বিটি বেগুন বিতর্ক-বেগুন রাখবেন নাকি ব্রিঞ্জাল খাবেন! by ফরিদা আখতার
বেগুন সবাই পছন্দ করে। এটা শুধু রুচির ব্যাপার নয়। প্রাণবৈচিত্র্যের এই দেশে আরও বহু প্রজাতি ও জাতের মতো বেগুনেরও উদ্ভব এই দেশে। এ কারণে বেগুন ছাড়া আমাদের খাদ্য-ব্যবস্থার কথা ভাবা যায় না। কিন্তু বেগুন আর বিটি-ব্রিঞ্জাল এক কথা নয়।
বিটি-ব্রিঞ্জালের বিপরীতে বাংলাদেশের বেগুন রক্ষা—অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাণ, প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার কথা তুলেছি। কিন্তু মনে হচ্ছে, বিতর্কটা হয়ে যাচ্ছে টেকনোলজির তর্ক। বিজ্ঞান বা টেকনোলজি এমন কোনো বিষয় নয়, যা পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে ঐশ্বরিক কিছু একটা ব্যাপার। মানতেই হবে যে এখনকার বিজ্ঞানের চরিত্রে করপোরেট মুনাফার স্বার্থই প্রকট। অতএব সত্যিকারের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর কাজ হচ্ছে করপোরেট বিজ্ঞানকে কঠোর পর্যালোচনার অধীনে আনার বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা অর্জন করা। সম্প্রতি বিটি-ব্রিঞ্জাল নিয়ে আমি প্রথম আলোয় যে লেখা লিখেছি, সেই লেখার বিপক্ষে যাঁরা কলম ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে এই ন্যূনতম সতর্কতা থাকলে সব পক্ষেরই মঙ্গল হতো।
আমাদের বিশেষ উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বিটি-ব্রিঞ্জাল করলে দেশীয় বেগুনের বিচিত্র জাতের উৎপাদন এবং বৈচিত্র্য থাকবে কি না, আমরা আমাদের কৌলিক সম্পদ (genetic resources) হারাব কি না, কৃষক বেগুন উৎপাদন করবে, নাকি বেগুনের বীজ বা জাত কোম্পানির হাতে চলে যাবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একে বিজ্ঞান জ্ঞান করে বিজ্ঞানীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
ফলে যাঁরা আমার সঙ্গে মতভেদ প্রকাশ করছেন, তাঁরা সবাই বৈজ্ঞানিক কারণে করছেন—এটা মনে করার কারণ নেই। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির প্রতি তাঁদের পক্ষপাত থাকতেই পারে। কিন্তু বিজ্ঞান ও টেকনোলজি সম্পর্কে আমাদের অগভীর দৃষ্টির কারণে তাঁরা সমালোচনাকে নিজের স্বার্থের দিক থেকে ব্যাখ্যা করেন। ‘আমাদের অতি প্রিয় বেগুনকে দূষিত করবেন না’ (প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০) লেখার পর যাঁরা আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন (অন্তত যাঁরা কষ্ট করে পত্রিকায়ও লিখেছেন), তাঁরা দুজনই বায়োটেকনোলজির পক্ষের মানুষ। তাঁরা বেগুনের পক্ষের কি না, সেটা তাঁদের লেখা থেকে আমি ধরতে পারিনি। এদেরই মতো আরও দু-একজন আমার একই বিষয়ে আরেকটি ইংরেজিতে লেখা bdnews24.com-এ ছাপা হওয়ার পর এত রেগে গেছেন যে আমাকে রীতিমতো তিরস্কার করে বলেছেন, আমি যেন নিজেকে জিএম সম্পর্কে সবজান্তা না ভাবি এবং লেখার আগে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে নিই। ধন্যবাদ। তাঁদের অবগতির জন্য বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, প্রচুর বৈজ্ঞানিক লেখা পড়ে এবং বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার কথা জেনে এবং সর্বোপরি আমাদের দেশের কৃষকের সঙ্গে কথা বলেই আমি আগে লিখেছি এবং এখনো লিখছি। আমার লেখার প্রতিটি বাক্য প্রমাণ করার মতো তথ্য আমার হাতে আছে। আমার জানার ত্রুটি থাকলে অবশ্যই মেনে নেব, কিন্তু তাই বলে বেগুনকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিজস্ব নানা প্রকার বা নানা জাতের বেগুনকে হাতছাড়া হতে দেব না।
বিটি বেগুনের বিষয়টি শুধুই বায়োটেকনোলজির নয়, এর সঙ্গে কৃষি, পরিবেশ, স্বার্থ ও সংস্কৃতি—অনেক কিছু জড়িত রয়েছে। আশ্চর্য হলাম যে আমাদের দেশের কোনো রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতির ধারক-বাহক কিংবা কৃষি, পরিবেশবিদ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কেউই যেন খাদ্য উৎপাদনে বায়োটেকনোলজির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেন না। এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, আধুনিক কৃষিতে উচ্চ ফলনশীলতার দাবি করলেও তার সঙ্গেই উচ্চ মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং একই সঙ্গে মাটির তলার পানি তুলে সেচের ব্যবস্থা করে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের যে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে, তা নিয়ে আমাকে নতুন কোনো তথ্য দিতে হবে না। স্বয়ং বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও সেই তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ব্যাপারে আর তত উৎসাহী নয়। তারা এখন কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর জন্য আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে।
আমাদের নিজেদের ভাবতে হবে, এ দেশের কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা—সবকিছুই যেখানে জড়িত, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাব? ক্ষতিকর টেকনোলজি ও করপোরেট বিজ্ঞানের কথা বলার অর্থ বিজ্ঞান বিরোধিতা নয়। বরং প্রাণবিজ্ঞানে যে বিপুল বিপ্লব ঘটেছে, তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে আমরা কৃষিতে ফলন বাড়াতে পারি, যাকে জাতিসংঘ বলছে প্রাণব্যবস্থাপনা-কেন্দ্রিক কৃষি (ecosystem approach to agriculture)। সেদিক থেকে বাংলাদেশের কৃষকেরা বহু ক্ষেত্রে এগিয়েও গেছেন।
তবে আশার কথা, সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা রয়েছে এবং তাই সমর্থনও পেয়েছি প্রচুর। কেউ উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন, আসলেই এ দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলকে নষ্ট হতে দিতে দেওয়া যায় না, যার উৎসস্থল এই দেশ। টাঙ্গাইলের গজিয়াবাড়ী গ্রামের কৃষক আক্কাস আলী আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আপা, আমি তো বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে গান লিখছি।’ আক্কাস ভাইয়ের গানের একটি অন্তরা তুলে ধরছি:
বিটি ব্রিঞ্জাল প্রণালি
ছিদ্র করে পোকার পুষ্টিনালি
গাছ ও বীজ বিষের থলি
পরিবেশ ধ্বংসে নাই সমাধান।
মনসান্তোর টেকনোলজি
বাংলাদেশ করবে শ্মশান।
এবার পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য তুলে ধরছি। বিটি-ব্রিঞ্জাল নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে ভারতে, ২০০০ সাল থেকে মেসার্স মাহায়কো (মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিডস কোম্পানি)। তারা পাঁচটি হাইব্রিড বেগুনের ওপর ১১টি স্থানে গবেষণা চালায়। গবেষণাধীন বিটি বেগুনগুলো হচ্ছে MHB-4 Bt Brinjal, MHB-9 Bt Brinjal, MHB-10 Bt Brinjal, MHB-80 Bt Brinjal এবং MHB-99 Bt Brinjal। মাহায়কো এই প্রযুক্তি নিয়েছে মনসান্তোর কাছ থেকে এবং বাংলাদেশে এসেছে ইউএসএইডের প্রকল্প Agricultural Biotechnology Support Project II (ABSPII) মাধ্যমে। মাহায়কো বিটি বেগুনের ওপর গবেষণা করে তাদের পক্ষে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেগুলো আমার কাছে আছে। তবে আমি এ লেখার জন্য Bt Brinjal A Briefing Paper : Centre for Sustainable Agriculture, June 2006 থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করছি। প্রথমত, ভারতে বিটি বেগুনের পক্ষে কোম্পানি যে যুক্তি ব্যবহার করেছে তা হচ্ছে, গত দুই দশকে বেগুনের ফলনের ক্ষেত্রে সুট অ্যান্ড ফ্রুট বোরার অর্থাৎ গাছের কাণ্ড এবং ফলে পোকা লাগার কারণে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ফলন কমেছে এবং এর ফলে ২২ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। কাজেই বিটি-ব্রিঞ্জাল সেই পরিপ্রেক্ষিতে পোকা দমনের পদ্ধতি হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলনের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছে। কাজেই বেগুনের ওপর বায়োটেকনোলজির ব্যবহার সরাসরি ফলন বৃদ্ধির কোনো প্রযুক্তি নয়, বরং পোকা যেন না লাগে এবং পোকা লাগার কারণে ফলনের যে ক্ষতি হয়, তা নিরসনের চেষ্টা।
মাহায়কো কোম্পানি নিজস্ব কিছু গবেষণা করেছে বিটি বেগুন ও সাধারণ বেগুনের মধ্যে। গাছের কাণ্ডের ক্ষতি বিটি বেগুনে ০.০৪ থেকে ০.৩ শতাংশ আর সাধারণ বেগুনে ০.১২ থেকে ২.৫ শতাংশ; ফলের ক্ষেত্রে বিটি বেগুনে ক্ষতি হয়েছে ২.৫ থেকে ২০ শতাংশ আর সাধারণ বেগুনে ২৪ থেকে ৫৮ শতাংশ। গাছের কাণ্ড ও ফল উভয় ক্ষেত্রেই একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে বিটি প্রযুক্তি পোকা লাগার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে দমন করতে সক্ষম নয়। ক্ষতি কম হলেও কিছু না কিছু থাকবে। তা ছাড়া জিএম প্রযুক্তি এখনো পুরো প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রযুক্তি নয়, কাজেই এর প্রাথমিক ফলাফল দিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা নিরাপদ নয়।
খাদ্য উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবহার স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানী ও ভোক্তা জিএম প্রযুক্তির বিরোধিতা এ কারণেও করছে। বিটি ফসলের যত গবেষণা হয়েছে, তাতে স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি ধরা পড়েছে। বিশেষ করে, প্রাণী গবেষণায় দেখা গেছে, জিএম খাদ্য খেয়ে তাদের শরীরের বৃদ্ধিতে বাধা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভারতের মধ্য প্রদেশের একটি গবেষণায় কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি, ত্বকের চুলকানি, শরীরের নানা অংশে ফুলে যাওয়া, মুখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা গেছে। এগুলো সরাসরি বিটি ফসলের মাঠে কাজের সঙ্গে সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ফিলিপাইনে বিটি ফসলের মাঠের কাছাকাছি বাস করছেন এমন মানুষের শরীরে ফসলের পরাগায়নের সময় স্বাস্থ্য সমস্যা ধরা পড়েছে। যে বিজ্ঞানীরা বায়োটেকনোলজির পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের কথা হচ্ছে, এটা কীটপতঙ্গের জন্য ক্ষতিকর, মানবদেহের জন্য নয়। বাহ্! প্রাণীর শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করছে, অথচ মানুষের শরীরের জন্য তা নিরাপদ হবে? এটা কেমন কথা? মানুষ কি প্রাণিজগতের বাইরে? এসব নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে। যাঁরা আগ্রহী তাঁরা জেফরি স্মিথের বিকৃত পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানার জন্য Genetic Roulette—The Documented Health Risks of Genetically Engineered Foods বইটি পড়ে দেখতে পারেন। এ ছোট লেখার মধ্যে পরিবেশের ক্ষতির কথা তুললাম না। পরের কোনো লেখায় নিয়ে আসব। তবে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল, ২০১০ নিয়ে দু-একটি মন্তব্য করে শেষ করছি। বিলটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘...জীবপ্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিসহ জাতীয় পর্যায়ে জীবপ্রযুক্তির ইতিবাচক উন্নয়ন ও প্রয়োগের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন ও প্রয়োজন।’ এখানে লক্ষণীয় যে জীবপ্রযুক্তির কোনো ক্ষতিকর দিক আছে কি না বা কোনো ক্ষতিকর প্রভাব হলে তা দেখার দায়িত্ব এই ইনস্টিটিউট নিচ্ছে কি না। তবে সংজ্ঞায় দুটি কথা আছে, যেমন বায়োএথিক্স ও বায়োসার্ভিলেন্সের মাধ্যমে সামাজিক ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব দেখার কথা আছে। তবে বিলটির নামের সঙ্গে এ দুটি সংজ্ঞা খুব সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে এর ব্যবহার দুর্বল হয়ে থাকবে। ইনস্টিটিউটের কার্যাবলির কোথাও কৃষকের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি। যদি জীবপ্রযুক্তি ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত হয়, তাহলে কৃষকের বিষয়টি থাকা উচিত। এতে তাদের ক্ষতি হবে, নাকি লাভ হবে, কিছুই নেই, বরং কার্যাবলিতে আছে ‘নতুন গবেষকদের পেটেন্ট স্বত্ব প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদান করা হবে’। জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে আমাদের দেশেরই ফসলের ওপর কারিগরি করে, তাহলে পেটেন্ট দেওয়া হলে মূল ফসলের মালিকানার বিষয়টি কী হবে?
ফরিদা আখতার: উন্নয়নকর্মী।
আমাদের বিশেষ উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বিটি-ব্রিঞ্জাল করলে দেশীয় বেগুনের বিচিত্র জাতের উৎপাদন এবং বৈচিত্র্য থাকবে কি না, আমরা আমাদের কৌলিক সম্পদ (genetic resources) হারাব কি না, কৃষক বেগুন উৎপাদন করবে, নাকি বেগুনের বীজ বা জাত কোম্পানির হাতে চলে যাবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একে বিজ্ঞান জ্ঞান করে বিজ্ঞানীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
ফলে যাঁরা আমার সঙ্গে মতভেদ প্রকাশ করছেন, তাঁরা সবাই বৈজ্ঞানিক কারণে করছেন—এটা মনে করার কারণ নেই। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির প্রতি তাঁদের পক্ষপাত থাকতেই পারে। কিন্তু বিজ্ঞান ও টেকনোলজি সম্পর্কে আমাদের অগভীর দৃষ্টির কারণে তাঁরা সমালোচনাকে নিজের স্বার্থের দিক থেকে ব্যাখ্যা করেন। ‘আমাদের অতি প্রিয় বেগুনকে দূষিত করবেন না’ (প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০) লেখার পর যাঁরা আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন (অন্তত যাঁরা কষ্ট করে পত্রিকায়ও লিখেছেন), তাঁরা দুজনই বায়োটেকনোলজির পক্ষের মানুষ। তাঁরা বেগুনের পক্ষের কি না, সেটা তাঁদের লেখা থেকে আমি ধরতে পারিনি। এদেরই মতো আরও দু-একজন আমার একই বিষয়ে আরেকটি ইংরেজিতে লেখা bdnews24.com-এ ছাপা হওয়ার পর এত রেগে গেছেন যে আমাকে রীতিমতো তিরস্কার করে বলেছেন, আমি যেন নিজেকে জিএম সম্পর্কে সবজান্তা না ভাবি এবং লেখার আগে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে নিই। ধন্যবাদ। তাঁদের অবগতির জন্য বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, প্রচুর বৈজ্ঞানিক লেখা পড়ে এবং বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার কথা জেনে এবং সর্বোপরি আমাদের দেশের কৃষকের সঙ্গে কথা বলেই আমি আগে লিখেছি এবং এখনো লিখছি। আমার লেখার প্রতিটি বাক্য প্রমাণ করার মতো তথ্য আমার হাতে আছে। আমার জানার ত্রুটি থাকলে অবশ্যই মেনে নেব, কিন্তু তাই বলে বেগুনকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিজস্ব নানা প্রকার বা নানা জাতের বেগুনকে হাতছাড়া হতে দেব না।
বিটি বেগুনের বিষয়টি শুধুই বায়োটেকনোলজির নয়, এর সঙ্গে কৃষি, পরিবেশ, স্বার্থ ও সংস্কৃতি—অনেক কিছু জড়িত রয়েছে। আশ্চর্য হলাম যে আমাদের দেশের কোনো রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতির ধারক-বাহক কিংবা কৃষি, পরিবেশবিদ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কেউই যেন খাদ্য উৎপাদনে বায়োটেকনোলজির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেন না। এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, আধুনিক কৃষিতে উচ্চ ফলনশীলতার দাবি করলেও তার সঙ্গেই উচ্চ মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং একই সঙ্গে মাটির তলার পানি তুলে সেচের ব্যবস্থা করে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের যে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে, তা নিয়ে আমাকে নতুন কোনো তথ্য দিতে হবে না। স্বয়ং বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও সেই তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ব্যাপারে আর তত উৎসাহী নয়। তারা এখন কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর জন্য আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে।
আমাদের নিজেদের ভাবতে হবে, এ দেশের কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা—সবকিছুই যেখানে জড়িত, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাব? ক্ষতিকর টেকনোলজি ও করপোরেট বিজ্ঞানের কথা বলার অর্থ বিজ্ঞান বিরোধিতা নয়। বরং প্রাণবিজ্ঞানে যে বিপুল বিপ্লব ঘটেছে, তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে আমরা কৃষিতে ফলন বাড়াতে পারি, যাকে জাতিসংঘ বলছে প্রাণব্যবস্থাপনা-কেন্দ্রিক কৃষি (ecosystem approach to agriculture)। সেদিক থেকে বাংলাদেশের কৃষকেরা বহু ক্ষেত্রে এগিয়েও গেছেন।
তবে আশার কথা, সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা রয়েছে এবং তাই সমর্থনও পেয়েছি প্রচুর। কেউ উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন, আসলেই এ দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলকে নষ্ট হতে দিতে দেওয়া যায় না, যার উৎসস্থল এই দেশ। টাঙ্গাইলের গজিয়াবাড়ী গ্রামের কৃষক আক্কাস আলী আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আপা, আমি তো বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে গান লিখছি।’ আক্কাস ভাইয়ের গানের একটি অন্তরা তুলে ধরছি:
বিটি ব্রিঞ্জাল প্রণালি
ছিদ্র করে পোকার পুষ্টিনালি
গাছ ও বীজ বিষের থলি
পরিবেশ ধ্বংসে নাই সমাধান।
মনসান্তোর টেকনোলজি
বাংলাদেশ করবে শ্মশান।
এবার পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য তুলে ধরছি। বিটি-ব্রিঞ্জাল নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে ভারতে, ২০০০ সাল থেকে মেসার্স মাহায়কো (মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিডস কোম্পানি)। তারা পাঁচটি হাইব্রিড বেগুনের ওপর ১১টি স্থানে গবেষণা চালায়। গবেষণাধীন বিটি বেগুনগুলো হচ্ছে MHB-4 Bt Brinjal, MHB-9 Bt Brinjal, MHB-10 Bt Brinjal, MHB-80 Bt Brinjal এবং MHB-99 Bt Brinjal। মাহায়কো এই প্রযুক্তি নিয়েছে মনসান্তোর কাছ থেকে এবং বাংলাদেশে এসেছে ইউএসএইডের প্রকল্প Agricultural Biotechnology Support Project II (ABSPII) মাধ্যমে। মাহায়কো বিটি বেগুনের ওপর গবেষণা করে তাদের পক্ষে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেগুলো আমার কাছে আছে। তবে আমি এ লেখার জন্য Bt Brinjal A Briefing Paper : Centre for Sustainable Agriculture, June 2006 থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করছি। প্রথমত, ভারতে বিটি বেগুনের পক্ষে কোম্পানি যে যুক্তি ব্যবহার করেছে তা হচ্ছে, গত দুই দশকে বেগুনের ফলনের ক্ষেত্রে সুট অ্যান্ড ফ্রুট বোরার অর্থাৎ গাছের কাণ্ড এবং ফলে পোকা লাগার কারণে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ফলন কমেছে এবং এর ফলে ২২ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। কাজেই বিটি-ব্রিঞ্জাল সেই পরিপ্রেক্ষিতে পোকা দমনের পদ্ধতি হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলনের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছে। কাজেই বেগুনের ওপর বায়োটেকনোলজির ব্যবহার সরাসরি ফলন বৃদ্ধির কোনো প্রযুক্তি নয়, বরং পোকা যেন না লাগে এবং পোকা লাগার কারণে ফলনের যে ক্ষতি হয়, তা নিরসনের চেষ্টা।
মাহায়কো কোম্পানি নিজস্ব কিছু গবেষণা করেছে বিটি বেগুন ও সাধারণ বেগুনের মধ্যে। গাছের কাণ্ডের ক্ষতি বিটি বেগুনে ০.০৪ থেকে ০.৩ শতাংশ আর সাধারণ বেগুনে ০.১২ থেকে ২.৫ শতাংশ; ফলের ক্ষেত্রে বিটি বেগুনে ক্ষতি হয়েছে ২.৫ থেকে ২০ শতাংশ আর সাধারণ বেগুনে ২৪ থেকে ৫৮ শতাংশ। গাছের কাণ্ড ও ফল উভয় ক্ষেত্রেই একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে বিটি প্রযুক্তি পোকা লাগার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে দমন করতে সক্ষম নয়। ক্ষতি কম হলেও কিছু না কিছু থাকবে। তা ছাড়া জিএম প্রযুক্তি এখনো পুরো প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রযুক্তি নয়, কাজেই এর প্রাথমিক ফলাফল দিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা নিরাপদ নয়।
খাদ্য উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবহার স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানী ও ভোক্তা জিএম প্রযুক্তির বিরোধিতা এ কারণেও করছে। বিটি ফসলের যত গবেষণা হয়েছে, তাতে স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি ধরা পড়েছে। বিশেষ করে, প্রাণী গবেষণায় দেখা গেছে, জিএম খাদ্য খেয়ে তাদের শরীরের বৃদ্ধিতে বাধা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভারতের মধ্য প্রদেশের একটি গবেষণায় কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি, ত্বকের চুলকানি, শরীরের নানা অংশে ফুলে যাওয়া, মুখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা গেছে। এগুলো সরাসরি বিটি ফসলের মাঠে কাজের সঙ্গে সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ফিলিপাইনে বিটি ফসলের মাঠের কাছাকাছি বাস করছেন এমন মানুষের শরীরে ফসলের পরাগায়নের সময় স্বাস্থ্য সমস্যা ধরা পড়েছে। যে বিজ্ঞানীরা বায়োটেকনোলজির পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের কথা হচ্ছে, এটা কীটপতঙ্গের জন্য ক্ষতিকর, মানবদেহের জন্য নয়। বাহ্! প্রাণীর শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করছে, অথচ মানুষের শরীরের জন্য তা নিরাপদ হবে? এটা কেমন কথা? মানুষ কি প্রাণিজগতের বাইরে? এসব নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে। যাঁরা আগ্রহী তাঁরা জেফরি স্মিথের বিকৃত পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানার জন্য Genetic Roulette—The Documented Health Risks of Genetically Engineered Foods বইটি পড়ে দেখতে পারেন। এ ছোট লেখার মধ্যে পরিবেশের ক্ষতির কথা তুললাম না। পরের কোনো লেখায় নিয়ে আসব। তবে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল, ২০১০ নিয়ে দু-একটি মন্তব্য করে শেষ করছি। বিলটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘...জীবপ্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিসহ জাতীয় পর্যায়ে জীবপ্রযুক্তির ইতিবাচক উন্নয়ন ও প্রয়োগের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন ও প্রয়োজন।’ এখানে লক্ষণীয় যে জীবপ্রযুক্তির কোনো ক্ষতিকর দিক আছে কি না বা কোনো ক্ষতিকর প্রভাব হলে তা দেখার দায়িত্ব এই ইনস্টিটিউট নিচ্ছে কি না। তবে সংজ্ঞায় দুটি কথা আছে, যেমন বায়োএথিক্স ও বায়োসার্ভিলেন্সের মাধ্যমে সামাজিক ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব দেখার কথা আছে। তবে বিলটির নামের সঙ্গে এ দুটি সংজ্ঞা খুব সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে এর ব্যবহার দুর্বল হয়ে থাকবে। ইনস্টিটিউটের কার্যাবলির কোথাও কৃষকের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি। যদি জীবপ্রযুক্তি ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত হয়, তাহলে কৃষকের বিষয়টি থাকা উচিত। এতে তাদের ক্ষতি হবে, নাকি লাভ হবে, কিছুই নেই, বরং কার্যাবলিতে আছে ‘নতুন গবেষকদের পেটেন্ট স্বত্ব প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদান করা হবে’। জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে আমাদের দেশেরই ফসলের ওপর কারিগরি করে, তাহলে পেটেন্ট দেওয়া হলে মূল ফসলের মালিকানার বিষয়টি কী হবে?
ফরিদা আখতার: উন্নয়নকর্মী।
No comments