অর্থনীতি-কর দিতেই যত অনীহা by আসজাদুল কিবরিয়া
রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ছয়তলাবিশিষ্ট একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মিত হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। এই ভবনে ৩০টি বিভিন্ন আয়তনের ফ্ল্যাট রয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) নিয়ম অনুসারে এই ফ্ল্যাটগুলোর মালিকদেরকে হোল্ডিং ট্যাক্স বা কর দিতে হবে।
কর নির্ধারণের জন্য ডিসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ফ্ল্যাটের মালিকদের একটি সমঝোতা হলো। সে জন্য প্রতি ফ্ল্যাটের মালিকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তোলা হলো। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও দাখিল করা হলো।
কিছুদিন পর যখন ফ্ল্যাটের মালিকদের কাছে করের নোটিশ এল, তখন তাঁদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। কারও কারও ত্রৈমাসিক করের কিস্তি এসেছে ৩০০-৪০০ টাকা। কারও বা ১৮০০-১৯০০ টাকা। কেন এই পার্থক্য? জানা গেল, যাঁদের বড় অঙ্কের ঋণ রয়েছে, তাঁদের প্রদেয় কিস্তি কম এসেছে। এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্টি এল না বাকিদের। তাঁরা আপিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আবার নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সমঝোতা হলো। এবার প্রদেয় করের কিস্তি আরেকটু কম নির্ধারণ করা হলো। ফ্ল্যাটের বার্ষিক মূল্যায়ন করে এই কর ও করের কিস্তি নির্ধারিত হয়েছে। প্রথমবার মূল্যায়নে যে মূল্য ধরা হয়েছিল, আপিলের পর তা কিছুটা কমানো হয়েছে।
সম্প্রতি এই ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় কিছু প্রশ্ন জেগেছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণও ধরা পড়েছে। প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতেই এই লেখার অবতারণা।
হোল্ডিং করের ত্রৈমাসিক কিস্তি বা বার্ষিক পরিমাণ যা-ই নির্ণীত হোক না কেন, এটার পেছনে ফ্ল্যাট-মালিকদের কত টাকা খরচ করতে হয়েছে? প্রথমবার তাঁরা গড়ে তিন হাজার টাকা করে দিয়েছেন, পরে আবার আপিলের জন্য দেড় হাজার টাকা—সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার বেশি উঠেছে ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপসরফা করার জন্য। এটা কি তাহলে কমিয়ে কর ধার্য করার জন্য ঘুষ দেওয়া হলো? যাঁরা এই ঘুষ বা অর্থ দিয়েছেন তাঁরা কমবেশি সবাই এটাকে ঘুষ বললেও এর পক্ষে একটি যুক্তি দিয়েছেন। সেটি এ রকম: যেহেতু ফ্ল্যাট-মালিকদের সবার পক্ষে বারবার ডিসিসিতে গিয়ে কালক্ষেপণ করে বার্ষিক মূল্যায়ন ও হোল্ডিং কর নির্ধারণের কাজটি করা সম্ভব নয়, সেহেতু তাঁরা কিছু অর্থ খরচ করে সময় ও হয়রানি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
তাহলে এই পদ্ধতি অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরা কি ডিসিসি তথা সরকারকে কর ফাঁকি দিলেন না? কেউ কেউ এমনটা মনে করলেও বড় অংশই এ রকম কিছু ভাবতে আগ্রহী নয়। বরং তারা মনে করে, পদ্ধতিটাই এমন দাঁড়িয়েছে যে এর বাইরে কিছু করা খুব কঠিন। যদি ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঠিকভাবে সম্পত্তি মূল্যায়ন করে কর নির্ধারণ করতেন, তাহলে করের পরিমাণ বেশি হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ সরকার ঠিক কর পেত। তার পরও হোল্ডিং কর নির্ধারণের জন্য বাড়তি অর্থ খরচ করতেই হতো। না হলে সময়মতো কাজ হতো না। তার চেয়ে বরং বাড়তি অর্থ খরচ করে কিছুটা কম কর দেওয়াই ভালো।
পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তা হলো কর প্রদান করার অনীহা। যাঁরা এই ফ্ল্যাটগুলোর মালিক হয়েছেন, তাঁরা যেকোনো বিচারে কর প্রদান করার যোগ্য। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন পরিমাণে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাকি অর্থ মিটিয়েছেন নিজেদের আয় থেকে সঞ্চয় ও গ্রামের কোনো জমি বিক্রি করে। কেউ বা তেমন কোনো ঋণ গ্রহণ করেননি; নিজের আয় ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো সম্পত্তি বিক্রি করে ফ্ল্যাট কিনেছেন। যেভাবেই কিনে থাকুন না কেন, তাঁরা টাকাটা জোগাড় করেছেন। আয়তনভেদে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন ফ্ল্যাট কিনতে। তাও দুই বছর আগে। অর্থাৎ এই ফ্ল্যাটগুলোর দাম বেড়ে এখন ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা হয়ে গেছে।
তাহলে যিনি রাজধানী ঢাকা শহরে ৪০-৫০ লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাটে থাকবেন, রাজধানীতে বসবাসের বিভিন্ন সুবিধা নেবেন, তিনি কেন বছরে ১০-১৫ হাজার টাকাও হোল্ডিং কর দিতে চাইবেন না? হয়রানি-দুর্নীতির দোহাই পেড়ে কর ফাঁকি দেওয়ার বা ঘুষ দিয়ে কম কর প্রদানের এই চর্চা কেন বছরের পর বছর চলবে?
এসব ক্ষেত্রে একটা যুক্তি দেওয়া হয় যে ডিসিসির কাছ থেকে ঠিকমতো কোনো সেবা পাওয়া যায় না। মশা-ময়লা থেকে ভাঙা রাস্তাঘাট—সবই এখানে চলে আসে অজুহাত হিসেবে। আরও যুক্তি দেওয়া হয়, যার যত বেশি অর্থ-বিত্ত-বাড়ি-গাড়ি, তাকে তত বেশি সমীহ করে কর ছাড় দেওয়া হয়। এবং তা অবৈধভাবে। খুঁজলে এ রকম আরও অনেক যুক্তি পাওয়া যাবে কর প্রদান করতে আপত্তি জানানোর বা অনীহার পেছনে। কিন্তু, একটু ঠান্ডা মাথায় ও বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিচার-বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এসব যুক্তি দিয়ে কর কমানোর বা ফাঁকির বিষয়টি সমর্থন করা যায় না।
প্রথমত, বছর বছর জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে; বিশেষ করে ঢাকায় যে হারে এই দাম বাড়ছে, সে হারে তো হোল্ডিং কর বাড়ছে না। বরং একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে, তা অন্তত পাঁচ বছর অপরিবর্তিতই থাকছে। আবার যাঁরা এসব ফ্ল্যাটে থাকছেন, তাঁরা মাসে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, সেটাও তো একবার তাঁদের চিন্তা করা উচিত। ফ্ল্যাটের অনেক বাসিন্দাই মাসে মুঠোফোনের জন্য তিন-চার হাজার টাকা বিল দেন। শুধু ঈদের সময়ই লাখ টাকার ওপরে কেনাকাটা করেন। যেহেতু তাঁদের আয় ও সামর্থ্য আছে, তাই এগুলো অবশ্যই তাঁরা করতে পারেন। এই ভোগব্যয় তাঁদের অধিকার। তাহলে ঢাকার বুকে যে বাসস্থানটি তাঁকে প্রতিরাতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটানোর ও আরামে ঘুমানোর সুযোগ করে দিয়েছে, সেটির জন্য বছরে রাষ্ট্রের কোষাগারে ২০ হাজার টাকা দিতে এত অনীহা কেন?
