কালের পুরাণ-ভোলা যেন আরেকটি মাগুরা না হয় by সোহরাব হাসান
দেখতে দেখতে আওয়ামী লীগ ওরফে মহাজোট সরকারের মেয়াদ ১৫ মাস পার হলো। বিরোধী দল এখনো পর্যন্ত দৃশ্যগ্রাহ্য কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও মাঠে-ময়দানে রণহুংকার দিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের মহাসমাবেশে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচির আগাম ঘোষণা দিয়ে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
তাঁর ভাষায় সেটি ছিল ‘স্টেজ রিহার্সাল’। আগামী ১৭ মে ঢাকার মহাসমাবেশে আন্দোলনের কর্মসূচি আসবে।
কী হবে বিএনপির সেই কঠোর কর্মসূচি? তারা কি এখনই সরকার উত্খাতের আন্দোলনে নামবে? নামলে ওই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিই বা কী হবে? বিএনপি ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মাথায় আওয়ামী লীগ প্রথম হরতাল করেছিল। বিএনপিও কি হরতাল-অবরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে? এক-এগারোর পর দেশবাসী ভেবেছিল, হরতালের যুগ শেষ হয়েছে। গত তিন বছর দেশ হরতাল নামের ভয়াবহ উপসর্গটি থেকে মুক্ত ছিল। আবার হরতালে দেশ অচল হোক তা কেউ চায় না। সরকারের অগণতান্ত্রিক কাজকর্মের প্রতিবাদ জানানোর বিকল্প পথ ও ভাষা আছে। সংসদ আছে। সংসদীয় ব্যবস্থা সচল থাকলে হরতাল-অবরোধের প্রয়োজন হয় না। আশা করি বিএনপি এমন কিছু করবে না, যাতে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। হরতাল-অবরোধে সরকারের পতন ঘটে না, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, সাধারণ মানুষ কষ্ট পায়।
দুই.
সাম্প্রতিক কালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাগ্যুদ্ধটা বেশ জমে উঠেছে। যেকোনো বিষয়ে নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দেখে নেওয়ার ও দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। বিতর্কের শুরু সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার বাড়ির লিজ বাতিল নিয়ে (বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের এসএসএফ-সুবিধা ও ঢাকা শহরে তাঁদের থাকার জন্য উপযুক্ত বাড়ি বরাদ্দের আইন করে ইতিমধ্যে এর নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে সরকার)। তারপর মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বিতর্ক। তারপর নামবদল বিতর্ক। সবশেষে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিতর্ক। একটি ভালো উদ্যোগেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একমত হতে না পারা দুঃখজনক। বিএনপির নেতারা বলেছেন, বিচারের নামে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। বিচার মানবতাবিরোধী হলে প্রতিরোধ করা হবে। কী মানবদরদি তাঁরা! যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিরোধ না করে বিচারকে প্রতিরোধ করবেন। মহামান্যদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, একাত্তরে যখন রাজাকার-আলবদররা নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল, মা-বোনদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তখন কোথায় ছিলেন? সরকারের বেআইনি কাজের প্রতিবাদ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরেধিতা এক কথা নয়। এর মাধ্যমে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকেই চ্যালেঞ্জ করলেন না, স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া শহীদদেরও অপমান করলেন। হায় রে অন্ধ ও সংকীর্ণ রাজনীতি! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বিএনপি এতদিনকার ঢাক-গুড়গুড় ভাব কাটিয়ে জামায়াতিদের সঙ্গে হাত মেলাল আইনজীবীদের মঞ্চে। ফলে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি ফারাক করাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে জামায়াত লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি।
তিন.
ক্ষমতায় থাকতে সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে ঢালাও অভিযোগ করতেন, বিএনপির নেতারা এখন তা-ই করছেন। আবার সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি যেমন সব দুর্গতির জন্য পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের সরকারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাত, বর্তমান সরকারও একই কাজ করছে। আজ বিএনপির নেতারা সরকারকে হামলাবাজ-মামলাবাজ বলে অভিযুক্ত করছেন। তাঁদের আমলে কি হামলা-মামলা কম হয়েছিল? কথায় বলে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আর আমাদের রাজনীতিকেরা জনদরদি হন ক্ষমতা হারালে। দেশে ভয়াবহ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট চলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, আমজনতার জীবন নিরাপত্তাহীন। এসব নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়নি। আলোচনা হয়েছে অতীত নিয়ে, সেখানে বর্তমান অনুপস্থিত। গণতন্ত্র মানে কি সংসদে নেতা-নেত্রীদের আসন বদল? বিএনপির আমলে একদল মৌ-লোভী হাওয়া ভবনের আশপাশে ঘুরঘুর করত, এখন আওয়ামী লীগের আমলে আরেক দল সুযোগসন্ধানী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আনাগোনা করছে। আবার আরেক দল সুবিধাবাদী আছে, যারা তলারটাও খায়, গাছেরটাও কুড়ায়। সব আমলে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ লাভে মুখিয়ে থাকে। রাজনীতিতে যখন নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ বলে কিছু থাকে না, তখনই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সুবিধাবাদী ও চরিত্রহীন রাজনীতি আমরা দেখে আসছি ৩৯ বছর ধরে।
চার.
