে। কমিটি নতুন বাজারের খোঁজে বিভিন্ন দেশ সফরও করে, কিন্তু নতুন কোনো শ্রমবাজার খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কেন্দ্র করেই টিকে আছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।
জনশক্তি রপ্তানির এমন চিত্র হতাশাজনক উল্লেখ করে এ খাতের ব্যবসায়ীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করে। বায়রার সভাপতি আবুল বাশার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ সদস্যরা নানা ধরনের প্রশ্ন করেন, জবাব দিতে পারি না।’
সম্প্রতি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে পাঠায়। কমিটি গত ১০ বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির পরিসংখ্যান, সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চায়। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ২১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সংসদীয় কমিটির কাছে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়া ছিল বাংলাদেশের মূল বাজার। কিন্তু এই বাজারগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি কেন কমে গেছে, তা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিটি এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে। এখন একটি সুপারিশমালা তৈরি করে মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হবে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমবাজারগুলো চালু করতে কূটনৈতিক কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। সংসদীয় কমিটি যদি নতুন কিছু করতে পারে, তাহলে আমরা স্বাগত জানাব।’
জনশক্তি রপ্তানির এমন দুরবস্থা কেন, জানতে চাইলে আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘এটি গড়ে উঠেছে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। কিন্তু এখন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের পাশ কাটিয়ে সরকার সবকিছু করার চেষ্টা করছে। এটি একটি বড় সমস্যা। আর মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক জায়গায় আমাদের ভাবমূর্তির সংকট আছে। এই সংকট কাটাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে আট লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন এবং ২০০৮ সালে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে যান চার লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। ২০১০ সালে এ সংখ্যা আরেক দফা কমে দাঁড়ায় তিন লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জনে। তবে এ বছর কিছুটা বাড়তির দিকে।
আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৌদি আরবে: সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে এক লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন কর্মী, ২০০৭ সালে দুই লাখ চার হাজার ১১২ এবং ২০০৬ সালে এক লাখ নয় হাজার ৫১৩ জন কর্মী সৌদি আরবে গেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালে মাত্র ১৪ হাজার এবং গত বছর মাত্র সাত হাজার কর্মী সেখানে গেছেন।
সৌদি আরব এখন লোক নিচ্ছে নেপাল ও ভারত থেকে। শুধু জনশক্তি রপ্তানি কমানো নয়, সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতিপত্রও (আকামা) বদল করতে দিচ্ছে না। তাই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে ছয় থেকে সাত লাখ কর্মীকে।
সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে বেশির ভাগ সরকারি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সৌদিকরণ কর্মসূচি এবং ভিসার ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা চালুর কারণে সেখানে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ কর্মী কর্মরত থাকায় বাংলাদেশ কোটার সমস্যায় পড়েছে। এর বাইরে দক্ষ জনশক্তির বিপরীতে অদক্ষ জনশক্তি পাঠানো এবং কারিগরি জ্ঞানহীন স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের পাঠানোর কারণেও সৌদি আরবের শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
মালয়েশিয়া: এ দেশে ২০০৯ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ। ২০০৮ সালে এক লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন, ২০০৭ সালে দুই লাখ ৭৩ হাজার ২০১ এবং ২০০৬ সালে ২০ হাজার ৪৬৯ জন বাংলাদেশি কাজ করতে যায় সেখানে।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের কারণ সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফরের সময় এ ব্যাপারে ওই দেশের সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
দরজা বন্ধ কুয়েতে: ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। ২০০৯ সালে এসে তা একরকম বন্ধই হয়ে যায়। ২০০৯ সালে মাত্র ১০ জন লোক কুয়েতে গেছেন। ২০১০ সালে গেছেন ৪৮ জন।
কুয়েতের জনশক্তি সমস্যা সমাধানে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েত সফর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কুয়েতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান। তবে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়েতে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। কিন্তু সেখানকার শ্রমবাজারে বর্তমানে প্রভাব বিস্তারকারী মিসর, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিরা টিকতে পারছেন না। বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বড় সমস্যা ভাষা না জানা। কুয়েতে বেশির ভাগ সরকারি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ‘কুয়েতাইজেশন’ কর্মসূচিও একটি বড় সমস্যা।
বন্ধ লিবিয়ার বাজার: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার যখন বন্ধ ছিল, তখন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের আশার আলো ছিল লিবিয়া। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে এই দেশটিতেও লোক পাঠানো বন্ধ। এ বছরের মার্চে যুদ্ধাবস্থা শুরুর পর দেশটি থেকে প্রায় ৪০ হাজার লোককে ফিরে আসতে হয়।
আরব আমিরাতকেন্দ্রিক বাজার: তিন বছর ধরে বাংলাদেশের শ্রমবাজার একেবারেই আরব আমিরাতকেন্দ্রিক। ২০০৮ সালে চার লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৮ এবং ২০১০ সালে দুই লাখ তিন হাজার ৩০৮ জন কর্মী সেখানে কাজ নিয়ে গেছেন। এ বছরও দুই লাখ লোকের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন বাজার নেই: সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নতুন বাজারের কথা বলা হচ্ছে। প্রচলিত শ্রমবাজারের বাইরে গত বছর নতুন ১৬টি দেশের তালিকা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হলো: জাপান, হংকং, তাইওয়ান, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা ও জিম্বাবুয়ে। এই দেশগুলোর পরিস্থিতি দেখতে প্রবাসী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচটি দলও গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা অনেক দেশ সফর করলেও নতুন বাজার খুঁজে পাননি।
কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি: জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দাবি, মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সরকারের কূটনীতি পুরোপুরি ব্যর্থ। এ কারণেই বাংলাদেশিদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বাজার যেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তেমনি সেখানে থাকা বাংলাদেশিদেরও নানা দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। তাই কূটনৈতিক উদ্যোগ দ্রুত বাড়ানো দরকার।
তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণসচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৯ ও ২০১০ সালের চেয়ে জনশক্তি রপ্তানির পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। এ বছর পাঁচ লাখ লোক বিদেশে যাবেন বলে আমরা আশা করছি। আর বন্ধ বাজারগুলো চালু করতে সব ধরনের চেষ্টাই চলছে। মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বৈধকরণ চলছে। সেটি শেষ হলে আবার শ্রমবাজার চালু হতে পারে। সৌদি আরবের একটি প্রতিনিধিদল এ বছর বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। এই বাজারটিও চালু হয়ে যাবে। অন্য বাজারগুলোও চালুর চেষ্টা চলছে।’
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই তিন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সব ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দাবি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই তিনটি শ্রমবাজার ধরে রাখতে সরকারের চেষ্টার পরও কোনো সফলতা আসেনি।
শুধু সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও কুয়েতই নয়; লিবিয়ায়ও লোক পাঠানো বন্ধ। ইরাকে অনেক সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও বাস্তবতা উল্টো।
আর নতুন শ্রমবাজার খোঁজার চেষ্টায়ও সফলতা নেই। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকার পাঁচটি কমিটি করে। কমিটি নতুন বাজারের খোঁজে বিভিন্ন দেশ সফরও করে, কিন্তু নতুন কোনো শ্রমবাজার খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কেন্দ্র করেই টিকে আছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।
জনশক্তি রপ্তানির এমন চিত্র হতাশাজনক উল্লেখ করে এ খাতের ব্যবসায়ীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করে। বায়রার সভাপতি আবুল বাশার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ সদস্যরা নানা ধরনের প্রশ্ন করেন, জবাব দিতে পারি না।’
সম্প্রতি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে পাঠায়। কমিটি গত ১০ বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির পরিসংখ্যান, সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চায়। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ২১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সংসদীয় কমিটির কাছে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়া ছিল বাংলাদেশের মূল বাজার। কিন্তু এই বাজারগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি কেন কমে গেছে, তা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিটি এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে। এখন একটি সুপারিশমালা তৈরি করে মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হবে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমবাজারগুলো চালু করতে কূটনৈতিক কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। সংসদীয় কমিটি যদি নতুন কিছু করতে পারে, তাহলে আমরা স্বাগত জানাব।’
জনশক্তি রপ্তানির এমন দুরবস্থা কেন, জানতে চাইলে আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘এটি গড়ে উঠেছে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। কিন্তু এখন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের পাশ কাটিয়ে সরকার সবকিছু করার চেষ্টা করছে। এটি একটি বড় সমস্যা। আর মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক জায়গায় আমাদের ভাবমূর্তির সংকট আছে। এই সংকট কাটাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে আট লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন এবং ২০০৮ সালে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে যান চার লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। ২০১০ সালে এ সংখ্যা আরেক দফা কমে দাঁড়ায় তিন লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জনে। তবে এ বছর কিছুটা বাড়তির দিকে।
আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৌদি আরবে: সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে এক লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন কর্মী, ২০০৭ সালে দুই লাখ চার হাজার ১১২ এবং ২০০৬ সালে এক লাখ নয় হাজার ৫১৩ জন কর্মী সৌদি আরবে গেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালে মাত্র ১৪ হাজার এবং গত বছর মাত্র সাত হাজার কর্মী সেখানে গেছেন।
সৌদি আরব এখন লোক নিচ্ছে নেপাল ও ভারত থেকে। শুধু জনশক্তি রপ্তানি কমানো নয়, সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতিপত্রও (আকামা) বদল করতে দিচ্ছে না। তাই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে ছয় থেকে সাত লাখ কর্মীকে।
সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে বেশির ভাগ সরকারি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সৌদিকরণ কর্মসূচি এবং ভিসার ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা চালুর কারণে সেখানে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ কর্মী কর্মরত থাকায় বাংলাদেশ কোটার সমস্যায় পড়েছে। এর বাইরে দক্ষ জনশক্তির বিপরীতে অদক্ষ জনশক্তি পাঠানো এবং কারিগরি জ্ঞানহীন স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের পাঠানোর কারণেও সৌদি আরবের শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
মালয়েশিয়া: এ দেশে ২০০৯ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ। ২০০৮ সালে এক লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন, ২০০৭ সালে দুই লাখ ৭৩ হাজার ২০১ এবং ২০০৬ সালে ২০ হাজার ৪৬৯ জন বাংলাদেশি কাজ করতে যায় সেখানে।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের কারণ সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফরের সময় এ ব্যাপারে ওই দেশের সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
দরজা বন্ধ কুয়েতে: ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। ২০০৯ সালে এসে তা একরকম বন্ধই হয়ে যায়। ২০০৯ সালে মাত্র ১০ জন লোক কুয়েতে গেছেন। ২০১০ সালে গেছেন ৪৮ জন।
কুয়েতের জনশক্তি সমস্যা সমাধানে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েত সফর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কুয়েতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান। তবে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়েতে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। কিন্তু সেখানকার শ্রমবাজারে বর্তমানে প্রভাব বিস্তারকারী মিসর, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিরা টিকতে পারছেন না। বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বড় সমস্যা ভাষা না জানা। কুয়েতে বেশির ভাগ সরকারি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ‘কুয়েতাইজেশন’ কর্মসূচিও একটি বড় সমস্যা।
বন্ধ লিবিয়ার বাজার: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার যখন বন্ধ ছিল, তখন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের আশার আলো ছিল লিবিয়া। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে এই দেশটিতেও লোক পাঠানো বন্ধ। এ বছরের মার্চে যুদ্ধাবস্থা শুরুর পর দেশটি থেকে প্রায় ৪০ হাজার লোককে ফিরে আসতে হয়।
আরব আমিরাতকেন্দ্রিক বাজার: তিন বছর ধরে বাংলাদেশের শ্রমবাজার একেবারেই আরব আমিরাতকেন্দ্রিক। ২০০৮ সালে চার লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৮ এবং ২০১০ সালে দুই লাখ তিন হাজার ৩০৮ জন কর্মী সেখানে কাজ নিয়ে গেছেন। এ বছরও দুই লাখ লোকের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন বাজার নেই: সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নতুন বাজারের কথা বলা হচ্ছে। প্রচলিত শ্রমবাজারের বাইরে গত বছর নতুন ১৬টি দেশের তালিকা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হলো: জাপান, হংকং, তাইওয়ান, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা ও জিম্বাবুয়ে। এই দেশগুলোর পরিস্থিতি দেখতে প্রবাসী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচটি দলও গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা অনেক দেশ সফর করলেও নতুন বাজার খুঁজে পাননি।
কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি: জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দাবি, মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সরকারের কূটনীতি পুরোপুরি ব্যর্থ। এ কারণেই বাংলাদেশিদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বাজার যেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তেমনি সেখানে থাকা বাংলাদেশিদেরও নানা দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। তাই কূটনৈতিক উদ্যোগ দ্রুত বাড়ানো দরকার।
তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণসচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৯ ও ২০১০ সালের চেয়ে জনশক্তি রপ্তানির পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। এ বছর পাঁচ লাখ লোক বিদেশে যাবেন বলে আমরা আশা করছি। আর বন্ধ বাজারগুলো চালু করতে সব ধরনের চেষ্টাই চলছে। মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বৈধকরণ চলছে। সেটি শেষ হলে আবার শ্রমবাজার চালু হতে পারে। সৌদি আরবের একটি প্রতিনিধিদল এ বছর বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। এই বাজারটিও চালু হয়ে যাবে। অন্য বাজারগুলোও চালুর চেষ্টা চলছে।’
No comments