সময়ের প্রতিবিম্ব-‘কুফা’মুক্ত উপনির্বাচন নিয়ে আশাবাদ by এবিএম মূসা
সকল পথ রোম অভিমুখী। ইংরেজি প্রবচন ‘অল রোডস লিড টু রোম’—এই প্রবাদবাক্যের অনুকরণে বলা যায় ‘অল আইজ ফিক্সড অন ভোলা’, সবার দৃষ্টি ভোলার ওপর। সবার বলতে আমি অবশ্য সর্বসাধারণ বলছি না। দুটি প্রধান দলের নীতিনির্ধারকদের যাঁরা ভোলা উপনির্বাচন নিয়ে ইজ্জতের লড়াই করছেন তাঁদের কথা বলছি।
তবে আমার দৃষ্টির তথা পর্যবেক্ষণের আওতায় সর্বাগ্রে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোলা উপনির্বাচনের লড়াইয়ে কে জিতবেন অথবা হারা-জেতার প্রভাব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কতখানি পড়বে, তা নিয়ে ভাবছি না। ভাবনা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও অন্য দুই সদস্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ ভোলার উপনির্বাচনে স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতার পরীক্ষা দিচ্ছে আমাদের সর্বময় ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানটি। সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে তারা সব সংশয়ের ঊর্ধ্বে ও শঙ্কামুক্ত থাকতে পারবে কি না, তা নিয়েই আমার একটুখানি দুর্ভাবনা।
সংবিধানের সপ্তম ভাগের ১১৮ থেকে ১২৩ অনুচ্ছেদগুলো বারবার পড়ছি, পড়ছি আর ভাবছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অসীম ক্ষমতার অধিকারী এই কমিশন। এমনকি নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (অনুচ্ছেদ ১২৪) ও সকল রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিশনকে (অনুচ্ছেদ ১২৩)। ভোলার উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনপ্রদত্ত ক্ষমতা কতখানি প্রয়োগ করছে, সম্প্রতি তা নিয়ে আমার নিজেরই ধোঁকা লেগেছিল। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ভোলায় যেসব সহিংসতা ঘটছে তা নিরোধ করা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর এই প্রতিপাদ্যের মূলে ‘কুফা’ নিয়ে আশঙ্কা। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে নিজস্ব সময়সূচি বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি এই ‘কুফা’ লাগাকে দায়ী করেছেন। ভোলায় কি তিনি একটি কুফা-মুক্ত নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবেন? নাকি কুফার প্রভাবে নির্বাচনটি বিতর্কিত হবে?
বাংলা একাডেমী ও সংসদ অভিধানে ‘কুফা’ শব্দটি খুঁজে পেলাম না। শনির গ্রহের প্রভাব অথবা তুঙ্গে বৃহস্পতি প্রভৃতি শব্দ শিক্ষিত মহলে এবং যাঁরা জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বাসী, তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কাজে ব্যর্থতা ও সাফল্যের অজুহাতে ব্যবহার করেন। তবে অশিক্ষিত মহলে কুফা লেগেছে বা জিনের আছর, নজর লেগেছে কথাগুলো বহুল প্রচলিত। কিন্তু আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশন কুফা লাগার দোহাই দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পেছানোর কথা বললেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছি। কুফা বলতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিরা অদৃশ্য অশুভ অপশক্তির প্রভাব বোঝান। আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তায়, অসহায় সংলাপ ও দুর্বলের মিনতিমাখা বক্তব্যে তিনি যে কুফা বলতে সিটি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণায় সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা বলছেন, এমনটিই ব্যাখ্যা করা যায়। আর এক দিন পরই বোঝা যাবে এই ‘কুফা’ লেগেছে শুধু কি সিটিতে, নাকি ভোলাতেও। তবে সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর জেনে আশা হচ্ছে, এই কুফার প্রভাব ভোলায় তারা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে। আমার এই আশাবাদ যথার্থ কি না, পরশু দিনই তা বোঝা যাবে।
প্রথমে উপনির্বাচনটিতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে কুফা লেগেছে তার প্রভাব পড়েছে কেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এই উপনির্বাচন নিয়ে প্রথম থেকেই সরকার, বিরোধী দল ও নির্বাচন কমিশন কী ভাবছে, তার আভাস তাদের গত কয়েক সপ্তাহের কথাবার্তা ও কার্যক্রমের খবরের সুবাদে জানতে পারছি। আমার নিজস্ব কৌতূহল ছিল জনগণ কী ভাবছে তা জানার। সেই কারণে নির্বাচন কমিশনার পরম প্রীতিভাজন ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনকে টেলিফোনে বললাম, ‘আমি ভোলা যাব।’ উপনির্বাচনটি কীভাবে পরিচালিত হয় সেটি দেখার কৌতূহলের কারণটি তাঁকে ব্যাখ্যা করিনি। শুধু বলেছি, ‘ভোলায় আরেকটি মাগুরা হবে বলে অনেকে আমার কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই কোনো মাগুরার আগাম প্রস্তুতি চলছে কি না, তা জানতে ভোলা যাব।’ সাখাওয়াত ভাই আমাকে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভোলার রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে তোফায়েল আহমেদের। তাঁকেও বললাম, ‘ভোলা যাব।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, দৃশ্যত সরকারি দলে ও বাহ্যত দলীয় নেত্রী কর্তৃক অবহেলিত অভিজ্ঞ এই ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতার হঠাৎ করে কদর বেড়ে গেছে। দলীয় নেত্রী তাঁকে ভোলা উপনির্বাচন নিয়ে সক্রিয় হতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আওয়ামী লীগ-অন্তঃপ্রাণ তোফায়েল অবশ্য নেত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা করতেন না। এমনিতেই দলীয় প্রার্থীর জন্য এলাকা চষে ফেলতেন। তদুপরি শুনেছি, দলের মনোনয়ন পাওয়া তরুণ প্রার্থী তাঁরই পছন্দের ব্যক্তি। সুতরাং তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদাও ভোলায় উপনির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। সরকারে ও দলে পুনর্মূল্যায়নও হয়তো এই নির্বাচনী ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে।
ভোলা উপনির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে নির্বাচন কমিশন অজ্ঞাত বা জ্ঞাত কারণে এমনিতেই বিলম্ব করেছে। প্রথমেই উপনির্বাচন নাকি পুনর্নির্বাচিত অথবা পরাজিত প্রার্থীকে নির্বাচনী বিধিমতে নির্বাচিত ঘোষণা করা উচিত—এ নিয়ে মতান্তর ছিল। আমি ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াতকে বিলম্বের কারণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর উত্তরটি ‘কই, হাফিজ সাহেব তো কিছু বলছেন না’, আমার মনঃপূত হয়নি। আনুমানিক ১৯৬৪ সালে মৌলবি ফরিদ আহমদ তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কক্সবাজারের একটি উপনির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলা করে জয়ী হয়েছিলেন। সেই কেন্দ্রে উপনির্বাচন বা পুনর্নির্বাচন হয়নি, মৌলবি ফরিদ আহমদকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। হাফিজও এ ধরনের সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন বলে শুনেছি। ভোলা আর কক্সবাজারের নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ কমিশন বোধহয় একই পাল্লায় ওজন করেনি। তাই নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনেরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ হাফিজ শেষ পর্যন্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
বস্তুত, ভোলায় ‘কুফা’ লাগার আশঙ্কা দেখা দেওয়ার মূলে ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন পেছানোর প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনে কুফার প্রভাব। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মহা ভাগ্যবান ব্যক্তি। বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সবার জন্য ভোগান্তি হলেও খোকার জন্য শাপে বর হয়েছে। তাই ভাবছি, অন্তত আরও চার বছর তিনি ‘মেয়র’ পদে বহাল তবিয়তে থাকবেন কি না। আমার এই অদ্ভুত ধারণার মূলে সরকারের একটি বিশেষ মহলের ঘোষণা, ‘বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে আরও চার বছর লাগবে।’ জানি না, ১৪ মাসে সরকার যে সমস্যাটির সমাধানের পথে এক পা-ও এগিয়েছে বলে মনে হয় না, আগামী পাঁচ মাসে জনগণের বিদ্যুৎ-দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘবে অথবা ঢাকার বাসিন্দাদের চুলোয় গ্যাস পরিপূর্ণ মাত্রায় সরবরাহ করতে কতখানি সফল হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, যে কুফার প্রভাবে কমিশন সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃঢ় অবস্থান থেকে বারবার সরে এসেছে, অক্টোবরে তা কি কেটে যাবে? অনেক বাগাড়ম্বর ও হম্বিতম্বি করেও নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার পরও ওয়াদা রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর পর্যন্ত ভরসা করতে পারছে না। ভরসা করছেন যাঁরা আগামী পাঁচ মাসে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস দিতে পারবেন বলে আশান্বিত তাঁদের ওপর। আমি কিন্তু কুফার প্রভাবে নির্বাচন কমিশনের অনাকাঙ্ক্ষিত নতি স্বীকারের মধ্যেও একটি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ইংরেজিতে বলব ‘সিলভার সাইনিং এলং দি ব্ল্যাক ক্লাউড’, মেঘের মাঝে চমকানো বিদ্যুতের ঝলকানি। বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের সংকটে অক্টোবরের মধ্যে পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি কুফামুক্ত হবে এমন প্রচ্ছন্ন আশ্বাস পেয়েছি। আশাবাদী হচ্ছি অন্তত সিটি নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে সরকারের বিদ্যুৎ-পানির সংকট সমাধান প্রচেষ্টায় গতি সঞ্চার হবে। দুর্মুখেরা বলতে পারেন, না হলেই বা কী? ১৪ মাসে যা পাইনি, পাঁচ মাসে তা না পেলে কুফার আছরে অক্টোবরে সিটি করপোরেশন নির্বাচন আবার পেছাতে অসুবিধা কোথায়?
বস্তুত সিটির নির্বাচন নিয়ে কমিশনের ক্ষমতা ও তথাকথিত স্বাধীনতা নিয়ে জনগণের মনে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, ভোলা উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনায় তারই প্রভাব পড়েছিল। নির্বাচন-পূর্ববর্তী কতিপয় ঘটনা সেই সংকট বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ভাবছিলাম, সরেজমিনে নির্বাচন পরিবেশটি কেমন দেখে আসব। শ্রদ্ধাভাজন নির্বাচন কমিশনার ও পরম প্রীতিভাজন তোফায়েল আহমেদের সাদর আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে একাই ভোলা যাব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পত্রপত্রিকায় সহিংসতা আর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার খবর পড়ে যাওয়ার ভাবনা ছেড়ে দিলাম। তদুপরি ‘বহিরাগতদের’ বের করে দেওয়া হবে শোনার পর তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য দুই দলের প্রভাবশালী বহিরাগত ব্যক্তিরা এলাকা ছাড়লেও তাদের রেখে যাওয়া অজানা ও আশ্রিত বহিরাগতদের কমিশন শেষ পর্যন্ত বের করে দিয়েছে কি না, তা ভোটের দিন বোঝা যাবে। এত সবের পরও পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ও জয়-পরাজয়ের গুরুত্ব নিয়ে ভাবনাটি অব্যাহত রয়েছে। এই ভাবনায় জয়-পরাজয়ের প্রভাব ও গুরুত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘একটি আসন না পেলে আমাদের ক্ষমতার হেরফের ঘটবে না।’ আমি তাঁর এই বক্তব্যটির প্রশংসা করি। পরাজিত হলে বিরোধী দল হয়তো বলবে, ক্ষমতাসীন সরকারের জনপ্রিয়তা এখন ক্ষয়িষ্ণু। আমার মতে, ভোলায় একটি নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন হলে পরাজিত হলেও সরকার গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার কারণে এক ধরনের বিজয়ের গৌরব অর্জন করবে। অন্যদিকে ভোলা উপনির্বাচন দুই দলের জন্য ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ এমনটি মনে করার কারণ নেই। ভোলায় হারলে কোনো দলের প্রেস্টিজ পাংচার হবে বলে আমি মনে করি না। ভয় হচ্ছে, স্বচ্ছ ও কারচুপিমুক্ত উপনির্বাচনের ফল স্বচ্ছ হলেও, হারলে ‘কারচুপি’ হয়েছে বলে আন্দোলন করতে না পারলেও, তারা কিছুদিন রাজনৈতিক অঙ্গন গরম রাখতে পারবে। জিতলে তো কথাই নেই, সরকার জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের প্রথম পরীক্ষায় হেরে গেছে বলে উল্লাস করতে পারবে। এর বাইরে ভোলার নির্বাচনী ফলাফলের তেমন গুরুত্ব নেই। বরং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে কমিশনের কুফা অনেকখানি কেটে যাবে।
প্রতিপাদ্য: কুফার কারণে কি না জানি না, বাংলাদেশের প্রায় সব প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয় বিতর্কিত হয়েছেন, নয়তো মেয়াদকাল সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। বর্তমান কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের ওপর আমি পূর্ণ আস্থাবান। ভোলার উপনির্বাচনে কুফা কাটিয়ে তাঁরা এই দুর্ভাগ্যজনক ট্র্যাডিশন তথা অশুভ ঐতিহ্যটির অবসান ঘটাতে পারবেন। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই আমার এই কামনা।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