আসলে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে এক আশ্চর্য নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে উঠেছে আমাদের। করের প্রসঙ্গ উঠলে আমরা প্রথমেই চিন্তা করতে চাই যে কর ফাঁকি দিতে হবে। আয়করের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সত্যি। বিভিন্নভাবে আয় করব, যথেচ্ছা ব্যয় করব, কিন্তু রাষ্ট্রকে কর দেব না। এবং এই কর না দেওয়ার জন্য বা ফাঁকি দিয়ে কম কর দেওয়ার জন্য অবৈধভাবে অর্থ খরচ করতেও বুঝি বা দ্বিধা নেই আমাদের। আয়করের ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও হয়রানির কথা বলি আমরা। এগুলো সবই সত্যি। কিন্তু সমর্থ নাগরিক হিসেবে সঠিকভাবে কর দেওয়ার বিষয়টিও আমরা এড়িয়ে যেতে চাই।
আরেকটি সমস্যা হলো, কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও যে নানা সুবিধা আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা ঠিকভাবে জানি না বা জানার চেষ্টা করি না। কর বিভাগ থেকেও এগুলো সম্পর্কে জানানো হয় না। এই যে হোল্ডিং করের কথা বলা হলো, এখানেও ছাড় আছে। মালিক ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিলে যে কর দিতে হবে, নিজে বাস করলে তার চেয়ে কম কর দিতে হবে। আবার ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট ক্রয় করা হলে কর আরও কমবে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের আগে কর পরিশোধ করলে রেয়াত পাওয়া যায়। একইভাবে আয়করের ক্ষেত্রেও কিছুটা ছাড় আছে। যেমন, আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়। এসব ছাড় ও সুবিধার বিষয়গুলো করদাতাদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না বলে অনেকেই নিরুৎসাহিত বোধ করে।
বস্তুত, কর প্রদানের অনীহা থেকে মানুষজনকে বের করে আনতে না পারলে দেশে কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না। আর এই সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বারবার হোঁচট খাবে। কর নিয়ে ভীতি-বিভ্রান্তি আছে। সরকারের দায়িত্ব তা দূর করা। অন্তত কমিয়ে আনা। আর নাগরিকদের দায়িত্ব সঠিকভাবে কর প্রদান করা। অনেকেই বলেন, কর দিলেও তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। এটা সত্যি কথা। তাই বলে কর ফাঁকি দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। জটিলতা-হয়রানির কথা বলে ঘুষ বা সেলামি দিয়ে কর ফাঁকিকে প্রতিষ্ঠিত করার যে চেষ্টা আমরা করে চলেছি, তা তো দুর্নীতি ও অনিয়মকেই উৎসাহিত করছে। শুধু কর বিভাগের লোকজনের ওপর দুর্নীতির দায় চাপিয়ে দিলে এই অবস্থা থেকে কখনোই মুক্তি মিলবে না।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
কিছুদিন পর যখন ফ্ল্যাটের মালিকদের কাছে করের নোটিশ এল, তখন তাঁদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। কারও কারও ত্রৈমাসিক করের কিস্তি এসেছে ৩০০-৪০০ টাকা। কারও বা ১৮০০-১৯০০ টাকা। কেন এই পার্থক্য? জানা গেল, যাঁদের বড় অঙ্কের ঋণ রয়েছে, তাঁদের প্রদেয় কিস্তি কম এসেছে। এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্টি এল না বাকিদের। তাঁরা আপিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আবার নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সমঝোতা হলো। এবার প্রদেয় করের কিস্তি আরেকটু কম নির্ধারণ করা হলো। ফ্ল্যাটের বার্ষিক মূল্যায়ন করে এই কর ও করের কিস্তি নির্ধারিত হয়েছে। প্রথমবার মূল্যায়নে যে মূল্য ধরা হয়েছিল, আপিলের পর তা কিছুটা কমানো হয়েছে।
সম্প্রতি এই ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় কিছু প্রশ্ন জেগেছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণও ধরা পড়েছে। প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতেই এই লেখার অবতারণা।
হোল্ডিং করের ত্রৈমাসিক কিস্তি বা বার্ষিক পরিমাণ যা-ই নির্ণীত হোক না কেন, এটার পেছনে ফ্ল্যাট-মালিকদের কত টাকা খরচ করতে হয়েছে? প্রথমবার তাঁরা গড়ে তিন হাজার টাকা করে দিয়েছেন, পরে আবার আপিলের জন্য দেড় হাজার টাকা—সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার বেশি উঠেছে ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপসরফা করার জন্য। এটা কি তাহলে কমিয়ে কর ধার্য করার জন্য ঘুষ দেওয়া হলো? যাঁরা এই ঘুষ বা অর্থ দিয়েছেন তাঁরা কমবেশি সবাই এটাকে ঘুষ বললেও এর পক্ষে একটি যুক্তি দিয়েছেন। সেটি এ রকম: যেহেতু ফ্ল্যাট-মালিকদের সবার পক্ষে বারবার ডিসিসিতে গিয়ে কালক্ষেপণ করে বার্ষিক মূল্যায়ন ও হোল্ডিং কর নির্ধারণের কাজটি করা সম্ভব নয়, সেহেতু তাঁরা কিছু অর্থ খরচ করে সময় ও হয়রানি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
তাহলে এই পদ্ধতি অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরা কি ডিসিসি তথা সরকারকে কর ফাঁকি দিলেন না? কেউ কেউ এমনটা মনে করলেও বড় অংশই এ রকম কিছু ভাবতে আগ্রহী নয়। বরং তারা মনে করে, পদ্ধতিটাই এমন দাঁড়িয়েছে যে এর বাইরে কিছু করা খুব কঠিন। যদি ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঠিকভাবে সম্পত্তি মূল্যায়ন করে কর নির্ধারণ করতেন, তাহলে করের পরিমাণ বেশি হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ সরকার ঠিক কর পেত। তার পরও হোল্ডিং কর নির্ধারণের জন্য বাড়তি অর্থ খরচ করতেই হতো। না হলে সময়মতো কাজ হতো না। তার চেয়ে বরং বাড়তি অর্থ খরচ করে কিছুটা কম কর দেওয়াই ভালো।
পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তা হলো কর প্রদান করার অনীহা। যাঁরা এই ফ্ল্যাটগুলোর মালিক হয়েছেন, তাঁরা যেকোনো বিচারে কর প্রদান করার যোগ্য। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন পরিমাণে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাকি অর্থ মিটিয়েছেন নিজেদের আয় থেকে সঞ্চয় ও গ্রামের কোনো জমি বিক্রি করে। কেউ বা তেমন কোনো ঋণ গ্রহণ করেননি; নিজের আয় ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো সম্পত্তি বিক্রি করে ফ্ল্যাট কিনেছেন। যেভাবেই কিনে থাকুন না কেন, তাঁরা টাকাটা জোগাড় করেছেন। আয়তনভেদে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন ফ্ল্যাট কিনতে। তাও দুই বছর আগে। অর্থাৎ এই ফ্ল্যাটগুলোর দাম বেড়ে এখন ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা হয়ে গেছে।
তাহলে যিনি রাজধানী ঢাকা শহরে ৪০-৫০ লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাটে থাকবেন, রাজধানীতে বসবাসের বিভিন্ন সুবিধা নেবেন, তিনি কেন বছরে ১০-১৫ হাজার টাকাও হোল্ডিং কর দিতে চাইবেন না? হয়রানি-দুর্নীতির দোহাই পেড়ে কর ফাঁকি দেওয়ার বা ঘুষ দিয়ে কম কর প্রদানের এই চর্চা কেন বছরের পর বছর চলবে?