ভোলা-৩ উপনির্বাচনের তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বী তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঝগড়াটা দ্বীপ জেলার সীমা ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। নির্বাচনী এলাকায় প্রায় প্রতিদিন ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এই বলে সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে নির্বাচনে কারচুপি হলে তাঁরা সরকার উত্খাতের আন্দোলন শুরু করবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই বিএনপি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে উত্খাতের আওয়াজ, অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। ভোটের লড়াই এখন দুই দলের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। জনগণ অসহায়। তারা কোন দিকে যাবে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোলার উপনির্বাচনকে নিয়েছে মর্যাদার লড়াই হিসেবে। আওয়ামী লীগ তাদের জয়ী আসনটি কোনোভাবে হাতছাড়া করতে চায় না। বিএনপি মনে করে, এলাকাটি তাদের শক্ত ঘাঁটি। ২০০৮ সালের আগে পাঁচটি নির্বাচনেই তাদের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। অতএব এবারও জয়ী হবেন। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানই এলাকায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, জনজীবনে শংকা বাড়াচ্ছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই দলই মাঠ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে এবং যার যেখানে শক্ত অবস্থান, সেখানে প্রতিপক্ষকে বাধা দিচ্ছে, হামলা করছে। আমাদের দেশে নির্বাচন মানে কর্মী-ক্যাডারদের পেশিশক্তি প্রদর্শন, নেতাদের প্রতিশ্রুতির লম্বা তালিকা এবং আমজনতার উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা। ভোলার ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। কারা হামলা করছে, কেন করছে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, উপনির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে তো? ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে তো? নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা কাউকে ছাড় দেবে না, মাস্তানি বরদাশত করবে না। কমিশনার ছহুল হোসাইন এলাকায় গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর আশ্বাসে ভোলাবাসী কতটা আশ্বস্ত হবে, তা দেখার জন্য আমাদের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, গণতন্ত্র যেন পরাজিত না হয়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাই মুখ্য। নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশও তাঁরা তামিল করবেন। সমস্যাটা হলো, ক্ষমতাসীনেরা বরাবর সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাবার জমিদারির রায়ত ভাবে, তাদের কথা শুনতে হবে।
এ অবস্থায় সরকারের করণীয় কী? তারা কি দলীয় কর্মী-ক্যাডারদের মাস্তানিকে প্রশ্রয় দেবে? না প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যাতে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে ব্যবস্থা করবে? সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশনও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। তারা নির্বাচন বাতিল করতে পারে, স্থগিত করতে পারে।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি যে ভুল মাগুরায় করেছিল, আওয়ামী লীগ সরকারও কি ভোলায় একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে? না তারা পূর্বসূরির ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করবে? তাদের বুঝতে হবে, এটি একটি আসনের উপনির্বাচন। এতে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হলে সরকারের পতন ঘটবে না। কিন্তু জোর করে আসনটি নিতে চাইলে সরকারের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হবে, তা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। আমরা ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনের কথা স্মরণ করতে পারি। সেই নির্বাচনের ফলাফল জোর করে পক্ষে না নিলে বিএনপির কী ক্ষতি হতো? তারা একটি আসন হারাত মাত্র। কিন্তু রায় নিজেদের পক্ষে নিতে গিয়ে মাগুরাকে যে গুঁড়া গুঁড়া করে ফেলেছিল, এর পর থেকেই বিএনপি সরকারের বিদায়ঘণ্টা বেজেছিল। এবার আওয়ামী লীগ অনেক বেশি শক্তিশালী। সংসদে তাদের আসনসংখ্যা তিন-চতুর্থাংশের বেশি। ভোলার আসনটি হারালে তাদের কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু আসনটি জোরজবরদস্তি করে নিতে চাইলে তার ফল সরকারের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করলে তারা সে বিজয় ফিরিয়ে দেবে।
দেশবাসীর প্রত্যাশা, সরকার নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সিভিল প্রশাসনও ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে, কারও প্রতি পক্ষপাত দেখাবে না। দেখালে কী হবে? বিএনপির হাতে মোক্ষম অস্ত্রটি তুলে দেওয়া হবে। তারা বলার সুযোগ পাবে, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়, এদের কাছে নির্বাচন নিরাপদ নয়, ভোটাররা নিরাপদ নয়, দেশ-গণতন্ত্র কিছুই নিরাপদ নয়। আর খালেদা জিয়া তো আন্দোলনের আগাম ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন।
এখন সরকারকেই ঠিক করতে হবে, তারা আরেকটি মাগুরা চায়, না অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে ভোলায় নব ইতিহাস গড়তে আগ্রহী?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
কী হবে বিএনপির সেই কঠোর কর্মসূচি? তারা কি এখনই সরকার উত্খাতের আন্দোলনে নামবে? নামলে ওই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিই বা কী হবে? বিএনপি ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মাথায় আওয়ামী লীগ প্রথম হরতাল করেছিল। বিএনপিও কি হরতাল-অবরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে? এক-এগারোর পর দেশবাসী ভেবেছিল, হরতালের যুগ শেষ হয়েছে। গত তিন বছর দেশ হরতাল নামের ভয়াবহ উপসর্গটি থেকে মুক্ত ছিল। আবার হরতালে দেশ অচল হোক তা কেউ চায় না। সরকারের অগণতান্ত্রিক কাজকর্মের প্রতিবাদ জানানোর বিকল্প পথ ও ভাষা আছে। সংসদ আছে। সংসদীয় ব্যবস্থা সচল থাকলে হরতাল-অবরোধের প্রয়োজন হয় না। আশা করি বিএনপি এমন কিছু করবে না, যাতে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। হরতাল-অবরোধে সরকারের পতন ঘটে না, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, সাধারণ মানুষ কষ্ট পায়।
দুই.
সাম্প্রতিক কালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাগ্যুদ্ধটা বেশ জমে উঠেছে। যেকোনো বিষয়ে নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দেখে নেওয়ার ও দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। বিতর্কের শুরু সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার বাড়ির লিজ বাতিল নিয়ে (বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের এসএসএফ-সুবিধা ও ঢাকা শহরে তাঁদের থাকার জন্য উপযুক্ত বাড়ি বরাদ্দের আইন করে ইতিমধ্যে এর নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে সরকার)। তারপর মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বিতর্ক। তারপর নামবদল বিতর্ক। সবশেষে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিতর্ক। একটি ভালো উদ্যোগেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একমত হতে না পারা দুঃখজনক। বিএনপির নেতারা বলেছেন, বিচারের নামে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। বিচার মানবতাবিরোধী হলে প্রতিরোধ করা হবে। কী মানবদরদি তাঁরা! যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিরোধ না করে বিচারকে প্রতিরোধ করবেন। মহামান্যদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, একাত্তরে যখন রাজাকার-আলবদররা নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল, মা-বোনদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তখন কোথায় ছিলেন? সরকারের বেআইনি কাজের প্রতিবাদ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরেধিতা এক কথা নয়। এর মাধ্যমে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকেই চ্যালেঞ্জ করলেন না, স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া শহীদদেরও অপমান করলেন। হায় রে অন্ধ ও সংকীর্ণ রাজনীতি! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বিএনপি এতদিনকার ঢাক-গুড়গুড় ভাব কাটিয়ে জামায়াতিদের সঙ্গে হাত মেলাল আইনজীবীদের মঞ্চে। ফলে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি ফারাক করাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে জামায়াত লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি।
তিন.
ক্ষমতায় থাকতে সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে ঢালাও অভিযোগ করতেন, বিএনপির নেতারা এখন তা-ই করছেন। আবার সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি যেমন সব দুর্গতির জন্য পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের সরকারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাত, বর্তমান সরকারও একই কাজ করছে। আজ বিএনপির নেতারা সরকারকে হামলাবাজ-মামলাবাজ বলে অভিযুক্ত করছেন। তাঁদের আমলে কি হামলা-মামলা কম হয়েছিল? কথায় বলে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আর আমাদের রাজনীতিকেরা জনদরদি হন ক্ষমতা হারালে। দেশে ভয়াবহ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট চলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, আমজনতার জীবন নিরাপত্তাহীন। এসব নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়নি। আলোচনা হয়েছে অতীত নিয়ে, সেখানে বর্তমান অনুপস্থিত। গণতন্ত্র মানে কি সংসদে নেতা-নেত্রীদের আসন বদল? বিএনপির আমলে একদল মৌ-লোভী হাওয়া ভবনের আশপাশে ঘুরঘুর করত, এখন আওয়ামী লীগের আমলে আরেক দল সুযোগসন্ধানী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আনাগোনা করছে। আবার আরেক দল সুবিধাবাদী আছে, যারা তলারটাও খায়, গাছেরটাও কুড়ায়। সব আমলে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ লাভে মুখিয়ে থাকে। রাজনীতিতে যখন নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ বলে কিছু থাকে না, তখনই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সুবিধাবাদী ও চরিত্রহীন রাজনীতি আমরা দেখে আসছি ৩৯ বছর ধরে।
চার.
ভোলা-৩ উপনির্বাচনের তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বী তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঝগড়াটা দ্বীপ জেলার সীমা ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। নির্বাচনী এলাকায় প্রায় প্রতিদিন ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এই বলে সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে নির্বাচনে কারচুপি হলে তাঁরা সরকার উত্খাতের আন্দোলন শুরু করবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই বিএনপি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে উত্খাতের আওয়াজ, অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। ভোটের লড়াই এখন দুই দলের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। জনগণ অসহায়। তারা কোন দিকে যাবে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোলার উপনির্বাচনকে নিয়েছে মর্যাদার লড়াই হিসেবে। আওয়ামী লীগ তাদের জয়ী আসনটি কোনোভাবে হাতছাড়া করতে চায় না। বিএনপি মনে করে, এলাকাটি তাদের শক্ত ঘাঁটি। ২০০৮ সালের আগে পাঁচটি নির্বাচনেই তাদের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। অতএব এবারও জয়ী হবেন। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানই এলাকায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, জনজীবনে শংকা বাড়াচ্ছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই দলই মাঠ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে এবং যার যেখানে শক্ত অবস্থান, সেখানে প্রতিপক্ষকে বাধা দিচ্ছে, হামলা করছে। আমাদের দেশে নির্বাচন মানে কর্মী-ক্যাডারদের পেশিশক্তি প্রদর্শন, নেতাদের প্রতিশ্রুতির লম্বা তালিকা এবং আমজনতার উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা। ভোলার ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। কারা হামলা করছে, কেন করছে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, উপনির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে তো? ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে তো? নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা কাউকে ছাড় দেবে না, মাস্তানি বরদাশত করবে না। কমিশনার ছহুল হোসাইন এলাকায় গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর আশ্বাসে ভোলাবাসী কতটা আশ্বস্ত হবে, তা দেখার জন্য আমাদের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, গণতন্ত্র যেন পরাজিত না হয়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাই মুখ্য। নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশও তাঁরা তামিল করবেন। সমস্যাটা হলো, ক্ষমতাসীনেরা বরাবর সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাবার জমিদারির রায়ত ভাবে, তাদের কথা শুনতে হবে।
এ অবস্থায় সরকারের করণীয় কী? তারা কি দলীয় কর্মী-ক্যাডারদের মাস্তানিকে প্রশ্রয় দেবে? না প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যাতে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে ব্যবস্থা করবে? সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশনও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। তারা নির্বাচন বাতিল করতে পারে, স্থগিত করতে পারে।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি যে ভুল মাগুরায় করেছিল, আওয়ামী লীগ সরকারও কি ভোলায় একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে? না তারা পূর্বসূরির ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করবে? তাদের বুঝতে হবে, এটি একটি আসনের উপনির্বাচন। এতে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হলে সরকারের পতন ঘটবে না। কিন্তু জোর করে আসনটি নিতে চাইলে সরকারের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হবে, তা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। আমরা ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনের কথা স্মরণ করতে পারি। সেই নির্বাচনের ফলাফল জোর করে পক্ষে না নিলে বিএনপির কী ক্ষতি হতো? তারা একটি আসন হারাত মাত্র। কিন্তু রায় নিজেদের পক্ষে নিতে গিয়ে মাগুরাকে যে গুঁড়া গুঁড়া করে ফেলেছিল, এর পর থেকেই বিএনপি সরকারের বিদায়ঘণ্টা বেজেছিল। এবার আওয়ামী লীগ অনেক বেশি শক্তিশালী। সংসদে তাদের আসনসংখ্যা তিন-চতুর্থাংশের বেশি। ভোলার আসনটি হারালে তাদের কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু আসনটি জোরজবরদস্তি করে নিতে চাইলে তার ফল সরকারের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করলে তারা সে বিজয় ফিরিয়ে দেবে।
দেশবাসীর প্রত্যাশা, সরকার নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সিভিল প্রশাসনও ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে, কারও প্রতি পক্ষপাত দেখাবে না। দেখালে কী হবে? বিএনপির হাতে মোক্ষম অস্ত্রটি তুলে দেওয়া হবে। তারা বলার সুযোগ পাবে, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়, এদের কাছে নির্বাচন নিরাপদ নয়, ভোটাররা নিরাপদ নয়, দেশ-গণতন্ত্র কিছুই নিরাপদ নয়। আর খালেদা জিয়া তো আন্দোলনের আগাম ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন।
এখন সরকারকেই ঠিক করতে হবে, তারা আরেকটি মাগুরা চায়, না অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে ভোলায় নব ইতিহাস গড়তে আগ্রহী?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments