উইকেটের পেছনে নায়ক বাউচার by হাসনাত মুনীর

সেঞ্চুরির উচ্ছ্বাসে উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে শূন্যে লাফ দেওয়ার সুযোগ তার হয় কালেভদ্রে। উইকেটকিপার বলে বল হাতে উইকেট শিকারের উৎসব করার কোনো সুযোগই নেই। এর পরও মার্ক বাউচার নায়ক। তবে উইকেটের পেছনের নায়ক!সত্যিই তাই। শচীন টেন্ডুলকারের একটি সেঞ্চুরি নিয়ে যতটা কালি-কাগজের খরচ, জনসন কিংবা স্টেইনের একটি বিধ্বংসী বোলিং স্পেল নিয়ে যতটা সরগরম আলোচনা, ততটা কোথায় হাওয়ায় ভেসে বাউচারের নেওয়া একটি ক্যাচকে ঘিরে? কিংবা বাউচারের শকুনের চোখে করা স্টাম্পিংগুলো নিয়ে?


অথচ বাউচার ঠিকই সেই ফুলগুলোর মতো আড়ালে-আবডালে বেড়ে উঠছেন, ক্রিকেটেরই আলো-বাতাসে। প্রত্যাশিত প্রচার জুটছে না কপালে কিন্তু ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সুবাস তিনি ছড়িয়েই চলেছেন দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ। নিত্যই ছাপিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে।
এই তো কেপটাউন টেস্টে আরও একটি চূড়ায় পা রাখা হলো তার। উইকেটরক্ষক হিসেবে ৫০০ ক্যাচ নেওয়ার মাইলফলক ছোঁয়ার বিরল কৃতিত্ব এখন একমাত্র বাউচারের। অথচ ১৯৯৭ সালে শিখুপুরা টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে কি সাদামাটা শুরুই না হয়েছিল তার। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক তখন হ্যান্সি ক্রনিয়ে। বাউচার টেস্ট ক্রিকেটে আনকোরা। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়ায় প্রোটিয়া নির্বাচকদের নজর কেড়েছিলেন। সেই সুবাদে ক্রনিয়ের টেস্ট দলে ঠাঁই পাওয়া। শিখুপুরায় পাকিস্তানের বিপক্ষে হয়ে গেল টেস্ট অভিষেক, কিন্তু অভিষেকের সোনালি রঙ বিবর্ণ হয়ে গেল তিন দিন খেলা না হওয়ায়। ওই টেস্টে আগে ব্যাট করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। পরে পাকিস্তান। মাত্র দুই দিনের খেলায় পাকিস্তানের একটি মাত্র উইকেটের পতনই হয়েছিল। সাঈদ আনোয়ারের উইকেটটি শিকার করেছিলেন সাইমক্স। উইকেটের পেছনে গল্গাভস জোড়া হাতে কিছু করে দেখানো হলো না বাউচারের। তখন কি বাউচার কল্পনায় এঁকেছিলেন এত দূর পেঁৗছানোর স্বপ্ন?
এরপর সময় গড়িয়ে এলো ১৯৯৮ সাল। সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই জোহানেসবার্গ টেস্টে ডিসমিসালের খাতায় প্রথম আঁচড় পড়ল বাউচারের। পাকিস্তানের ওপেনার আমির সোহেলের ক্যাচ তালুবন্দি করেছিলেন তিনি। মানে শুরু হলো বাউচারের এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
বাউচারের শুরুর আগে উইকেটের পেছনে থেকে ইয়ান হিলি, রডনি মার্শ, জেফ ডুজনরা কিংবদন্তি বনে গেছেন। পরে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটের সামনে আর উইকেটরক্ষক হিসেবে পেছনে প্রমাণ করেছেন নিজের অপরিহার্যতা। কিন্তু এখন সবাইকে ছাপিয়ে উঁচু থেকে আরও উঁচুতে বাউচার! ৮১ টেস্টে ডুজনের শিকার ২৭০টি। মার্শ ডিসমিস করেছেন ৩৪৩ ব্যাটসম্যানকে। ৩৯৫টি ডিসমিসাল হিলির। তাদের প্রথম ছাপিয়ে গেলেন গিলক্রিস্ট। ৯৬ টেস্টে ৪১৬ বার ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে ফেরানোর পেছনের নায়ক হলেন 'গিলি', যার মধ্যে ৩৭৯টি ক্যাচ ও ৩৭টি স্টাম্পিং। গিলক্রিস্টকে বাউচার টপকে গেছেন আরও অনেক আগে। প্রোটিয়া দলের এ তারকার লড়াই এখন নিজের সঙ্গে। এ মুহূর্তে ৫২৩ (কেপটাউন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংস পর্যন্ত) ডিসমিসাল করেছেন তিনি। তালুতে ক্যাচ জমিয়েছেন ৫০১টি। ২২টি স্টাম্পিং। বলার অপেক্ষা রাখে না নতুন চূড়া মানে বাউচার পা রেখেছেন উইকেটরক্ষক হিসেবে পাঁচশ'র বেশি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড গড়ে।
এক যুগেরও বেশি সময়ের টেস্ট ক্যারিয়ারে বাউচার সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই উইকেটের পেছনে দারুণ সফল। পরিসংখ্যানও বলছে একই কথা। এ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০ টেস্ট খেলেছেন তিনি, তাতে মোট ডিসমিসাল ৬৮টি। সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ২৫ টেস্টে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে ফেরানোর উইকেটের পেছনের কাজটি বাউচার করেছেন ১০৫ বার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সবচেয়ে কম প্রাপ্তি তার। ৬ টেস্টে ২৫টি। তবে ইনিংসপ্রতি ডিসমিসালের হিসাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন তিনি। টাইগারদের সঙ্গে খেলা মাত্র ৮ টেস্টে বাউচারের ডিসমিসালের সংখ্যা ৪০টি।
গত ৯ নভেম্বর ছিল বাউচারের ক্যারিয়ারের আরেকটি সোনালি দিন। ভারলন ফিলেন্ডারের বল ফিল হিউজেসের ব্যাটের কানায় লেগে হাওয়ায় ভাসল। হাওয়ায় ভাসলেন আরও একজন, তিনি মার্ক বাউচার। চোখের পলকে বল তার তালুবন্দি। দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার চলতি কেপটাউন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ষষ্ঠতম ওভারের শেষ বলটির ওই দৃশ্যই হয়ে গেল দারুণ এক ইতিহাসের সাক্ষী। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উইকেটকিপার হিসেবে পাঁচশ'র বেশি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড গড়ে ফেললেন বাউচার।
আগামী ৩ জানুয়ারি পঁয়ত্রিশতম জন্মদিনের কেক কাটবেন তিনি। মানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কিছুটা সময় এখনও তার সামনে পড়ে আছে। মানে সামনে নিজেকে আরও উঁচুতে তোলার হাতছানি এখন বাউচারের সামনে। এখন চাই প্রোটিয়াদের উইকেটের পেছনে বিশ্বস্ত গল্গাভস জোড়া হাতে চলতি সময়ের এ ধারাবাহিকতাটুকু ধরে রাখা। ক্রিকেটকে বিদায় বলার আগে বাউচার কত উঁচুতে পেঁৗছাবেন কে জানে! শচীন টেন্ডুলকারের মতো ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ডের মালিক হওয়া হবে না তার, তবে উইকেটকিপার হিসেবে প্রাপ্তির এভারেস্টেই চড়বেন এ দক্ষিণ আফ্রিকান।

No comments

Powered by Blogger.