সবুজ আবাসন by গৌতম লাহিড়ী

দিলি্লতে যে সবুজ নগরী গড়ে উঠবে তার অন্তর্গত হবে 'সবুজ আবাসন'। দিলি্লর বিকাশ সংস্থার মতে, এ উপনগরী গড়ে উঠতে সময় লাগবে দশ বছর। এ উপনগরীর বিদ্যুতের জন্য ব্যবহার করা হবে শুধু সৌরবিদ্যুৎ। নিতান্তই জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ। রাজধানী দূষণের প্রধান কারণ কার্বন বর্জ্য।


তাই এ উপনগরীতে কার্বন বর্জ্য পরিহার করার যাবতীয় উপকরণ রাখা হবে। ইতিমধ্যেই সবুজ নগরীর মডেল তৈরি করা হয়েছে। শহরের নিকাশী ব্যবস্থা করা হবে উন্নত 'রিসাইক্লিং' পদ্ধতির সাহায্যে। এ উপনগরীতে পেট্রোল-ডিজেলচালিত গাড়ি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সাইকেল এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা হবে প্রধান বাহন

আগামী জুনের শেষ সপ্তাহে রিও ডি জেনিরোতে বসছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে 'বিশ্ব (আর্থ) শিখর সম্মেলন'। ঠিক তার আগেই রাজধানী দিলি্লর ক্ষমতার অলিন্দে শুরু হয়েছে হেলদোল। রাতারাতি দূষণক্লিষ্ট নগর রাজধানীর দিলি্লতে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিলি্ল শহরের পাঁচ প্রান্তে পাঁচটি 'সবুজ উপনগরী' নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত সরকার। তাৎপর্যপূর্ণ হলো এবারের বিশ্ব শিখর সম্মেলনে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় 'সবুজ অর্থনীতি রূপায়ণ'। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'সবুজ অর্থনীতির' ওপর দক্ষিণ এশিয়ার নয়টি দেশের 'নারী সম্মেলনে' যে 'ঢাকা ঘোষণাপত্র' গৃহীত হয়েছিল সেটিও রিও সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ওই ঘোষণাপত্রের মূল বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণ নারী জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। এ প্রসঙ্গে পরে ব্যাখ্যা করছি।
দিলি্লতে যে সবুজ নগরী গড়ে উঠবে তার অন্তর্গত হবে 'সবুজ আবাসন'। দিলি্লর বিকাশ সংস্থার মতে, এ উপনগরী গড়ে উঠতে সময় লাগবে দশ বছর। এ উপনগরীর বিদ্যুতের জন্য ব্যবহার করা হবে শুধু সৌরবিদ্যুৎ। নিতান্তই জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ। রাজধানী দূষণের প্রধান কারণ কার্বন বর্জ্য। তাই এ উপনগরীতে কার্বন বর্জ্য পরিহার করার যাবতীয় উপকরণ রাখা হবে। ইতিমধ্যেই সবুজ নগরীর মডেল তৈরি করা হয়েছে। শহরের নিকাশী ব্যবস্থা করা হবে উন্নত 'রিসাইক্লিং' পদ্ধতির সাহায্যে। এ উপনগরীতে পেট্রোল-ডিজেলচালিত গাড়ি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সাইকেল এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা হবে প্রধান বাহন। কয়েকদিন আগেই দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত এ ধরনের রিকশার উদ্বোধন করেন। যানবাহন চলাচলের জন্য ভূগর্ভস্থ 'আন্ডারপাস' থাকবে। যাতে এ উপনগরীতে যানজট রোখা যায়। কেননা দূষণ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ যানজট। প্রস্তাবিত পাঁচটি জোনের মধ্যে 'জোন-এন' হবে কুঞ্জবলা এবং ওয়াবানা এলাকা, জোন-এলে থাকবে পশ্চিম দিলি্লর নজফগড়ের ৫০টি গ্রাম, 'কে জোনে থাকবে নাংগলৌই এবং জোন-জে'তে রয়েছে দক্ষিণ দিলি্লর মেহরোলি এবং ছতরপুর এলাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
সম্প্রতি ভারতের জাতীয় দূষণ পর্ষদ ভারতের প্রধান শহরগুলোর দূষণের মাত্রা নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। বাতাসে যেসব বিষাক্ত কণার সন্ধান মিলেছে তাতে বিশাল অংশের মানুষ তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছেন নিজের অজান্তেই। প্রমাণ মিলেছে বাতাসে রয়েছে ধূলিকণার সঙ্গে নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং সামান্য হলেও কার্বন মনো ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন মনো অক্সাইড নিঃশব্দে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়_ একথা সবার জানা। এ সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর ভারতের রাজধানী দিলি্লসহ সংলগ্ন নয়ডা, ফরিদাবাদে দূষণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। তবে একমাত্র শৈলশহর সিমলা এবং গজরোলায় মাত্রা কিছুটা হলেও কমেছে। পূর্ব ভারতের শহরগুলোর মধ্যে শৈলশহর হওয়া সত্ত্বেও শিলংয়ে দূষণ বাড়ছে। বাড়ছে হাওড়া-উড়িষ্যার রাউর কেল্লায়। তবে পশ্চিম প্রান্তের আহমেদাবাদ, জামনগর, শোলাপুর শিল্পনগরী হলেও মাত্রা কমেছে আবার মুম্বাই, কোটা এবং সাতনায় বাড়ছে। দক্ষিণ ভারতের শহরগুলোতে তুলনামূলকভাবে দূষণ কম। দূষণ অনুকরণীয় মডেল হিসেবে কমে গেছে তিরুবন্তপুরম, মাইসোর এবং কোচিতে। তবে বাড়ছে হায়দ্রাবাদ, বিশাখাপত্তনম এবং ব্যাঙ্গালোরে। শহরগুলোতে দূষণ উপকরণ নাইট্রোজেন অক্সাইড মাত্রা কম হওয়ার কারণ গ্যাসচালিত পরিবহন এবং সর্বশেষ প্রকৃতির যানবাহন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া। ফিরে আসি ঢাকার সম্মেলনের প্রশ্নে, ওই সম্মেলনের আয়োজক দক্ষিণ এশিয়া উইমেন্স নেটওয়ার্ক। অংশ নিয়েছিলেন আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের নারী প্রতিনিধিরা, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সেই ঢাকা ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, অন্যান্য বিষয় ছাড়া নারীর সুস্বাস্থ্য, পুষ্টিকর খাদ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা ছাড়া সবুজ অর্থনীতি অর্থহীন। বলা হয়, স্থানীয় লোকশিল্প এবং ঐতিহ্যশালী বস্ত্র শিল্পের বিকাশ ছাড়া সবুজ অর্থনীতি হয় না। শুধু সবুজ বাসস্থান নির্মাণ সমস্যার সমাধান নয়, কার্যত দিলি্ল সরকার সবুজ বাসস্থান নির্মাণ করে দায়িত্ব পালন নির্বাহ করতে চাইছেন। পরিবেশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবিকার যে নিবিড় সংযোগ রয়েছে এটা তুলে ধরাই হবে প্রধান কাজ।
এবার রিও সম্মেলনে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা হবে দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়। এ অঞ্চলেই বিপদ হিমালয়ের হিমবাহের সংকোচন, বন্যা-খরার প্রাদুর্ভাব, প্রাণীর বিলুপ্তি। এসবেরই প্রধান শিকার নারীরা। বিপর্যয়ের পর ছিন্নমূল মানুষ বাধ্য হন শহরের দিকে ছুটে যেতে। তখন তাদের ওপরই নেমে আসে বঞ্চনা। ক্রমেই সমুদ্রস্তরের বৃদ্ধি পরিবেশে অজানা বিপদ ডেকে আনছে।
এ অঞ্চল জীবমণ্ডলের বৈচিত্র্যের সম্ভারে ঋদ্ধ। অথচ এ বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে একমুখী 'জেনেটিক প্রযুক্তির সহায়তায় সবুজ বিপ্লব' নামক পশ্চিমা সমাধান আরোপ করে পরিবেশ বিপজ্জনক করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় ওই ঘোষণাপত্রে। রিও সম্মেলনে এ বিষয়টি কতটা প্রাধান্য পায় তা-ই দেখার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব এই দক্ষিণ এশিয়ায়। এখানেই বিপদ পরিবেশজনিত ক্ষয়ের, যা ঘটেই চলেছে। তাই সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এদের আর্জি, কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে দক্ষিণ এশিয়ার মতামত প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

গৌতম লাহিড়ী :সমকাল
প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল

No comments

Powered by Blogger.