হিলিতে চোরাচালানিতে শিশুদের ব্যবহার বাড়ছে by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ও আনোয়ার পারভেজ
সকাল সাতটা। হিলি স্থলবন্দর। মাঝখানে রেললাইন। ওপারে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি থানা। এপারে বাংলাদেশের দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বাংলা হিলি। রেললাইনের এপারে কয়েক মাসের শিশুসন্তান বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহিলা। ওপার থেকে পিঠে বোঝা নিয়ে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি দিয়ে দৌড়ে এল দুটি শিশু। দৃশ্যত অপেক্ষমাণ ওই নারী তাদের মা।
তিনি পাঁচ ও সাত বছর বয়সী শিশু দুটিকে নিয়ে দ্রুত হেঁটে একটা গলির ভেতরে ঢুকে গেলেন। হিলি বন্দরে এ দৃশ্য স্থানীয়দের কাছে নতুন কিছু নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত নারী ও শিশু এই কাজই করে। হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা বিদ্যালয় ছেড়ে এর দিকে ঝুঁকছে। গত শুক্রবার (৪ নভেম্বর) সকালে হিলি স্থলবন্দরে রেললাইনের এপারে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, ওপারে একদল শিশু। সবার পিঠেই বোঝা। সম্ভবত কারও ইশারায় এপারে আসার জন্য রেললাইন বরাবর একবার উত্তর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। আবার যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। এপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ওপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। যে যার স্থানে দাঁড়িয়ে। একপর্যায়ে শিশুরা রেললাইনের ওপর দিয়ে দৌড়ে পার হয়ে এল। তারপর বাংলা হিলি চেকপোস্ট সড়ক হয়ে দৌড়ে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
একটু পরে শিশুসন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটিকে খুঁজে বের করে তাঁর সঙ্গে কথা বলি। পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, ‘বাড়ি অংপুর ডিস্টিক। এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি।’ এতটুকু ছেলেকে কেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠিয়েছিলেন—জানতে চাইলে বলেন, ‘খিদার জ্বালায় পাঠাই। ওর বাপ যে কাম করে তাতে সংসার চলে না।’ ওপার থেকে মাল নিয়ে আসা সাত বছরের মঞ্জুরুলের পিঠে দুই কেজি ও পাঁচ বছরের এশারুলের পিঠে ছিল এক কেজি জিরার থলে। ওদের মা বললেন, এক কেজি জিরা নিয়ে এলে বিজিবি ও বিএসএফের ‘লাইনম্যানকে’ দেওয়ার পরে ১০-১২ টাকা করে থাকে।
প্রায় ১০ বছর বয়সী বারিক ও আলিমও ওপার থেকে জিরা নিয়ে আসে। ওরা স্কুলে যায় না। কথা বলতে বলতেই ওরা দৌড় দিয়ে সীমানার ওপারে চলে গেল। একজন বিএসএফ সদস্য ওদের একটু ধাওয়া দিলেন, যা নিছক ভঙ্গি বলেই মনে হলো।
আগের দিন বিকেলে চেকপোস্টের ঠিক উত্তর পাশে রেললাইনের ধারে এই প্রতিবেদককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ আর রেললাইন পার হচ্ছিল না। কারণ জানতে চাইলে মাঝবয়সী একজন বললেন, ‘আপনাকে দেখে ওরা ভয় পাইছে।’ বিজিবি-বিএসএফ কী কোনো সমস্যা নয়—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘ওরা তো পয়সা নিচ্ছে।’
এ প্রতিবেদক একটি ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে ছবি তুলতেই বিজিবি সদস্যরা ধরে ফেলেন। পরিচয় দেওয়ার আগেই তারা তোলা ছবিগুলো মুছে ফেলতে বাধ্য করেন। পরে কৌশলে দূর থেকে কয়েকটি শিশুর ছবি তোলা হয়।
স্থানীয় কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও শিশুদের ক্রমেই বেশি করে এই পেশায় জড়িয়ে পড়ার কথা জানা গেছে। বিশেষ করে, বাস্তুহারা পরিবারের শিশুরা মায়ের সঙ্গে যেতে যেতে এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
দক্ষিণ বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল মুনসুর বলেন, তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের ১০-১৫টি শিশুর কোমরে বস্তা বাঁধা পেয়েছেন। ছুটির পরে বাড়ি না গিয়ে তারা সরাসরি ওপারে যায়।
উত্তর বাসুদেবপুর রেলস্টেশনের পাশে জিরো পয়েন্ট বরাবর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একটি উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করেছে। কিন্তু তা কোনোই কাজে আসেনি।
শুক্রবার সকালে রাজশাহীগামী বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ট্রেনের অপেক্ষায় রেললাইনের ওপরে বসে ছিল কয়েক শ নারী-শিশু চোরাকারবারি। ট্রেন এসে দাঁড়ানোমাত্র মৌমাছির মতো তারা কামরাগুলো ঘিরে ফেলে। ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করে এ প্রতিবেদককে গলদঘর্ম হতে হয়। ভেতরে জিরার তীব্র গন্ধে দম আটকানোর অবস্থা। টয়লেটের ভেতরে-বাইরে মালের বস্তা থরে থরে সাজিয়ে রাখা।
অভিযোগ রয়েছে, এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ট্রেনের চেকার, নিরাপত্তা পুলিশ, বিজিবি সদস্য ও একশ্রেণীর দালাল—সবাই কমবেশি জড়িত। রাজশাহীতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিল একটি পরিবার। তাঁদের কাজের মেয়েটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চেকার এসে মাথায় হাত দিয়ে হেসে বললেন, ‘কী রে, তোর কী হারাইচে? মাল নিছিস নাকি?’ মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াতেই চেকার ভুল বুঝতে পেরে সরে পড়লেন।
শত শত চোরাকারবারির মধ্যে থেকে একজন পুলিশ পিঠে বস্তা বাঁধা এক নারীকে ধাক্কা দিতে দিতে একটি বিশেষ কক্ষে ঢোকালেন। কিছুক্ষণ পর ওই নারী বেরিয়ে এলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমি একজনের মাল টানতেছি। আমি কই থাইকে ডিউটি দেব। আমি কই সেন্টু ভাই টাকা দিবি। সে কই জিরে দে, জিরে দে।’ ট্রেনের ভেতরেই কাজ করছে একটি ‘ডিউটি আদায়কারী’ গ্রুপ। জানতে চাইলে এরকম একজন বললেন, ‘হামরা চাঁদা তুলে জিআরপি পুলিশকে দেই। পরে কালেকশন বুঝে বেতন পাই।’
এ বিষয়ে কথা বললে জয়পুরহাট বর্ডার গার্ড ৩ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘স্থলবন্দরে আমাদের প্রথমে সীমান্ত রক্ষার কাজটি করতে হয়। তারপর চোরাচালান ঠেকাতে হয়। একজনকে ধাওয়া দিতে গেলে পাশ দিয়ে আরেকজন চলে যায়। সারা দিন এই লুকোচুরি চলে।’
মেজর হাসানুজ্জামান বলেন, শিশুরা ধরা পড়লে মাল নিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। এই সুযোগটা তারা কাজে লাগাচ্ছে। আর ট্রেন থামিয়ে চেক করতে গেলে যাত্রীরা বিরক্ত হন। তিনি অভিমত দেন চোরাচালান বন্ধ করতে হলে সরকার এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। হিলিতে কর্মসংস্থানও করতে হবে।
একটু পরে শিশুসন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটিকে খুঁজে বের করে তাঁর সঙ্গে কথা বলি। পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, ‘বাড়ি অংপুর ডিস্টিক। এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি।’ এতটুকু ছেলেকে কেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠিয়েছিলেন—জানতে চাইলে বলেন, ‘খিদার জ্বালায় পাঠাই। ওর বাপ যে কাম করে তাতে সংসার চলে না।’ ওপার থেকে মাল নিয়ে আসা সাত বছরের মঞ্জুরুলের পিঠে দুই কেজি ও পাঁচ বছরের এশারুলের পিঠে ছিল এক কেজি জিরার থলে। ওদের মা বললেন, এক কেজি জিরা নিয়ে এলে বিজিবি ও বিএসএফের ‘লাইনম্যানকে’ দেওয়ার পরে ১০-১২ টাকা করে থাকে।
প্রায় ১০ বছর বয়সী বারিক ও আলিমও ওপার থেকে জিরা নিয়ে আসে। ওরা স্কুলে যায় না। কথা বলতে বলতেই ওরা দৌড় দিয়ে সীমানার ওপারে চলে গেল। একজন বিএসএফ সদস্য ওদের একটু ধাওয়া দিলেন, যা নিছক ভঙ্গি বলেই মনে হলো।
আগের দিন বিকেলে চেকপোস্টের ঠিক উত্তর পাশে রেললাইনের ধারে এই প্রতিবেদককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ আর রেললাইন পার হচ্ছিল না। কারণ জানতে চাইলে মাঝবয়সী একজন বললেন, ‘আপনাকে দেখে ওরা ভয় পাইছে।’ বিজিবি-বিএসএফ কী কোনো সমস্যা নয়—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘ওরা তো পয়সা নিচ্ছে।’
এ প্রতিবেদক একটি ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে ছবি তুলতেই বিজিবি সদস্যরা ধরে ফেলেন। পরিচয় দেওয়ার আগেই তারা তোলা ছবিগুলো মুছে ফেলতে বাধ্য করেন। পরে কৌশলে দূর থেকে কয়েকটি শিশুর ছবি তোলা হয়।
স্থানীয় কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও শিশুদের ক্রমেই বেশি করে এই পেশায় জড়িয়ে পড়ার কথা জানা গেছে। বিশেষ করে, বাস্তুহারা পরিবারের শিশুরা মায়ের সঙ্গে যেতে যেতে এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
দক্ষিণ বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল মুনসুর বলেন, তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের ১০-১৫টি শিশুর কোমরে বস্তা বাঁধা পেয়েছেন। ছুটির পরে বাড়ি না গিয়ে তারা সরাসরি ওপারে যায়।
উত্তর বাসুদেবপুর রেলস্টেশনের পাশে জিরো পয়েন্ট বরাবর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একটি উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করেছে। কিন্তু তা কোনোই কাজে আসেনি।
শুক্রবার সকালে রাজশাহীগামী বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ট্রেনের অপেক্ষায় রেললাইনের ওপরে বসে ছিল কয়েক শ নারী-শিশু চোরাকারবারি। ট্রেন এসে দাঁড়ানোমাত্র মৌমাছির মতো তারা কামরাগুলো ঘিরে ফেলে। ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করে এ প্রতিবেদককে গলদঘর্ম হতে হয়। ভেতরে জিরার তীব্র গন্ধে দম আটকানোর অবস্থা। টয়লেটের ভেতরে-বাইরে মালের বস্তা থরে থরে সাজিয়ে রাখা।
অভিযোগ রয়েছে, এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ট্রেনের চেকার, নিরাপত্তা পুলিশ, বিজিবি সদস্য ও একশ্রেণীর দালাল—সবাই কমবেশি জড়িত। রাজশাহীতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিল একটি পরিবার। তাঁদের কাজের মেয়েটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চেকার এসে মাথায় হাত দিয়ে হেসে বললেন, ‘কী রে, তোর কী হারাইচে? মাল নিছিস নাকি?’ মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াতেই চেকার ভুল বুঝতে পেরে সরে পড়লেন।
শত শত চোরাকারবারির মধ্যে থেকে একজন পুলিশ পিঠে বস্তা বাঁধা এক নারীকে ধাক্কা দিতে দিতে একটি বিশেষ কক্ষে ঢোকালেন। কিছুক্ষণ পর ওই নারী বেরিয়ে এলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমি একজনের মাল টানতেছি। আমি কই থাইকে ডিউটি দেব। আমি কই সেন্টু ভাই টাকা দিবি। সে কই জিরে দে, জিরে দে।’ ট্রেনের ভেতরেই কাজ করছে একটি ‘ডিউটি আদায়কারী’ গ্রুপ। জানতে চাইলে এরকম একজন বললেন, ‘হামরা চাঁদা তুলে জিআরপি পুলিশকে দেই। পরে কালেকশন বুঝে বেতন পাই।’
এ বিষয়ে কথা বললে জয়পুরহাট বর্ডার গার্ড ৩ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘স্থলবন্দরে আমাদের প্রথমে সীমান্ত রক্ষার কাজটি করতে হয়। তারপর চোরাচালান ঠেকাতে হয়। একজনকে ধাওয়া দিতে গেলে পাশ দিয়ে আরেকজন চলে যায়। সারা দিন এই লুকোচুরি চলে।’
মেজর হাসানুজ্জামান বলেন, শিশুরা ধরা পড়লে মাল নিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। এই সুযোগটা তারা কাজে লাগাচ্ছে। আর ট্রেন থামিয়ে চেক করতে গেলে যাত্রীরা বিরক্ত হন। তিনি অভিমত দেন চোরাচালান বন্ধ করতে হলে সরকার এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। হিলিতে কর্মসংস্থানও করতে হবে।
No comments