এসব ক্ষেত্রে একটা যুক্তি দেওয়া হয় যে ডিসিসির কাছ থেকে ঠিকমতো কোনো সেবা পাওয়া যায় না। মশা-ময়লা থেকে ভাঙা রাস্তাঘাট—সবই এখানে চলে আসে অজুহাত হিসেবে। আরও যুক্তি দেওয়া হয়, যার যত বেশি অর্থ-বিত্ত-বাড়ি-গাড়ি, তাকে তত বেশি সমীহ করে কর ছাড় দেওয়া হয়। এবং তা অবৈধভাবে। খুঁজলে এ রকম আরও অনেক যুক্তি পাওয়া যাবে কর প্রদান করতে আপত্তি জানানোর বা অনীহার পেছনে। কিন্তু, একটু ঠান্ডা মাথায় ও বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিচার-বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এসব যুক্তি দিয়ে কর কমানোর বা ফাঁকির বিষয়টি সমর্থন করা যায় না।
প্রথমত, বছর বছর জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে; বিশেষ করে ঢাকায় যে হারে এই দাম বাড়ছে, সে হারে তো হোল্ডিং কর বাড়ছে না। বরং একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে, তা অন্তত পাঁচ বছর অপরিবর্তিতই থাকছে। আবার যাঁরা এসব ফ্ল্যাটে থাকছেন, তাঁরা মাসে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, সেটাও তো একবার তাঁদের চিন্তা করা উচিত। ফ্ল্যাটের অনেক বাসিন্দাই মাসে মুঠোফোনের জন্য তিন-চার হাজার টাকা বিল দেন। শুধু ঈদের সময়ই লাখ টাকার ওপরে কেনাকাটা করেন। যেহেতু তাঁদের আয় ও সামর্থ্য আছে, তাই এগুলো অবশ্যই তাঁরা করতে পারেন। এই ভোগব্যয় তাঁদের অধিকার। তাহলে ঢাকার বুকে যে বাসস্থানটি তাঁকে প্রতিরাতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটানোর ও আরামে ঘুমানোর সুযোগ করে দিয়েছে, সেটির জন্য বছরে রাষ্ট্রের কোষাগারে ২০ হাজার টাকা দিতে এত অনীহা কেন?
আসলে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে এক আশ্চর্য নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে উঠেছে আমাদের। করের প্রসঙ্গ উঠলে আমরা প্রথমেই চিন্তা করতে চাই যে কর ফাঁকি দিতে হবে। আয়করের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সত্যি। বিভিন্নভাবে আয় করব, যথেচ্ছা ব্যয় করব, কিন্তু রাষ্ট্রকে কর দেব না। এবং এই কর না দেওয়ার জন্য বা ফাঁকি দিয়ে কম কর দেওয়ার জন্য অবৈধভাবে অর্থ খরচ করতেও বুঝি বা দ্বিধা নেই আমাদের। আয়করের ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও হয়রানির কথা বলি আমরা। এগুলো সবই সত্যি। কিন্তু সমর্থ নাগরিক হিসেবে সঠিকভাবে কর দেওয়ার বিষয়টিও আমরা এড়িয়ে যেতে চাই।
আরেকটি সমস্যা হলো, কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও যে নানা সুবিধা আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা ঠিকভাবে জানি না বা জানার চেষ্টা করি না। কর বিভাগ থেকেও এগুলো সম্পর্কে জানানো হয় না। এই যে হোল্ডিং করের কথা বলা হলো, এখানেও ছাড় আছে। মালিক ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিলে যে কর দিতে হবে, নিজে বাস করলে তার চেয়ে কম কর দিতে হবে। আবার ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট ক্রয় করা হলে কর আরও কমবে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের আগে কর পরিশোধ করলে রেয়াত পাওয়া যায়। একইভাবে আয়করের ক্ষেত্রেও কিছুটা ছাড় আছে। যেমন, আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়। এসব ছাড় ও সুবিধার বিষয়গুলো করদাতাদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না বলে অনেকেই নিরুৎসাহিত বোধ করে।
বস্তুত, কর প্রদানের অনীহা থেকে মানুষজনকে বের করে আনতে না পারলে দেশে কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না। আর এই সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বারবার হোঁচট খাবে। কর নিয়ে ভীতি-বিভ্রান্তি আছে। সরকারের দায়িত্ব তা দূর করা। অন্তত কমিয়ে আনা। আর নাগরিকদের দায়িত্ব সঠিকভাবে কর প্রদান করা। অনেকেই বলেন, কর দিলেও তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। এটা সত্যি কথা। তাই বলে কর ফাঁকি দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। জটিলতা-হয়রানির কথা বলে ঘুষ বা সেলামি দিয়ে কর ফাঁকিকে প্রতিষ্ঠিত করার যে চেষ্টা আমরা করে চলেছি, তা তো দুর্নীতি ও অনিয়মকেই উৎসাহিত করছে। শুধু কর বিভাগের লোকজনের ওপর দুর্নীতির দায় চাপিয়ে দিলে এই অবস্থা থেকে কখনোই মুক্তি মিলবে না।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments