বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৯৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।মো. আবদুল্লাহ, বীর প্রতীক দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ১২ অক্টোবর ১৯৭১। খুব সকালে কাদেরিয়া বাহিনীর সামরিক প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) খবর পেলেন, নাগরপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগীদের জন্য টাঙ্গাইল থেকে রসদ ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয়েছে।
সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এলাসিন-নাগরপুর সড়ক দিয়ে। গরুর গাড়িতে করে। পাহারায় আছে তাদের সহযোগী মিলিশিয়া ও রাজাকার। তখন ওই এলাকায় কাছাকাছি ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ২৮-২৯ জন সহযোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে মো. আবদুল্লাহ দুর্ধর্ষ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যামবুশ করার। মো. আবদুল্লাহসহ ২০ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে তিনি দ্রুত রওনা হলেন। অ্যামবুশ করলেন সড়কে।
সকাল আনুমানিক আটটা বা সোয়া আটটা। এমন সময় তাঁরা দেখতে পেলেন পাঁচ-ছয়টি গরুর গাড়ি ও চার-পাঁচটি রিকশা। সেগুলোতে মালামাল ভরা। মিলিশিয়া-রাজাকার প্রায় ৩০-৩৫ জন। কয়েকজন আগে-পিছে হেঁটে আসছে। বাকিরা গরুর গাড়ি ও রিকশায় বসে। তারা বুঝতেও পারল না। নিশ্চিন্ত মনে আসছে। অস্ত্রের আওতায় আসা মাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা সবার অস্ত্র। আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব মিলিশিয়া ও রাজাকার। বিশেষত মো. আবদুল্লাহর দুঃসাহসিকতায় তারা প্রতিরোধের সুযোগই পেল না। নিহত হলো তিনজন রাজাকার। আহত ১১ জন। বাকিরা আত্মসমর্পণ করল। এ ঘটনা এলাসিনে। এর অবস্থান টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে দক্ষিণে। মানিকগঞ্জ জেলা সীমান্তে।
মো. আবদুল্লাহ ১৯৭১ সালে তৎকালীন মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। কর্মরত ছিলেন টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজার শাখায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে তিনি কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নিজ দলে ছিলেন তিনি। মো. আবদুল্লাহ অনেক যুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে বাসাইলের নথখোলা, ঘাটাইল, নাগরপুর, মীর্জাপুরের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গার রাজবাড়ির যুদ্ধে তিনি আহত হন। তাঁর বাঁ পায়ে মর্টার শেলের স্প্ল্লিন্টারের আঘাত লাগে। মো. আবদুল্লাহর সাহসিকতার বর্ণনা আছে সুনীল কুমার গুহের বইয়ে। তিনি লিখেছেন:
‘কাদেরিয়া বাহিনীর কর্মকাণ্ডের গল্প কাদের এবং ওই বাহিনীর অন্যান্য বহু ছেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে থাকাকালেই, আমি একদিন কাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিলাম যে, সে তার লড়াইয়ে সঙ্গীদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং অসম সাহসী যোদ্ধা মনে করে?
‘প্রশ্নটির সোজা উত্তর না দিয়ে, সে আমাকে বলেছিল, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা একজন-দুজন নয়, বহু ছিল। তাদের মধ্যে কে যে দুর্ধর্ষ তা বলা মোটেই সহজ হবে না।...আবার সবচেয়ে সাহসী ছেলে যে কে, তাও যদি জিজ্ঞেস করেন, তারও উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সহজ হবে না। অসম সাহসী ছেলেও দেখেছি অসংখ্য। তবুও একটি ছেলের কথা আমি আপনাকে বলতে পারি। যাকে আমি শুধু অসম সাহসীই মনে করি না, স্রেফ ভয় বিষয়ে বোধশক্তিহীন বলেই মনে করি। যাকে আপনি আবদুল্লাহ নামেই চেনেন। তারপর কাদের আবদুল্লাহর অতি অদ্ভুত যুদ্ধকর্মের আর সেই সঙ্গে তার ভয় বিষয়ে বোধহীনতার বিষয়েও কয়েকটি গল্প আমাকে শুনিয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪১৭।
মো. আবদুল্লাহর পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার তামাট গ্রামে। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে থাকেন। গাভি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল কাদের মিয়া। মা হামিদা বেগম। স্ত্রী লিলি আক্তার। তাদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখিপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর বাঘা সিদ্দিকী , সুনীল কুমার গুহ (প্রকাশকাল ১৯৭৩, টাঙ্গাইল) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
সকাল আনুমানিক আটটা বা সোয়া আটটা। এমন সময় তাঁরা দেখতে পেলেন পাঁচ-ছয়টি গরুর গাড়ি ও চার-পাঁচটি রিকশা। সেগুলোতে মালামাল ভরা। মিলিশিয়া-রাজাকার প্রায় ৩০-৩৫ জন। কয়েকজন আগে-পিছে হেঁটে আসছে। বাকিরা গরুর গাড়ি ও রিকশায় বসে। তারা বুঝতেও পারল না। নিশ্চিন্ত মনে আসছে। অস্ত্রের আওতায় আসা মাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা সবার অস্ত্র। আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব মিলিশিয়া ও রাজাকার। বিশেষত মো. আবদুল্লাহর দুঃসাহসিকতায় তারা প্রতিরোধের সুযোগই পেল না। নিহত হলো তিনজন রাজাকার। আহত ১১ জন। বাকিরা আত্মসমর্পণ করল। এ ঘটনা এলাসিনে। এর অবস্থান টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে দক্ষিণে। মানিকগঞ্জ জেলা সীমান্তে।
মো. আবদুল্লাহ ১৯৭১ সালে তৎকালীন মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। কর্মরত ছিলেন টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজার শাখায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে তিনি কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নিজ দলে ছিলেন তিনি। মো. আবদুল্লাহ অনেক যুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে বাসাইলের নথখোলা, ঘাটাইল, নাগরপুর, মীর্জাপুরের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গার রাজবাড়ির যুদ্ধে তিনি আহত হন। তাঁর বাঁ পায়ে মর্টার শেলের স্প্ল্লিন্টারের আঘাত লাগে। মো. আবদুল্লাহর সাহসিকতার বর্ণনা আছে সুনীল কুমার গুহের বইয়ে। তিনি লিখেছেন:
‘কাদেরিয়া বাহিনীর কর্মকাণ্ডের গল্প কাদের এবং ওই বাহিনীর অন্যান্য বহু ছেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে থাকাকালেই, আমি একদিন কাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিলাম যে, সে তার লড়াইয়ে সঙ্গীদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং অসম সাহসী যোদ্ধা মনে করে?
‘প্রশ্নটির সোজা উত্তর না দিয়ে, সে আমাকে বলেছিল, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা একজন-দুজন নয়, বহু ছিল। তাদের মধ্যে কে যে দুর্ধর্ষ তা বলা মোটেই সহজ হবে না।...আবার সবচেয়ে সাহসী ছেলে যে কে, তাও যদি জিজ্ঞেস করেন, তারও উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সহজ হবে না। অসম সাহসী ছেলেও দেখেছি অসংখ্য। তবুও একটি ছেলের কথা আমি আপনাকে বলতে পারি। যাকে আমি শুধু অসম সাহসীই মনে করি না, স্রেফ ভয় বিষয়ে বোধশক্তিহীন বলেই মনে করি। যাকে আপনি আবদুল্লাহ নামেই চেনেন। তারপর কাদের আবদুল্লাহর অতি অদ্ভুত যুদ্ধকর্মের আর সেই সঙ্গে তার ভয় বিষয়ে বোধহীনতার বিষয়েও কয়েকটি গল্প আমাকে শুনিয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪১৭।
মো. আবদুল্লাহর পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার তামাট গ্রামে। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে থাকেন। গাভি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল কাদের মিয়া। মা হামিদা বেগম। স্ত্রী লিলি আক্তার। তাদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখিপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর বাঘা সিদ্দিকী , সুনীল কুমার গুহ (প্রকাশকাল ১৯৭৩, টাঙ্গাইল) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments