আমেরিকার বন্দুক-সংস্কৃতি by মাহমুদ শামসুল হক
গর্দানের লোম বড় হলেই তাকে কেশর মনে করার কারণ নেই। অস্ত্র হাতে পেলে কোনো কোনো মানুষের এমনটি হয়। যুদ্ধ-দাঙ্গা, খুন-খারাবি, বন্দুকবাজি এখন আর কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। মানুষ ক্রমশ সহিংস হয়ে উঠছে। অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে; হাতে তুলে নিচ্ছে মারণাস্ত্র। টার্গেট প্রতিপক্ষ, দুর্বল মানুষ, অবাধ্য মানুষ। আক্রমণ এবং আত্মরক্ষা দুই-ই এখন অস্ত্রনির্ভর। বন্দুকবাজি তো রীতিমত চর্চার বিষয়। তারাই এখন ‘অসভ্য’, যাদের হাতে অস্ত্র নেই।
এক্ষেত্রে মার্কিন সমাজ একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। সোজা কথায় অস্ত্র-সভ্যতার জনক। মার্কিন সমাজে বন্দুক খেলনার শামিল, এমনকি স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের কাছেও। সেখানে প্রায় প্রকাশ্য বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে পিস্তল-রিভলভার-রাইফেল। লাইসেন্স-পারমিটের কড়াকড়ি নেই বললেই চলে। বন্দুকবাজির এই অবাধ চর্চাকে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই অভিহিত করেছেন ‘গান-কালচার’ বলে। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় বন্দুক-সংস্কৃতি। সমাজবিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, অপরাধ বিস্তারের ক্ষেত্রে আমেরিকান সমাজে প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রতিরোধের দেয়ালে ধস লেগেছে। কথিত ‘গণতন্ত্রের দেশ’, বর্তমান বিশ্বের একচ্ছত্র মোড়ল তথা পরাশক্তি এখন ভুগছে অবক্ষয়ের অসুখে। বন্দুকবাজি তারই একটা দিক। ‘ফেডারেল গান ট্রেড রেগুলেশন’ বলে যে বিধান রয়েছে সেদেশে, সে বিধানের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মরণঘাতী অস্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে হামেশা। মারণাস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে বেডরুম থেকে স্কুল মায় হাসপাতাল পর্যন্ত। ১৯৮৮ সালে পনেরো বছরের এক আমেরিকান কিশোর স্কুলব্যাগে রাখা হ্যান্ডগান বের করে যেদিন গুলিবৃষ্টি চালিয়ে স্কুলের আঙ্গিনায় মেরে ফেলল তার কয়েকজন শিক্ষককে—তার পরদিনই জানা গেল, আমেরিকান সমাজ অস্ত্রবাজিকে শুধু আবশ্যক নয়, অনিবার্যও মনে করে। সেখানে একুশ বছর বয়স হলে বন্দুক কিনতে পারে যে কোনো নাগরিক। একটি ফরম পূরণ করে দিলেই হলো। তারও দরকার পড়ে না। বেআইনিভাবে কেউ মারণাস্ত্র চাইলেই চলে আসে হাতের মুঠোয়। বন্দুকবাজি আর খেলার মধ্যে বলতে গেলে তেমন কোনো তফাত্ নেই। তা অনেকটাই টের পাওয়া যায় মারণাস্ত্র বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে। পত্রিকা, ম্যাগাজিন ছাড়াও টেলিভিশনে দেয়া হয় চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব বিজ্ঞাপন হাতে-কলমে গুণ্ডামি শেখানোরই নামান্তর। তারা স্লশিয়ার করছেন প্রশাসনকে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এমন একটি ম্যাগাজিনের নাম ‘আমেরিকান হ্যান্ডগানার’। ১৯৯২ সালে সল্টার ফায়ার নামের একটি হ্যান্ডগানের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, সল্টার ফায়ারের চেয়ে জোরালো মারণ-বুলেট আর তৈরি হয়নি। এ বুলেট শরীরে ঢুকে বাড়তে বাড়তে এগিয়ে যায়। পেশি-হাড় ছিঁড়ে-ফুঁড়ে বানিয়ে নেয় বড় ছিদ্রপথ। একদম নিশ্চিত হওয়া যায় ‘খতম’ হয়েছে। বন্দুকবাজি শেখার জন্য ঢের বইপত্তর পাওয়া যায় এমনকি মেলায় পর্যন্ত। চোরাগোপ্তা গুলি ছোড়ার কায়দা নিয়ে অনুপুগ্ধখ বিবরণ আছে সেইসব বইয়ে। এর ওপর রয়েছে ভিডিও চিত্র। জিলোটিন দিয়ে বানানো নকল মানুষকে গুলি করলে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে স্কুলগামী কিশোররা। ‘আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক’—এই স্লোগান তুলে মানুষ মারার কৌশল সম্পর্কে এভাবেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। খোদ মার্কিন সমাজবিদরাই স্বীকার করছেন, আজকাল আমেরিকার ঘরে ঘরে চলছে শক্তিশেলের সাধনা। ঘরের লকারে রাখা হচ্ছে সর্বাধুনিক মডেলের মারণাস্ত্র। ছেলেমেয়েরা এগুলো নিয়ে রাস্তায় খেলছে। নিশানা সই করতে অনেকে ঝাঁঝরা করছে রাস্তার নিয়ন সাইন, সাইনবোর্ড। এক পরিসংখ্যান মতে, ১৭৮৯ সালে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে বিশ কোটি ফায়ার আর্মস, যার মধ্যে ছয় কোটি সাতষট্টি লাখ হ্যান্ডগান। বিগত দশকগুলোতে এর সংখ্যা কত বেড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সব মিলিয়ে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা আঁচ করে সে দেশের ফায়ার আর্মস বিশেষজ্ঞ কর্নেল লিওগার্ড সুপেন্সকি ক’বছর আগে বলেছিলেন, ‘আমেরিকার ফায়ার আর্মস ইন্ডাসিল্ট্রর কোনো আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মনীতি নেই।’ না, নেই। আমেরিকার রাজনীতিতেও তার নগ্ন প্রকাশ আগাগোড়া লক্ষ্য করা গেছে। বস্ল জনপদ সাবাড় করেছে আমেরিকার মারণাস্ত্র। স্রেফ তেলের লোভে ইরাককে রক্তস্নাত করেছে, সন্ত্রাসী ধরার নামে আফগানিস্তানের পার্বত্য জনপদ ধূলিলগ্ন করেছে, করছে আজও। আমেরিকা এখন কেবল অর্জুন নয়, দ্রৌণাচার্যও বটে। একাধারে অস্ত্রবিদ, নির্মাতা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক। গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি নিয়ে সর্বদা সশস্ত্র। মানুষ কী চাইছে তা নয়, আমেরিকা কী চাইছে সেটাই এখন বড় কথা। এ অবস্থায় মনুষ্যত্ব এবং মানুষের গুরুত্ব কোথায়? আমেরিকা গণতন্ত্রের দেশ, সংশয় নেই। তবে তারা যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করেছে-করছে বিভিন্ন দেশে, তাতে প্রমাণ হচ্ছে মানুষের চেয়ে কৃত্রিম ও যান্ত্রিক মেধাই বেশি মূল্যমান বহন করে। আমেরিকা যে নতুন বিশ্বব্যবস্থা বা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ অর্ডারের কথা বলছে তারও অন্তর্গত ভাষ্য হচ্ছে, আমেরিকার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে কিছু থাকবে না। কারণ? কারণ ওই একটাই—‘গান-কালচার’ বা বন্দুক-সংস্কৃতিতে আমেরিকা সবার চেয়ে এগিয়ে।
No comments