বাঘা তেঁতুল-সাংসদভ্রাতা ও মৃগমাংস by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ডব্লিউ এইচ অডেনের একটি কবিতার সম্ভবত শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন এভাবে: ‘এই যে রুটিকে ছিঁড়ি/ একদা এ শস্য ছিল মাঠে।’ গত হপ্তায় হরিণের মাংসগুলো যখন নিপুণ গৃহিণী টেবিলে পরিবেশন করেছেন, ভোক্তাদের মধ্যে কবি থাকলে লিখতে পারতেন: এই যে কাবাব চিবোই/ একদা এ হরিণ ছিল বনে।/
এই তো সেদিন তারা ছুটত তীর-বেগে/ হিংস্র মানুষ দেখে।/ তীক্ষ দাঁতে ছিঁড়ত ঘাস।/ তারপর একদিন বেঘোরে হলো লাশ।/ আমার পাকস্থলী এখন ওদের নিবাস।
১১ এপ্রিলের জাতীয় দৈনিকগুলোর খবরে জানা গেছে: সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার পুলিশ ১০ এপ্রিল রাজবাড়ী আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ কাজী কেরামত আলীর ছোট ভাইয়ের গাড়ি থেকে সুন্দরবনের শিকারনিষিদ্ধ ৪৫ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেছে। খানপুর থেকে একটি সাদা রঙের বিলাসবহুল মাইক্রোবাসযোগে মাংস নিয়ে যাওয়ার পথে চালকসহ গাড়ির ছয় যাত্রীকে আটক করার দুই ঘণ্টা পর তিন লাখ টাকা উেকাচের বিনিময়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গাড়ি তল্লাশি করে ৪৫ কেজি হরিণের মাংস পাওয়া গেলে যাত্রীসহ গাড়ি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বেলা সাড়ে ১১টায় হরিণের মাংস সিজারলিস্ট করে মাইক্রোবাস ও যাত্রীদের স্থানীয় বহুল আলোচিত জাতীয় নেতা হাসানের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
রাস্তার মধ্যে ‘জনতার উপস্থিতিতে পুলিশ গাড়িটি তল্লাশি করলে সিটের নিচে লুকিয়ে রাখা ৪৫ কেজি হরিণের মাংস পাওয়া যায়।’ সাংসদের আদরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ‘ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনীর জঙ্গল এলাকায় আসেন হরিণ শিকার করতে। স্থানীয় কয়েকজন শিকারিকে নিয়ে তিনি গভীর সুন্দরবনে প্রবেশ করে ছয়টি হরিণ শিকার করেন।’ ভাইটির বয়স মাত্র ৩২। চল্লিশের মতো হলে বলতেন, এই হাতে স্টেনগান নিয়ে কত খানসেনাকে খতম করেছি, হরিণ তো কোন ছার।
আগের দিনে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে মোগল বাদশা ও সামন্ত রাজারা শিকার করতেন। এখনকার সামন্তপ্রভুরা তাঁদেরই উত্তরাধিকারী। ধরা না পড়লে এবং পত্রিকায় ঘটনা ফাঁস না হলে, বাড়ি এসে নিজের পরিবারের ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের বলতেন, ছয়টি হরিণই আমি নিজে শিকার করেছি। এক জোড়া হরিণ আর হরিণী দিল দৌড়। এক গুলিতে দুইটাকেই শোয়াইয়া দেই। মিডিয়ার কারণে এখন আর সে গল্প ফাঁদা সম্ভব হবে না।
সাংবাদিকেরা যখন দারোগাকে জানতে চাইলেন, আসামিদের ছেড়ে দিলেন কেন? চাকরিজীবনের পরম সত্য কথাটি দারোগাবাবু বলেন, ‘আমাদের হাত-পা বাঁধা, কিছুই করার নেই।’
করার থাকত। যদি কোনো বিরোধী দলের সাংসদের ভাই বা শালার গাড়িতে ওই মাংস পাওয়া যেত। ৪৫ কেজি পাওয়া গেলে, বলা হতো ১৮২ কেজি মৃগমাংস পাওয়া গেছে। কিছু বাঘের মাংসও ওতে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাড়িওয়ালার কোমরে দড়ি পড়ত। কোর্ট-কাচারি, ম্যাজিস্ট্রেট-পিপি তৎপর হয়ে উঠতেন। মামলা হওয়ার আগেই ম্যাজিস্ট্রেট জামিনের আবেদন নাকচ করে দিতেন। এখন হয়তো বলা হবে, ও তো স্রেফ ছাগলের গোশত। ভেড়িরও হতে পারে।
হরিণের মাংসের নানা রকম রেসিপি আছে। রেজালা বা কোফতা, হরিণের রানের ভুনা কাবাব, স্টু, কালিয়া প্রভৃতি। হরিণের কলিজার ভুনা নাকি খুবই মজা। শুনেছি, হরিণের পায়ার স্যুপ খেলে পায়ে অসম্ভব জোর আসে এবং দৌড়ের গতি বাড়ে। সুতরাং হরিণের পায়ার স্যুপ খাওয়া দরকার টেন্ডার জমা দেওয়ার এক হপ্তা আগে থেকে ঠিকাদারদের।
সরকারি অনুমতি ছাড়া বন্য প্রাণী ধরা, হত্যা বা শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯২৭ সালের সরকারি বনজ সম্পদ রক্ষা আইনে বন্য প্রাণীসংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি খুবই কম। সেটুকু হলেই মন্দ কি! খুব বেশি দিন গণ্যমান্যদের জেলখানায় রাখা অভদ্রতা। সপ্তাহখানেক জেলে ঢুকিয়ে রাখলেও বনভূমিগুলো হরিণশূন্য হতো না।
আমাদের পুলিশের আইজি যে হারে এসপি ও ওসিদের অপরাধ দমনে কঠোর হতে হুকুম দিচ্ছেন এবং তাঁরা অপরাধ দমনে ব্যর্থ হলে কঠিন শাস্তির ভয় দেখাচ্ছেন, তাতে ধারণা করি, আমার এই লেখা প্রকাশের আগেই মৃগমাংসওয়ালা ভাইকে বিচারিক আদালতে সোপর্দ করেছেন। কাগজে রিপোর্ট হওয়ার পরও যদি ওই মাংস দিয়ে দোপেঁয়াজা রান্না হয়ে থাকে, তাহলে বুঝব অপরাধীদের কাজকর্ম আমরা ততটা উপভোগ করি, যতটা মৃগমাংসের দোপেঁয়াজা উপভোগ্য।
সাংসদের ভাই যদি আইনের ঊর্ধ্বে হন, মন্ত্রীর ভায়রাবেটা কেন আইনের তোয়াক্কা করবেন? ভাইবোন, ভাগিনা-ভাতিজা, শ্বশুর-শ্যালক, ভায়রা বা শালি আজ আর কোনো রক্তসম্পর্কীয় বা বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয় নন। তাঁরা বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। যেমন সাংসদের ভাই পদাধিকারবলে ডেপুটি সাংসদ। তাঁর ভাগিনা বা শালি সহকারী সাংসদ। কোনো মন্ত্রীর খালুশ্বশুর বা এপিএসের মর্যাদা সাব-অ্যাসিসট্যান্ট মিনিস্টারের।
এর নাম গণতন্ত্র নয়—আইনের শাসন তো নয়ই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
১১ এপ্রিলের জাতীয় দৈনিকগুলোর খবরে জানা গেছে: সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার পুলিশ ১০ এপ্রিল রাজবাড়ী আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ কাজী কেরামত আলীর ছোট ভাইয়ের গাড়ি থেকে সুন্দরবনের শিকারনিষিদ্ধ ৪৫ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেছে। খানপুর থেকে একটি সাদা রঙের বিলাসবহুল মাইক্রোবাসযোগে মাংস নিয়ে যাওয়ার পথে চালকসহ গাড়ির ছয় যাত্রীকে আটক করার দুই ঘণ্টা পর তিন লাখ টাকা উেকাচের বিনিময়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গাড়ি তল্লাশি করে ৪৫ কেজি হরিণের মাংস পাওয়া গেলে যাত্রীসহ গাড়ি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বেলা সাড়ে ১১টায় হরিণের মাংস সিজারলিস্ট করে মাইক্রোবাস ও যাত্রীদের স্থানীয় বহুল আলোচিত জাতীয় নেতা হাসানের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
রাস্তার মধ্যে ‘জনতার উপস্থিতিতে পুলিশ গাড়িটি তল্লাশি করলে সিটের নিচে লুকিয়ে রাখা ৪৫ কেজি হরিণের মাংস পাওয়া যায়।’ সাংসদের আদরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ‘ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনীর জঙ্গল এলাকায় আসেন হরিণ শিকার করতে। স্থানীয় কয়েকজন শিকারিকে নিয়ে তিনি গভীর সুন্দরবনে প্রবেশ করে ছয়টি হরিণ শিকার করেন।’ ভাইটির বয়স মাত্র ৩২। চল্লিশের মতো হলে বলতেন, এই হাতে স্টেনগান নিয়ে কত খানসেনাকে খতম করেছি, হরিণ তো কোন ছার।
আগের দিনে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে মোগল বাদশা ও সামন্ত রাজারা শিকার করতেন। এখনকার সামন্তপ্রভুরা তাঁদেরই উত্তরাধিকারী। ধরা না পড়লে এবং পত্রিকায় ঘটনা ফাঁস না হলে, বাড়ি এসে নিজের পরিবারের ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের বলতেন, ছয়টি হরিণই আমি নিজে শিকার করেছি। এক জোড়া হরিণ আর হরিণী দিল দৌড়। এক গুলিতে দুইটাকেই শোয়াইয়া দেই। মিডিয়ার কারণে এখন আর সে গল্প ফাঁদা সম্ভব হবে না।
সাংবাদিকেরা যখন দারোগাকে জানতে চাইলেন, আসামিদের ছেড়ে দিলেন কেন? চাকরিজীবনের পরম সত্য কথাটি দারোগাবাবু বলেন, ‘আমাদের হাত-পা বাঁধা, কিছুই করার নেই।’
করার থাকত। যদি কোনো বিরোধী দলের সাংসদের ভাই বা শালার গাড়িতে ওই মাংস পাওয়া যেত। ৪৫ কেজি পাওয়া গেলে, বলা হতো ১৮২ কেজি মৃগমাংস পাওয়া গেছে। কিছু বাঘের মাংসও ওতে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাড়িওয়ালার কোমরে দড়ি পড়ত। কোর্ট-কাচারি, ম্যাজিস্ট্রেট-পিপি তৎপর হয়ে উঠতেন। মামলা হওয়ার আগেই ম্যাজিস্ট্রেট জামিনের আবেদন নাকচ করে দিতেন। এখন হয়তো বলা হবে, ও তো স্রেফ ছাগলের গোশত। ভেড়িরও হতে পারে।
হরিণের মাংসের নানা রকম রেসিপি আছে। রেজালা বা কোফতা, হরিণের রানের ভুনা কাবাব, স্টু, কালিয়া প্রভৃতি। হরিণের কলিজার ভুনা নাকি খুবই মজা। শুনেছি, হরিণের পায়ার স্যুপ খেলে পায়ে অসম্ভব জোর আসে এবং দৌড়ের গতি বাড়ে। সুতরাং হরিণের পায়ার স্যুপ খাওয়া দরকার টেন্ডার জমা দেওয়ার এক হপ্তা আগে থেকে ঠিকাদারদের।
সরকারি অনুমতি ছাড়া বন্য প্রাণী ধরা, হত্যা বা শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯২৭ সালের সরকারি বনজ সম্পদ রক্ষা আইনে বন্য প্রাণীসংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি খুবই কম। সেটুকু হলেই মন্দ কি! খুব বেশি দিন গণ্যমান্যদের জেলখানায় রাখা অভদ্রতা। সপ্তাহখানেক জেলে ঢুকিয়ে রাখলেও বনভূমিগুলো হরিণশূন্য হতো না।
আমাদের পুলিশের আইজি যে হারে এসপি ও ওসিদের অপরাধ দমনে কঠোর হতে হুকুম দিচ্ছেন এবং তাঁরা অপরাধ দমনে ব্যর্থ হলে কঠিন শাস্তির ভয় দেখাচ্ছেন, তাতে ধারণা করি, আমার এই লেখা প্রকাশের আগেই মৃগমাংসওয়ালা ভাইকে বিচারিক আদালতে সোপর্দ করেছেন। কাগজে রিপোর্ট হওয়ার পরও যদি ওই মাংস দিয়ে দোপেঁয়াজা রান্না হয়ে থাকে, তাহলে বুঝব অপরাধীদের কাজকর্ম আমরা ততটা উপভোগ করি, যতটা মৃগমাংসের দোপেঁয়াজা উপভোগ্য।
সাংসদের ভাই যদি আইনের ঊর্ধ্বে হন, মন্ত্রীর ভায়রাবেটা কেন আইনের তোয়াক্কা করবেন? ভাইবোন, ভাগিনা-ভাতিজা, শ্বশুর-শ্যালক, ভায়রা বা শালি আজ আর কোনো রক্তসম্পর্কীয় বা বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয় নন। তাঁরা বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। যেমন সাংসদের ভাই পদাধিকারবলে ডেপুটি সাংসদ। তাঁর ভাগিনা বা শালি সহকারী সাংসদ। কোনো মন্ত্রীর খালুশ্বশুর বা এপিএসের মর্যাদা সাব-অ্যাসিসট্যান্ট মিনিস্টারের।
এর নাম গণতন্ত্র নয়—আইনের শাসন তো নয়ই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments