চৈতন্যের মুক্তবাতায়ন-সাক্ষর শিক্ষাভিমানী বনাম অনক্ষর প্রাকৃতজন by যতীন সরকার

ময়মনসিংহ জেলখানায় আমি বিনা বিচারে আটক ছিলাম ১৯৭৬ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৭-এর আগস্ট- অর্থাৎ পুরো ১৮ মাস। এই ১৮ মাসে অনেক 'শিক্ষিত' রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর সঙ্গলাভ যেমন করেছি, তেমনই খুব কাছ থেকে দেখেছি অনেক 'অশিক্ষিত' অপরাধী ও কয়েদিকেও।


'শিক্ষিত' রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের কেউ কেউ ছিলেন প্রচণ্ড শিক্ষাভিমানী। শুধু শিক্ষাভিমান নয়, কূটবুদ্ধি ও কথার মারপ্যাঁচেও তাঁরা একান্ত দক্ষ। ক্ষণে ক্ষণে মত বদলেও তাঁদের দক্ষতা অপরিসীম। তাঁদেরই কারো কারো মুখে সকালে যে কথা শুনেছি, বিকেলেই হয়তো শুনতে হলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। এ রকম কয়েকজন নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীর সরকারবিরোধী বক্তব্য শুনে মনে হতো যে সে সময়কার ক্ষমতাসীন সরকারের যেকোনো সংস্থার, যেকোনো ব্যক্তির ছায়া মাড়ানোও তাঁদের মতে মহাপাপ। অথচ কয়েক দিনের ব্যবধানেই দেখলাম যে তাঁদের অনেকেই মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফেলেছেন।
'মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া' মানে সরকারের কাছে পুরো আত্মসমর্পণ করে এ রকম অঙ্গীকারপত্র লিখে দেওয়া যে ভবিষ্যতে রাজনীতির ত্রিসীমানায় পা দেব না, যদি দিই তো অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য সরকার বাহাদুর আমার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারবে। অঙ্গীকারের ভাষাটা একেবারে হুবহু এ রকম না হলেও এর মূল মর্ম ছিল এমনই। অথচ অতিপ্রগল্ভ অনেক নেতা-কর্মীই তলে তলে অনেক তদ্বির করে এবং যথেষ্ট টাকাকড়ি খরচ করে- মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এর সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টান্ত ও ঘটনাও অবশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। বিনা বিচারে আটক কিছু রাজনৈতিক কর্মীর (বিশেষ করে খুব অল্পসময় আগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন) সামনে কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগেই মুচলেকার টোপ ফেলা হয়েছিল, কিন্তু তাঁদের অনেককেই সে টোপ গেলানো সম্ভব হয়নি।
বিশেষ করে আমার সহকর্মী বন্ধু রিয়াজুল ইসলাম তো এ ব্যাপারে অসাধারণ দৃঢ়তা দেখালেন। আমার সমবয়স্ক হলেও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন মাত্র কিছুদিন আগেই। এই স্বল্পসময়ের যুক্ততাই তাঁকে এমন দৃঢ়চিত্ত করে তুলেছিল যে সবাইকে অবাক করে তিনি কর্তৃপক্ষকে এমন কথা জানিয়ে দিলেন যে 'মুচলেকা দিয়ে মুক্তি নেওয়াকে আমি ঘৃণা করি।'
প্রায় অনুরূপ দৃঢ়তা আরো কেউ কেউ দেখিয়েছেন। তাঁদের দেখে ভাবিকালের ভাবনায় অসীম আশাবাদে উজ্জীবিত হয়েছি। মনে প্রত্যয় জন্মেছে- দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মুনাফিকরাই একাধিপত্য করে না, শিক্ষা সবাইকে অপকৌশলী বানায়নি, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ও গণমানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। তবে শিক্ষিত ও শিক্ষাভিমানীদের মধ্যে প্রচুর জ্ঞানপাপী থাকলেও অনক্ষর ও অশিক্ষিত বলে পরিচিত মানুষের ভেতরে কোনো জ্ঞানপাপীর সন্ধান আমি পাইনি। ওই অনক্ষর প্রাকৃতজনের সবাই নিষ্পাপ এমন কথা অবশ্য বলি না। শ্রেণী-সমাজের অন্তর্নিহিত যে পাপ, সে পাপের হাত থেকে কেউই কী পূর্ণ মুক্তি লাভ করতে পারে? কারাভ্যন্তরে আমার আশপাশে যে প্রাকৃতজনদের আমি দেখেছি, তাঁরাও স্বভাবতই কেউই নিষ্পাপ ছিলেন না। লঘু বা গুরু যেকোনো রকম পাপকর্মের জন্যই যে তাঁদের কারাগারে ঢুকতে হয়েছে- সে কথা অস্বীকার করা যায় না কোনোমতেই। কিন্তু তঁদের পাপকর্ম করতে বাধ্য করেছে কারা? তাঁরা তো সমাজের উচ্চমঞ্চে আসীন শিক্ষাভিমানী বদমায়েশের দল, তাঁরা তো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন এবং সর্বদা সে রকমই থেকে যান। তাঁদের সামাজিক বা রাষ্ট্রিক পরিচিতি যাই হোক না কেন, তাঁরাই তো পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে রামের অপরাধে শ্যামের মাথা ভাঙে, কাউকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেন। আবার গুরুতর পাপীকেও দণ্ডভোগের দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সব তেলেসমাতি কারবারও তাঁদেরই।
জেলখানায় আমার আশপাশে আমি যেসব দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন অপরাধী দেখেছি, তাঁরা প্রায় সবাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষক সমাজভুক্ত অনক্ষর মানুষ। কৃষকদের জীবনপ্রণালি ও ভাবজগতের সঙ্গে আমার আশৈশব পরিচয়। অপরাধী কৃষকেরাও যে সেই ভাবজগৎ পরিত্যাগ করেননি- এ বিষয়টা আমি কারাগারে এসেও প্রত্যক্ষ করলাম। সাক্ষর শিক্ষিতজনের বিপরীতে তাঁদের চিন্তা ও প্রকাশ অভিন্ন, চিন্তায় যেমন তাঁরা একান্ত সৎ ও জটিলতামুক্ত, প্রকাশেও তেমনই আন্তরিক ও নির্ভীক। নানা অপরাধ সংঘটন করে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থেকেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা সবাই কৃষিসংশ্লিষ্ট বাংলার চিরাচরিত সংস্কৃতির ধারক। সেই সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িত তাঁদের মূল্যবোধ। সে মূল্যবোধের অনুষঙ্গী সুগভীর ধর্মবিশ্বাস, কিন্তু সে ধর্মবিশ্বাস পুরুত মোল্লা-যাজকদের বিধিবিধানের পরোয়া করে না। একাডেমিক পরিভাষায় যাকে 'লৌকিক ধর্ম' বলে, তারই অনুসারী এ দেশের কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাকৃতজন। প্রাকৃতজনের লৌকিক ধর্ম ধ্রুপদী শাস্ত্রগ্রন্থের পাতা থেকে উঠে আসেনি, মোটা মোটা পুঁথি ও কিতাব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এ ধর্মের বিশ্বাস ও বিধানের কোনো হদিস মিলবে না, এ ধর্ম একান্তই 'অপুঁথ্যা' এবং অপুঁথ্যা বলেই পুঁথিসম্পর্কহীন অনক্ষর মানুষের চিন্তায় ও আচরণে এ ধর্মের সুদৃঢ় অধিষ্ঠান। হ্যাঁ, তারা হিন্দু কিংবা মুসলমান কিংবা অন্য কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বটে, সেসব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানও তারা পালন করে অবশ্যই। জেলখানায়ও ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা উপলক্ষে আনন্দের বান ডেকে যেতে দেখেছি। কিন্তু, কী আশ্চর্য, এসব কোনো ধর্মীয় পার্বণের আনন্দই ধর্মসম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি।
সব পার্বণেই সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই সবাইকে জড়িয়ে কোলাকুলি করেছে, একসঙ্গে বসে ভোজনানন্দে মেতে উঠেছে।
ওই অনক্ষর বন্দিদের সঙ্গে আমি অনেক কথাবার্তা বলে অনুভব করেছি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি তাঁদের অসাধারণ আবেগ, স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি তাঁদের তীব্র ঘৃণা। সেই আবেগ ও ঘৃণাকে লুকিয়ে রেখে অন্য রকম কথা নিজেরা তো বলতেই পারেন না, অন্যরাও এ রকম বলতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন না। এ কারণেই সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত সাক্ষর বা তথাকথিত শিক্ষিত লোকদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের কথায় তাঁরা প্রতারিত হয়, প্রতিনিয়ত প্রতারিত হতে হতে হতাশাও তাঁদের মনে বাসা বাঁধে বৈকি।
কিন্তু হতাশ হয়েও লৌকিক সংস্কৃতিকে তাঁরা পরিত্যাগ করেন না। কারাবন্দিদের মধ্যেও এমনটি দেখে আমি চমৎকৃত হয়ে গেলাম। শুধু চমৎকৃতই হইনি। আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে যায় যে একদিন এই প্রাকৃতজনের হাতেই আমাদের দেশটির কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর ঘটবে, তাঁরাই প্রগতিচেতন মানুষের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে আবহমান বাংলার লৌকিক ধর্ম ও লৌকিক সংস্কৃতি নিয়ে মুনাফিক মতলববাজ ও ধর্মধ্বজী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
তাঁদের অনেকের কণ্ঠেই শুনেছি সেই সব লোকসংগীত যেগুলোতে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাধে না'। তাদের গাওয়া অনেক সংগীতে তো শাস্ত্রীয় বিধিবিধানের প্রতি তীব্র অনাস্থাসূচক ব্যঙ্গবিদ্রূপও ধ্বনিত হয়। লোকসমাজের কবি দ্বিজদাসের নাম-পরিচয় আমার জানা ছিল, কিন্তু তাঁর রচিত কোনো গান আমি আগে শুনিনি। জেলখানায়ই এক কয়েদির দরদভরা কণ্ঠে দ্বিজদাসের গান শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। ঈশ্বরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই
'পাগল দ্বিজদাসের গান-
কেহ শোন বা না শোন, মান বা না-মান,
তাতে আমার নাই কোনো লাভ-লোকসান।
কেহ বলে আছ তুমি, কেহ বলে নাই,
আমি বলি থাকলে থাক, না থাকিলে নাই।
নয়নে দেখি না, শ্রবণে শুনি না,
পরশনে পাই না, মিলে না প্রমাণ।
কেহ বলছে সাকার, কেহ কয় নিরাকার,
আসলে কী প্রকার, কে জানে সন্ধান,
কাঁদিয়া ডাকিলে পরে উত্তর না পাই,
হাজার ভালো-মন্দ বলি, বেজার খুশি নাই।
দিয়ে এমন বোকা, কার কি আছে ঠেকা,
থাকা আর না- থাকা, ফলে এক সমান
ভক্ত মুসলমানে পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ,
ত্রিসন্ধ্যা নিয়ম-বাঁধা হিন্দুগণের কাজ।
যারা যায় গির্জাতে, সপ্তাহ পারেতে
তারাই জগতে মানুষ প্রধান
বাইবেল কোরান বেদ পুরাণ, যত সব পুঁথি।
মানি বলে মনে বলে এই দুর্গতি।
মানতে মানতে শাস্ত্র, পাই না অন্ন বস্ত্র,
লাঠি বঠি অস্ত্র ক্রমে তিরোধান

লোকসমাজের মানুষেরা যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতেও পাপভয়ে ভীত হয় না, কবিগান কিংবা মালজোড়া বাউল গানে গায়করা যে অনায়াসে ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে তর্কবিতর্ক করে যায় এবং সেসব তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে অনবরত যে রকম মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে চলে তারা, সে রকমটি শিক্ষিত ও বিদগ্ধজনেরাও করতে পারেন না।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত করেই ঈশ্বরের স্বরূপ উপলদ্ধিতে লোকসাধারণের প্রয়াস। তাদের ভাবনায়- 'সেই মানুষে না ধরিলে/খোদা কভু না মিলে।' আরো উচ্চকণ্ঠে তাদের নির্দ্বিধ প্রত্যয়-
'খোদ আর খোদা উভয়ে একজন।
খোদকে ধরে করো ভজন
জেলখানায় এসেও দেখলাম- অপরাধ সংঘটন করে কারাবন্দি হয়েও ওই সব প্রাকৃতজন 'খোদ আর খোদা'র অভিন্নতাবোধক লৌকিক ধর্ম সংস্কৃতিকে ভুলে যায়নি। তাই নেত্রকোনার লোককবি জালালউদ্দীন খাঁর খোদাকে সম্বোধন করে রচিত সেই গানটিও প্রায়ই তাঁরা গুন গুন করে গাইতে থাকেন-
'বিশ্বপ্রাণের স্বরূপ ছায়া
আমাতে তোমারি মায়া,
ছেড়ে দিলে এসব কায়া
তুমি বলতে কিছু নাই
তুমি যে অনন্ত অসীম,
আমাতে হয়েছ সসীম;
কালী কৃষ্ণ, করিম-রহিম
কত নামে ডাকছি তাই

লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.