সংবিধানের সপ্তম ভাগের ১১৮ থেকে ১২৩ অনুচ্ছেদগুলো বারবার পড়ছি, পড়ছি আর ভাবছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অসীম ক্ষমতার অধিকারী এই কমিশন। এমনকি নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (অনুচ্ছেদ ১২৪) ও সকল রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিশনকে (অনুচ্ছেদ ১২৩)। ভোলার উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনপ্রদত্ত ক্ষমতা কতখানি প্রয়োগ করছে, সম্প্রতি তা নিয়ে আমার নিজেরই ধোঁকা লেগেছিল। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ভোলায় যেসব সহিংসতা ঘটছে তা নিরোধ করা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর এই প্রতিপাদ্যের মূলে ‘কুফা’ নিয়ে আশঙ্কা। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে নিজস্ব সময়সূচি বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি এই ‘কুফা’ লাগাকে দায়ী করেছেন। ভোলায় কি তিনি একটি কুফা-মুক্ত নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবেন? নাকি কুফার প্রভাবে নির্বাচনটি বিতর্কিত হবে?
বাংলা একাডেমী ও সংসদ অভিধানে ‘কুফা’ শব্দটি খুঁজে পেলাম না। শনির গ্রহের প্রভাব অথবা তুঙ্গে বৃহস্পতি প্রভৃতি শব্দ শিক্ষিত মহলে এবং যাঁরা জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বাসী, তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কাজে ব্যর্থতা ও সাফল্যের অজুহাতে ব্যবহার করেন। তবে অশিক্ষিত মহলে কুফা লেগেছে বা জিনের আছর, নজর লেগেছে কথাগুলো বহুল প্রচলিত। কিন্তু আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশন কুফা লাগার দোহাই দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পেছানোর কথা বললেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছি। কুফা বলতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিরা অদৃশ্য অশুভ অপশক্তির প্রভাব বোঝান। আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তায়, অসহায় সংলাপ ও দুর্বলের মিনতিমাখা বক্তব্যে তিনি যে কুফা বলতে সিটি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণায় সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা বলছেন, এমনটিই ব্যাখ্যা করা যায়। আর এক দিন পরই বোঝা যাবে এই ‘কুফা’ লেগেছে শুধু কি সিটিতে, নাকি ভোলাতেও। তবে সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর জেনে আশা হচ্ছে, এই কুফার প্রভাব ভোলায় তারা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে। আমার এই আশাবাদ যথার্থ কি না, পরশু দিনই তা বোঝা যাবে।
প্রথমে উপনির্বাচনটিতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে কুফা লেগেছে তার প্রভাব পড়েছে কেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এই উপনির্বাচন নিয়ে প্রথম থেকেই সরকার, বিরোধী দল ও নির্বাচন কমিশন কী ভাবছে, তার আভাস তাদের গত কয়েক সপ্তাহের কথাবার্তা ও কার্যক্রমের খবরের সুবাদে জানতে পারছি। আমার নিজস্ব কৌতূহল ছিল জনগণ কী ভাবছে তা জানার। সেই কারণে নির্বাচন কমিশনার পরম প্রীতিভাজন ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনকে টেলিফোনে বললাম, ‘আমি ভোলা যাব।’ উপনির্বাচনটি কীভাবে পরিচালিত হয় সেটি দেখার কৌতূহলের কারণটি তাঁকে ব্যাখ্যা করিনি। শুধু বলেছি, ‘ভোলায় আরেকটি মাগুরা হবে বলে অনেকে আমার কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই কোনো মাগুরার আগাম প্রস্তুতি চলছে কি না, তা জানতে ভোলা যাব।’ সাখাওয়াত ভাই আমাকে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভোলার রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে তোফায়েল আহমেদের। তাঁকেও বললাম, ‘ভোলা যাব।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, দৃশ্যত সরকারি দলে ও বাহ্যত দলীয় নেত্রী কর্তৃক অবহেলিত অভিজ্ঞ এই ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতার হঠাৎ করে কদর বেড়ে গেছে। দলীয় নেত্রী তাঁকে ভোলা উপনির্বাচন নিয়ে সক্রিয় হতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আওয়ামী লীগ-অন্তঃপ্রাণ তোফায়েল অবশ্য নেত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা করতেন না। এমনিতেই দলীয় প্রার্থীর জন্য এলাকা চষে ফেলতেন। তদুপরি শুনেছি, দলের মনোনয়ন পাওয়া তরুণ প্রার্থী তাঁরই পছন্দের ব্যক্তি। সুতরাং তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদাও ভোলায় উপনির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। সরকারে ও দলে পুনর্মূল্যায়নও হয়তো এই নির্বাচনী ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে।
ভোলা উপনির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে নির্বাচন কমিশন অজ্ঞাত বা জ্ঞাত কারণে এমনিতেই বিলম্ব করেছে। প্রথমেই উপনির্বাচন নাকি পুনর্নির্বাচিত অথবা পরাজিত প্রার্থীকে নির্বাচনী বিধিমতে নির্বাচিত ঘোষণা করা উচিত—এ নিয়ে মতান্তর ছিল। আমি ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াতকে বিলম্বের কারণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর উত্তরটি ‘কই, হাফিজ সাহেব তো কিছু বলছেন না’, আমার মনঃপূত হয়নি। আনুমানিক ১৯৬৪ সালে মৌলবি ফরিদ আহমদ তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কক্সবাজারের একটি উপনির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলা করে জয়ী হয়েছিলেন। সেই কেন্দ্রে উপনির্বাচন বা পুনর্নির্বাচন হয়নি, মৌলবি ফরিদ আহমদকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। হাফিজও এ ধরনের সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন বলে শুনেছি। ভোলা আর কক্সবাজারের নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ কমিশন বোধহয় একই পাল্লায় ওজন করেনি। তাই নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনেরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ হাফিজ শেষ পর্যন্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
বস্তুত, ভোলায় ‘কুফা’ লাগার আশঙ্কা দেখা দেওয়ার মূলে ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন পেছানোর প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনে কুফার প্রভাব। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মহা ভাগ্যবান ব্যক্তি। বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সবার জন্য ভোগান্তি হলেও খোকার জন্য শাপে বর হয়েছে। তাই ভাবছি, অন্তত আরও চার বছর তিনি ‘মেয়র’ পদে বহাল তবিয়তে থাকবেন কি না। আমার এই অদ্ভুত ধারণার মূলে সরকারের একটি বিশেষ মহলের ঘোষণা, ‘বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে আরও চার বছর লাগবে।’ জানি না, ১৪ মাসে সরকার যে সমস্যাটির সমাধানের পথে এক পা-ও এগিয়েছে বলে মনে হয় না, আগামী পাঁচ মাসে জনগণের বিদ্যুৎ-দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘবে অথবা ঢাকার বাসিন্দাদের চুলোয় গ্যাস পরিপূর্ণ মাত্রায় সরবরাহ করতে কতখানি সফল হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, যে কুফার প্রভাবে কমিশন সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃঢ় অবস্থান থেকে বারবার সরে এসেছে, অক্টোবরে তা কি কেটে যাবে? অনেক বাগাড়ম্বর ও হম্বিতম্বি করেও নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার পরও ওয়াদা রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর পর্যন্ত ভরসা করতে পারছে না। ভরসা করছেন যাঁরা আগামী পাঁচ মাসে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস দিতে পারবেন বলে আশান্বিত তাঁদের ওপর। আমি কিন্তু কুফার প্রভাবে নির্বাচন কমিশনের অনাকাঙ্ক্ষিত নতি স্বীকারের মধ্যেও একটি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ইংরেজিতে বলব ‘সিলভার সাইনিং এলং দি ব্ল্যাক ক্লাউড’, মেঘের মাঝে চমকানো বিদ্যুতের ঝলকানি। বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের সংকটে অক্টোবরের মধ্যে পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি কুফামুক্ত হবে এমন প্রচ্ছন্ন আশ্বাস পেয়েছি। আশাবাদী হচ্ছি অন্তত সিটি নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে সরকারের বিদ্যুৎ-পানির সংকট সমাধান প্রচেষ্টায় গতি সঞ্চার হবে। দুর্মুখেরা বলতে পারেন, না হলেই বা কী? ১৪ মাসে যা পাইনি, পাঁচ মাসে তা না পেলে কুফার আছরে অক্টোবরে সিটি করপোরেশন নির্বাচন আবার পেছাতে অসুবিধা কোথায়?
বস্তুত সিটির নির্বাচন নিয়ে কমিশনের ক্ষমতা ও তথাকথিত স্বাধীনতা নিয়ে জনগণের মনে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, ভোলা উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনায় তারই প্রভাব পড়েছিল। নির্বাচন-পূর্ববর্তী কতিপয় ঘটনা সেই সংকট বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ভাবছিলাম, সরেজমিনে নির্বাচন পরিবেশটি কেমন দেখে আসব। শ্রদ্ধাভাজন নির্বাচন কমিশনার ও পরম প্রীতিভাজন তোফায়েল আহমেদের সাদর আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে একাই ভোলা যাব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পত্রপত্রিকায় সহিংসতা আর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার খবর পড়ে যাওয়ার ভাবনা ছেড়ে দিলাম। তদুপরি ‘বহিরাগতদের’ বের করে দেওয়া হবে শোনার পর তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য দুই দলের প্রভাবশালী বহিরাগত ব্যক্তিরা এলাকা ছাড়লেও তাদের রেখে যাওয়া অজানা ও আশ্রিত বহিরাগতদের কমিশন শেষ পর্যন্ত বের করে দিয়েছে কি না, তা ভোটের দিন বোঝা যাবে। এত সবের পরও পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ও জয়-পরাজয়ের গুরুত্ব নিয়ে ভাবনাটি অব্যাহত রয়েছে। এই ভাবনায় জয়-পরাজয়ের প্রভাব ও গুরুত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘একটি আসন না পেলে আমাদের ক্ষমতার হেরফের ঘটবে না।’ আমি তাঁর এই বক্তব্যটির প্রশংসা করি। পরাজিত হলে বিরোধী দল হয়তো বলবে, ক্ষমতাসীন সরকারের জনপ্রিয়তা এখন ক্ষয়িষ্ণু। আমার মতে, ভোলায় একটি নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন হলে পরাজিত হলেও সরকার গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার কারণে এক ধরনের বিজয়ের গৌরব অর্জন করবে। অন্যদিকে ভোলা উপনির্বাচন দুই দলের জন্য ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ এমনটি মনে করার কারণ নেই। ভোলায় হারলে কোনো দলের প্রেস্টিজ পাংচার হবে বলে আমি মনে করি না। ভয় হচ্ছে, স্বচ্ছ ও কারচুপিমুক্ত উপনির্বাচনের ফল স্বচ্ছ হলেও, হারলে ‘কারচুপি’ হয়েছে বলে আন্দোলন করতে না পারলেও, তারা কিছুদিন রাজনৈতিক অঙ্গন গরম রাখতে পারবে। জিতলে তো কথাই নেই, সরকার জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের প্রথম পরীক্ষায় হেরে গেছে বলে উল্লাস করতে পারবে। এর বাইরে ভোলার নির্বাচনী ফলাফলের তেমন গুরুত্ব নেই। বরং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে কমিশনের কুফা অনেকখানি কেটে যাবে।
প্রতিপাদ্য: কুফার কারণে কি না জানি না, বাংলাদেশের প্রায় সব প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয় বিতর্কিত হয়েছেন, নয়তো মেয়াদকাল সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। বর্তমান কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের ওপর আমি পূর্ণ আস্থাবান। ভোলার উপনির্বাচনে কুফা কাটিয়ে তাঁরা এই দুর্ভাগ্যজনক ট্র্যাডিশন তথা অশুভ ঐতিহ্যটির অবসান ঘটাতে পারবেন। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই আমার এই কামনা।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
No comments