আন্তর্জাতিক নারী দিবস-এ দিবস কার? 'ওদের' না 'আমাদের'? by শহিদুল ইসলাম

আজ ৮ মার্চ ২০১১ বিশ্ব নারী দিবস। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বসে এটা উপলব্ধি করতে পারছি না। দেশে আজ দিবসটিকে ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবারও যে অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা-মিছিল হচ্ছে, এত দূরে বসে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। কেবল ইন্টারনেটে আজ দৈনিকের পাতায় চোখ রাখলে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়।


প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা এই দিনে অন্তত একটি কলাম ছাপবে। এখানেও দু-চারটি ছোটখাটো এনজিও আছে।
যতদূর খবর সংগ্রহ করতে পেরেছি, তারা এ দিনটি সম্পর্কে তেমন কোনো খোঁজখবর রাখে বলে মনে হলো না। এর অর্থ এই নয় যে, এখানে নারীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। খোলাখুলিভাবে এখানে নারীর ওপর নির্যাতন চলে না, এটা ঠিক; কিন্তু পুরুষতন্ত্রের নীরব চাপ এখানকার নারীসমাজ উপলব্ধি করতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ধারণা এখানে আলাদা। আমাদের দেশে অত্যাচার খোলাখুলি_এখানে
তা নয়।
এখানে এরা রাষ্ট্রটিকে এমনভাবে তৈরি করেছে যে একজন স্বামী যদি বাড়ির নির্জনতায় স্ত্রীকে একটা চপেটাঘাত করে এবং স্ত্রী যদি পুলিশ ডাকে, তাহলে বিনাবাক্য ব্যয়ে স্বামী বাবাজিকে হাজতবাস করতে হবে। তারপর বিচার। বিচারে যদি প্রমাণ হয় যে স্ত্রী আইনের অপব্যবহার করেছেন, তখন স্বামী মুক্তি পাবেন আর স্ত্রীর শাস্তি। রাষ্ট্রীয় আইন ফাঁকি দিয়ে চলা নাকি এখানে অসম্ভব। চলছে না, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

দুই. আমাদের দেশে বছরে বছরে দিনটি পালিত হয়। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের নারীবাদী সংস্থা ব্যক্তি ও সরকারের মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখা দিনটিতে নারী বৈষম্যগুলো দূর করার জন্য দাবি পূরণ_নানা রকম কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁদের উৎকণ্ঠা সরকারের উচ্চতম মহলে পেঁৗছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে নারীর ওপর দৈহিক ও আইনি অত্যাচার কমেছে, হলফ করে একথা বলতে পারা যায় না। বরং সাম্প্রতিককালে নারীর ওপর সহিংস আক্রমণ প্রকাশ করে যে বিশ্ব নারী দিবস পালনের যৌক্তিকতা কতটা কার্যকর। আমাদের দেশেও আইন আছে। হয়তো সেখানে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে নারী-বৈষম্য বিলোপের ধারা যুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রধান ত্রুটি আইনের প্রয়োগ নিয়ে। যেকোনো অপরাধ করে এখানে সমাজে মাথা উঁচু করে চলা যায়। বরং রাঘব-বোয়াল অপরাধীরাই সমাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে। তাই বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন গুরুত্বপূর্ণ নারী মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যাচ্ছে না। যদি বলি স্কুলের শুরু থেকেই শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ-বৈষম্যের বিষয়টি মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মসজিদে মসজিদে আমাদের মওলানা সাহেবরা নারী সম্পর্কে এমন সব আপত্তিকর কথা বলেন, এখানে হলে তাঁদের হাজতবাস নিশ্চিত ছিল। ধর্মান্ধতাই আমাদের অনেক ভালো কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটা যেমন সত্য, তেমনি যে সুশীল সমাজ ও এনজিওরা আজ সোচ্চার হবে, তারাও বৈশ্বিক অর্থনীতির শক্ত বাঁধনে বাঁধা। বিশ্বব্যাপী এক শক্তিশালী এনজিও নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, যারা সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার সমস্যা, নারী ও পরিবেশ সমস্যা নিয়ে সোচ্চারই নয় শুধু, দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণ নিয়েও কথা বলে।
এডওয়ার্ড সাউদের সাম্প্রতিক লেখায় এদের কার্যকারিত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। কেননা তিনি মনে করেন, এসব এনজিও বিশ্ব করপোরেট তন্ত্রের বিশ্বব্যাপী এক রূপ। বিশ্বের বড় বড় বহুজাতিক করপোরেশনের অর্থে পরিচালিত এসব একাডেমিক আন্দোলন বিশ্বায়নের প্রগতিবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ধারাকেই শক্তিশালী করছে। বিশ্বায়নের পক্ষে-বিপক্ষে আজ প্রচুর লেখা হচ্ছে। তাঁর মতে, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিশ্বায়নের পক্ষে মত প্রকাশ করে বলে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কাঠামো আর কখনো আসেনি। যারা বিশ্বায়নের বিপক্ষে, তাদের তিনি পাবলিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা মনে করে, এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এককেন্দ্রিক নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। কেননা এসব প্রতিষ্ঠান তাদের অর্থ জোগানদাতা।
এ নিয়ে অনেক কথা বলার থাকলেও কাগজের একটা ছোট্ট কলামের মাধ্যমে তা তুলে ধরা সম্ভব নয়। যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাঁরা বিদেশি অর্থে পরিচালিত বিধায় এসব সংস্থা তাদের নির্দেশ
মানতে বাধ্য।
তিন. নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে যে শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সম্পর্ক অতি নিগূঢ়, সবাই তা জানেন। ধর্ম যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার রাখে, সে সমাজে নারীর শিক্ষা ও স্বাবলম্বী হওয়া দুটিই কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিটি ধর্মই নারী-পুরুষ তাদের মধ্যে পার্থক্য রচনা করে। নারী অবলা। তার কাজ ঘর-সংসার সামলানো, সন্তান পালন ইত্যাদি। আর পুরুষের কাজ বাইরে কাজ করে নারীর আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। পুঁজিবাদ এসে যেমন ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করে, তেমনি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটায়।
তাই ক্রমে নারী ও পুরুষের বৈষম্যসূচক অনেক কিছুর ওপর আঘাত আসতে থাকে। বিশ শতকের প্রথম অর্ধেই ইউরোপের প্রায় সব দেশেই নারী সর্বজনীন ভোটাধিকার লাভ করে। উন্নত বিশ্বে নারী-পুরুষের বৈষম্যমূলক সূচকগুলো ক্রমেই নারীর পক্ষে পরিবর্তিত থাকে। কিন্তু দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চিত্র ভিন্ন। ঐতিহ্যবাহী পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোটি আজও আমাদের মতো দেশে বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। দুজন নারী প্রধানমন্ত্রী বিগত ১৫ বছরেরও বেশি দেশ শাসন করলেও তাঁরা সে কাঠামোর শরীরে কোনো রকম ফাটল ধরাতে পারেননি। বরং পুরুষতন্ত্রের মধ্যেই তাঁদের কাজ করতে হয়। তাই ইয়াসমীনরা যখন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর সদস্যের হাতে নির্যাতিত হন এবং খুন হন, এর বিরুদ্ধে যখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় আন্দোলনে নামেন, তখন মহিলা প্রধানমন্ত্রী সেই দুষ্কৃতকারী পুলিশের পক্ষাবলম্বন করেন এবং আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে তাঁদের হতাহত করেন। ধর্মের চেয়ে 'রাজনৈতিক ধর্ম' যে আরো মারাত্মক তা জিন্নাহ সাহেব প্রমাণ করে গেছেন। সেই ধারাটি আমাদের রাজনীতিবিদরা এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন।
তাই মেয়েদের স্বাবলম্বী করে কোনো আইন পাস করতে তাঁদের কত ভয়, পাছে আগামী নির্বাচনে ভোট হারাতে হয়। সবার নজর ভোটবাঙ্রে ওপর। যত অযৌক্তিক দাবিই হোক, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটকে তাঁদের বড় ভয়। শুধু রাজনীতিবিদদের ত্রুটি খুঁজে কোনো লাভ নেই_দেশের একটি প্রধান দৈনিকের সম্পাদকের ক্ষমা চেয়ে হুজুরের কদমবুচি করা অন্ধকারের শক্তির কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কী?
চার. প্রতিবছর আমরা অতি উৎসাহের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক্যাল বিশ্ব নারী দিবস পালন করি। এতে কী লাভ হয়েছে, তার একটা সংখ্যাতাত্তি্বক হিসাব নেওয়া দরকার। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার মহান উদ্দেশ্যে যারা আমাদের প্রতিবছর দিনটি উদ্যাপনের জন্য টাকা দেয়, তারা কি সত্যিই তা চায়? এ প্রশ্নটি বিশ্বের নামকরা নন একাডেমিক 'পাবলিক' বুদ্ধিজীবীরা জোরেশোরে তুলতে আরম্ভ করেছেন। তথ্য প্রমাণ দিয়ে তাঁরা বলতে চান, যেসব বড় বড় করপোরেট ওই সব দিন পালনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, এসব দেশের ওপর কবজির শক্তি বৃদ্ধি করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা প্রতিবছর মেথোডিক্যালি এসব দিন পালন করে থাকি; তাদের সে ইচ্ছাটাই বাস্তবায়ন করে চলেছি। অর্থের মাধ্যমে তারা আমাদের মতো একাডেমিক বুদ্ধিজীবীদের ক্রয় করেছে আর নিজেকে বিক্রি করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে আমরা জাবর কাটছি।

৫ মার্চ, ২০১১, পার্থ, অস্ট্রেলিয়া
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.