হৃদয়নন্দন বনে-ওরা ওদের ধ্বংসে মাতুক_ আমি পড়ে রই সৃজন নিয়ে by আলী যাকের
আশাবাদী মানুষরা অবশ্যই বাঁচেন। খুশবন্তের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। যেসব মানুষ ৮০ কিংবা ৯০ বছরে পেঁৗছেও, শারীরিক নানা রোগ-জরা থাকা সত্ত্বেও, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা জেনেও, হৈহৈ করে জীবনকে উপভোগ করতে পারেন, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে জীবনকে সবদিক থেকে উপভোগ করার বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে আসে।
আরও একটি ব্যাপার হলো, এসব মানুষের বয়স যতই হোক না কেন, তাদের সৃজনশীল মন সর্বদাই তরুণ থাকে
সম্প্রতি আমার এক অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু চলে গেল। ত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব। অথচ চলে যাওয়া? কয়েক মুহূর্তেই! আমার ঘনিষ্ঠ অনেক মানুষকেই বিভিন্ন সময় হারিয়েছি আমি। একটা সময় ছিল যখন বয়সে অনেক বড় বন্ধুরা পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন; তখন দুঃখ হতো বটে, কিন্তু এও মনে হতো যে, ওদের চলে যাওয়ার বয়স তো হয়েছেই। এ তো প্রকৃতির নিয়ম। তারপর আস্তে আস্তে আমার নিজের বয়স যখন বাড়তে লাগল তখন যারা প্রয়াত হচ্ছেন তাদের সঙ্গে আমার বয়সের ফারাকটা কমতে লাগল। আর এখন তো এমন হয়েছে যে, আমারই সমবয়সীরা কিংবা দু'চার বছরের ছোট মানুষগুলো দিব্যি চলে যাচ্ছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। এ তো অবধারিত সত্য। আমার মনে হয়, একজন মানুষ যখন ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ে তখন তার জীবনে মৃত্যুর আগমন ঘটে পরম সুখনিদ্রার প্রশান্তি নিয়ে। অতএব এ নিয়ে আমি খুব বেশি একটা ভাবি না।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেই প্রায় দুই যুগ আগে ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট, লেখক খুশবন্ত সিংয়ের একটি লেখার কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি কলকাতার সানডে সাময়িকীতে প্রতি সংখ্যায় 'গসিপ : সুইট অ্যান্ড সাওয়ার' বলে একটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী কলাম লিখতেন। এই গল্পটি অনেকটা এ রকম ছিল :
"সুইজারল্যান্ডের কোনো এক শৈলাবাসে একটি বৃদ্ধাশ্রম ছিল, যেখানে ১২ জন অশীতিপর বৃদ্ধ বাস করতেন। তাদের স্বাস্থ্য ছিল চমৎকার। তারা একে অন্যের সানি্নধ্যে অনেক আনন্দে সময় পার করতেন। রোজ সূর্যোদয়ের সময় ঘুম থেকে উঠে যার যার প্রার্থনা সেরে একসঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। পায়ে চলা পথের দু'পাশে রঙবেরঙের ফুল তাদের সম্ভাষণ জানাত। প্রাতঃভ্রমণ শেষে ক্ষুধার্ত এই বৃদ্ধের দল একসঙ্গে প্রাতরাশ করতেন। এরপর যার যার দৈনিক অভ্যাস অনুযায়ী প্রিয় কাজগুলো করতেন। কেউ লিখতেন। কেউ ছবি আঁকতেন। কোনো দুই বন্ধু দাবা খেলতেন অথবা প্রিয় বই হাতে করে বাগানের ঘাসের ওপর বসে স্বাদু লেখা পরম আগ্রহে পড়তেন। দুপুরে আহারের পর কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রা। এরপর বৃদ্ধাশ্রমের ডাক্তার সবাইকে দেখে বলতেন, এই বয়সে এ রকম স্বাস্থ্য কল্পনাও করা যায় না। সেই আনন্দ নিয়ে তারা আবার বাগানে বেরিয়ে পড়তেন হাঁটার জন্য। সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই নৈশভোজ। তারপর কিছু সময় টেলিভিশন দেখা এবং অতঃপর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়া। এভাবে নিষ্কণ্টক, নিরুপদ্রব দিন গুজরান হচ্ছিল ওই অশীতিপর বৃদ্ধের দলের। হঠাৎ একদিন রাত ৮টায় তাদের মধ্যে একজনের কাছে একটি টেলিফোন এলো। সন্তানরা কেউ ফোন করেছে, এই ভেবে সেই বৃদ্ধ টেলিফোন ধরলেন। ওপাশ থেকে ভাবগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কেউ একজন বলল, 'তুমি তো আশি পেরোলে। এখনও ভাবছ ভালোই আছ? ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখ, ওই যে মৃত্যু তোমার জন্য আশপাশেই রয়েছে অপেক্ষায়।' বৃদ্ধ কিছু বলার আগেই অন্য প্রান্ত থেকে টেলিফোনটা কেটে
দেওয়া হলো।
সেই রাতে বৃদ্ধের চোখে ঘুম এলো না। তিনি সারারাত এপাশ-ওপাশ ছটফট করে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে সকালবেলায় উঠে বসলেন। বাথরুমের আয়নায় প্রতিফলিত নিজের চেহারাকে বৃদ্ধ আর চিনতে পারেন না। এ কি সেই ব্যক্তি যাকে তিনি গতকাল সকালে দেখেছেন? এই আয়নাতেই? তিনি আবার তাকান। আবার মর্মাহত হন। নিমিষেই তার সব আশা তাকে ছেড়ে কোন সুদূরে হারিয়ে যায় যেন। সেদিন তিনি আর তার সঙ্গীদের সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণ, প্রাতরাশ কিংবা দৈনন্দিন কোনো কাজকর্মই করেন না। প্রতি মুহূর্তেই তার মনে পড়ে টেলিফোনের সেই অমোঘ, ভাবগম্ভীর বাক্য_ 'ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখ, ওই যে মৃত্যু তোমার জন্য আশপাশেই রয়েছে অপেক্ষায়।' কী আশ্চর্য! সপ্রাণ এই বৃদ্ধ এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল কেউ বলতে পারে না, কী এই ব্যাধি। এরপর সাত দিনের মাথায় তার প্রাণবায়ু কঙ্কালসার দেহটি ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে যায়।
অষ্টম দিনে আরেক অশীতিপর ভদ্রলোকের কাছে একটি টেলিফোন বার্তা আসে। এই ব্যক্তিকেও সেই রকম ভাবগম্ভীর কণ্ঠে কেউ ওই একই কথা বলে, যা সদ্য প্রয়াত মানুষটিকে বলা হয়েছিল সাত দিন আগে। এই বৃদ্ধেরও প্রথমজনের মতোই অবস্থা হয় এবং সপ্তম দিনে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ১২ সপ্তাহে ১২ জন তরতাজা, সুখী বৃদ্ধ একে একে পরকালের পথে পাড়ি জমান।"
আমার যতদূর মনে পড়ে খুশবন্তের বয়স তখন আশি কিংবা তার কাছাকাছি। আমার স্মরণশক্তি দুর্বল বিধায় ভুলও হতে পারে। খুশবন্ত এই কলামটির শেষে লিখেছিলেন যে, তারও সময় ঘনিয়ে এলো, ওই বৃদ্ধদের মতোই মৃত্যু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। যার ফল অনিবার্য_ মৃত্যুতেই যার অবসান। তবে আশিতে পেঁৗছে তিনি জীবন নিয়ে ভাবতে চান আরও নিবিড়ভাবে, মৃত্যু নিয়ে নয়; যেন যত ভয়ই দেখানো হোক না কেন, মৃত্যুচিন্তা তাকে সহজে কাবু করতে না পারে। তিনি তার চিরায়ত সঙ্গী সন্ধ্যার দু'পেগ স্কচের কথাও উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই সঙ্গীই তাকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখবে সব দুশ্চিন্তা থেকে। খুশবন্তের এই দর্শনে কিছু সত্য হয়তো ছিল। আর না হলে দিব্যি বহাল-তবিয়তে বেঁচে রয়েছেন তিনি, লিখছেন এখন-তখন, এই ৯৭ বছর বয়সেও!
আশাবাদী মানুষরা অবশ্যই বাঁচেন। খুশবন্তের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। যেসব মানুষ ৮০ কিংবা ৯০ বছরে পেঁৗছেও, শারীরিক নানা রোগ-জরা থাকা সত্ত্বেও, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা জেনেও, হৈহৈ করে জীবনকে উপভোগ করতে পারেন, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে জীবনকে সবদিক থেকে উপভোগ করার বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে আসে। আরও একটি ব্যাপার হলো, এসব মানুষের বয়স যতই হোক না কেন, তাদের সৃজনশীল মন সর্বদাই তরুণ থাকে। আমার মতো একজন অকিঞ্চিৎকর সাংস্কৃতিক কর্মীর তেমন জীবনীশক্তি নেই, যাতে করে খুশবন্তের মতো দীর্ঘায়ু আমি হতে পারি। আর দীর্ঘ আয়ু পেলে জগৎ সংসারের কী এমন লাভ হবে আমার দ্বারা, সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই! তবে জীবনের ৬৭টি বসন্ত অবলীলায় কাটিয়ে দিয়ে এইটুকু প্রত্যয় হয়তো হয়েছে যে, আর যে কয়দিনই বাঁচি না কেন একেবারে বর্ণহীন, জীবনীশক্তিহীন, সৃজনশীলতাহীন হয়ে বাঁচব না। খুশবন্তকে অনুপ্রেরণা দেয় তার বর্ণময় জীবন এবং সেই বর্ণে, তিনি যেমন বলেছেন, তার অতি প্রিয় স্কচের রয়েছে একটি বিশেষ ভূমিকা। আমার জীবনে ওই ধরনের কোনো বিশেষ রসের কোনো বিশিষ্ট অবদান নেই। আমার জীবনে জীবন যোগ করে নিসর্গ।
একবার কথা প্রসঙ্গে আমি আমার অতি ঘনিষ্ঠ বড় ভাইকে বলেছিলাম, 'আচ্ছা, তুমি কেন এত বিষণ্ন থাক?' তিনি বলেছিলেন, 'নানা রকম ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয়, তাই।' জীবনে চলার পথে নানা রকম ঝুটঝামেলা নিত্যই আমাদের বিব্রত করে, বিরক্ত করে। আমি এই বিরক্তি থেকে, এই একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছি। সকালে উঠে আমার জানালার আলসেতে রাখা ক্যাকটাসের টবের গোড়ায় একটি নতুন, প্রাণময়, ডগমগে গজিয়ে ওঠা ঘাস যখন আমি দেখি, আমার মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে; ওই তো ধান-শালিকটাও এসে জুটেছে আমার আলসের ওপর। আসলে আমার মনে হয়, আমাদের সবারই এ ধরনের আপাত তুচ্ছ বিষয়গুলো থেকে আনন্দ আহরণ করার একটা উপায় বের করে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে খুব সহজেই নিজেকে নিয়ে, ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিয়ে কিংবা নিসর্গকে নিয়ে একটি মানুষ তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত দিব্যি আনন্দে বেঁচে থাকতে পারে। বেঁচে থাকতে পারে গুজবের কারণে গার্মেন্ট পল্লী রণক্ষেত্র হয়ে উঠলেও। বেঁচে থাকতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতে সারা শহর দাউদাউ করে জ্বললেও। বেঁচে থাকতে পারে এ ধরনের অপঘাতে নিজের মৃত্যু অনিবার্য জানা থাকলেও। রবীন্দ্রনাথের মতো যদি ভাবা যায়, 'আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে।' যদি এ ধরনের আদান-প্রদানে নিজেকে নিয়োজিত রাখা যায়, তাহলে অনভিপ্রেত কোনো ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। যখন চড়ূই খেলা করে আমার টবে সংরক্ষিত গাছগুলোর সঙ্গে, আমি সহজেই ভুলে যেতে পারি স্বার্থপর রাজনীতিবিদদের অবিমৃষ্যকারিতা। আমি ভুলে যেতে পারি গুজবনির্ভর মানুষের আহাম্মকি। আমি ভুলে যেতে পারি 'নাই কাজ তো খই ভাজ'কে। ওরা ওদের ধ্বংসে মাতুক_ আমি পড়ে রই সৃজন নিয়ে।
(আজ থেকে 'ধর নির্ভয় গান'কে দিলাম ছুটি। একটু হৃদয়বৃত্তির দিকে চোখ ফেরাই। অতএব, আমার এই কলামের শিরোনামে পরিবর্তন। এখন থেকে হৃদয়নন্দন বনে ঘুরে ঘুরে কুড়িয়ে আনা নানা পুষ্প দিয়ে আমি ডালি সাজাব আমার পাঠকদের জন্য। আশা করি, আপনাদের ভালো লাগবে। _আলী যাকের)
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সম্প্রতি আমার এক অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু চলে গেল। ত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব। অথচ চলে যাওয়া? কয়েক মুহূর্তেই! আমার ঘনিষ্ঠ অনেক মানুষকেই বিভিন্ন সময় হারিয়েছি আমি। একটা সময় ছিল যখন বয়সে অনেক বড় বন্ধুরা পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন; তখন দুঃখ হতো বটে, কিন্তু এও মনে হতো যে, ওদের চলে যাওয়ার বয়স তো হয়েছেই। এ তো প্রকৃতির নিয়ম। তারপর আস্তে আস্তে আমার নিজের বয়স যখন বাড়তে লাগল তখন যারা প্রয়াত হচ্ছেন তাদের সঙ্গে আমার বয়সের ফারাকটা কমতে লাগল। আর এখন তো এমন হয়েছে যে, আমারই সমবয়সীরা কিংবা দু'চার বছরের ছোট মানুষগুলো দিব্যি চলে যাচ্ছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। এ তো অবধারিত সত্য। আমার মনে হয়, একজন মানুষ যখন ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ে তখন তার জীবনে মৃত্যুর আগমন ঘটে পরম সুখনিদ্রার প্রশান্তি নিয়ে। অতএব এ নিয়ে আমি খুব বেশি একটা ভাবি না।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেই প্রায় দুই যুগ আগে ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট, লেখক খুশবন্ত সিংয়ের একটি লেখার কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি কলকাতার সানডে সাময়িকীতে প্রতি সংখ্যায় 'গসিপ : সুইট অ্যান্ড সাওয়ার' বলে একটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী কলাম লিখতেন। এই গল্পটি অনেকটা এ রকম ছিল :
"সুইজারল্যান্ডের কোনো এক শৈলাবাসে একটি বৃদ্ধাশ্রম ছিল, যেখানে ১২ জন অশীতিপর বৃদ্ধ বাস করতেন। তাদের স্বাস্থ্য ছিল চমৎকার। তারা একে অন্যের সানি্নধ্যে অনেক আনন্দে সময় পার করতেন। রোজ সূর্যোদয়ের সময় ঘুম থেকে উঠে যার যার প্রার্থনা সেরে একসঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। পায়ে চলা পথের দু'পাশে রঙবেরঙের ফুল তাদের সম্ভাষণ জানাত। প্রাতঃভ্রমণ শেষে ক্ষুধার্ত এই বৃদ্ধের দল একসঙ্গে প্রাতরাশ করতেন। এরপর যার যার দৈনিক অভ্যাস অনুযায়ী প্রিয় কাজগুলো করতেন। কেউ লিখতেন। কেউ ছবি আঁকতেন। কোনো দুই বন্ধু দাবা খেলতেন অথবা প্রিয় বই হাতে করে বাগানের ঘাসের ওপর বসে স্বাদু লেখা পরম আগ্রহে পড়তেন। দুপুরে আহারের পর কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রা। এরপর বৃদ্ধাশ্রমের ডাক্তার সবাইকে দেখে বলতেন, এই বয়সে এ রকম স্বাস্থ্য কল্পনাও করা যায় না। সেই আনন্দ নিয়ে তারা আবার বাগানে বেরিয়ে পড়তেন হাঁটার জন্য। সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই নৈশভোজ। তারপর কিছু সময় টেলিভিশন দেখা এবং অতঃপর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়া। এভাবে নিষ্কণ্টক, নিরুপদ্রব দিন গুজরান হচ্ছিল ওই অশীতিপর বৃদ্ধের দলের। হঠাৎ একদিন রাত ৮টায় তাদের মধ্যে একজনের কাছে একটি টেলিফোন এলো। সন্তানরা কেউ ফোন করেছে, এই ভেবে সেই বৃদ্ধ টেলিফোন ধরলেন। ওপাশ থেকে ভাবগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কেউ একজন বলল, 'তুমি তো আশি পেরোলে। এখনও ভাবছ ভালোই আছ? ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখ, ওই যে মৃত্যু তোমার জন্য আশপাশেই রয়েছে অপেক্ষায়।' বৃদ্ধ কিছু বলার আগেই অন্য প্রান্ত থেকে টেলিফোনটা কেটে
দেওয়া হলো।
সেই রাতে বৃদ্ধের চোখে ঘুম এলো না। তিনি সারারাত এপাশ-ওপাশ ছটফট করে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে সকালবেলায় উঠে বসলেন। বাথরুমের আয়নায় প্রতিফলিত নিজের চেহারাকে বৃদ্ধ আর চিনতে পারেন না। এ কি সেই ব্যক্তি যাকে তিনি গতকাল সকালে দেখেছেন? এই আয়নাতেই? তিনি আবার তাকান। আবার মর্মাহত হন। নিমিষেই তার সব আশা তাকে ছেড়ে কোন সুদূরে হারিয়ে যায় যেন। সেদিন তিনি আর তার সঙ্গীদের সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণ, প্রাতরাশ কিংবা দৈনন্দিন কোনো কাজকর্মই করেন না। প্রতি মুহূর্তেই তার মনে পড়ে টেলিফোনের সেই অমোঘ, ভাবগম্ভীর বাক্য_ 'ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখ, ওই যে মৃত্যু তোমার জন্য আশপাশেই রয়েছে অপেক্ষায়।' কী আশ্চর্য! সপ্রাণ এই বৃদ্ধ এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল কেউ বলতে পারে না, কী এই ব্যাধি। এরপর সাত দিনের মাথায় তার প্রাণবায়ু কঙ্কালসার দেহটি ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে যায়।
অষ্টম দিনে আরেক অশীতিপর ভদ্রলোকের কাছে একটি টেলিফোন বার্তা আসে। এই ব্যক্তিকেও সেই রকম ভাবগম্ভীর কণ্ঠে কেউ ওই একই কথা বলে, যা সদ্য প্রয়াত মানুষটিকে বলা হয়েছিল সাত দিন আগে। এই বৃদ্ধেরও প্রথমজনের মতোই অবস্থা হয় এবং সপ্তম দিনে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ১২ সপ্তাহে ১২ জন তরতাজা, সুখী বৃদ্ধ একে একে পরকালের পথে পাড়ি জমান।"
আমার যতদূর মনে পড়ে খুশবন্তের বয়স তখন আশি কিংবা তার কাছাকাছি। আমার স্মরণশক্তি দুর্বল বিধায় ভুলও হতে পারে। খুশবন্ত এই কলামটির শেষে লিখেছিলেন যে, তারও সময় ঘনিয়ে এলো, ওই বৃদ্ধদের মতোই মৃত্যু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। যার ফল অনিবার্য_ মৃত্যুতেই যার অবসান। তবে আশিতে পেঁৗছে তিনি জীবন নিয়ে ভাবতে চান আরও নিবিড়ভাবে, মৃত্যু নিয়ে নয়; যেন যত ভয়ই দেখানো হোক না কেন, মৃত্যুচিন্তা তাকে সহজে কাবু করতে না পারে। তিনি তার চিরায়ত সঙ্গী সন্ধ্যার দু'পেগ স্কচের কথাও উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই সঙ্গীই তাকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখবে সব দুশ্চিন্তা থেকে। খুশবন্তের এই দর্শনে কিছু সত্য হয়তো ছিল। আর না হলে দিব্যি বহাল-তবিয়তে বেঁচে রয়েছেন তিনি, লিখছেন এখন-তখন, এই ৯৭ বছর বয়সেও!
আশাবাদী মানুষরা অবশ্যই বাঁচেন। খুশবন্তের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। যেসব মানুষ ৮০ কিংবা ৯০ বছরে পেঁৗছেও, শারীরিক নানা রোগ-জরা থাকা সত্ত্বেও, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা জেনেও, হৈহৈ করে জীবনকে উপভোগ করতে পারেন, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে জীবনকে সবদিক থেকে উপভোগ করার বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে আসে। আরও একটি ব্যাপার হলো, এসব মানুষের বয়স যতই হোক না কেন, তাদের সৃজনশীল মন সর্বদাই তরুণ থাকে। আমার মতো একজন অকিঞ্চিৎকর সাংস্কৃতিক কর্মীর তেমন জীবনীশক্তি নেই, যাতে করে খুশবন্তের মতো দীর্ঘায়ু আমি হতে পারি। আর দীর্ঘ আয়ু পেলে জগৎ সংসারের কী এমন লাভ হবে আমার দ্বারা, সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই! তবে জীবনের ৬৭টি বসন্ত অবলীলায় কাটিয়ে দিয়ে এইটুকু প্রত্যয় হয়তো হয়েছে যে, আর যে কয়দিনই বাঁচি না কেন একেবারে বর্ণহীন, জীবনীশক্তিহীন, সৃজনশীলতাহীন হয়ে বাঁচব না। খুশবন্তকে অনুপ্রেরণা দেয় তার বর্ণময় জীবন এবং সেই বর্ণে, তিনি যেমন বলেছেন, তার অতি প্রিয় স্কচের রয়েছে একটি বিশেষ ভূমিকা। আমার জীবনে ওই ধরনের কোনো বিশেষ রসের কোনো বিশিষ্ট অবদান নেই। আমার জীবনে জীবন যোগ করে নিসর্গ।
একবার কথা প্রসঙ্গে আমি আমার অতি ঘনিষ্ঠ বড় ভাইকে বলেছিলাম, 'আচ্ছা, তুমি কেন এত বিষণ্ন থাক?' তিনি বলেছিলেন, 'নানা রকম ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয়, তাই।' জীবনে চলার পথে নানা রকম ঝুটঝামেলা নিত্যই আমাদের বিব্রত করে, বিরক্ত করে। আমি এই বিরক্তি থেকে, এই একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছি। সকালে উঠে আমার জানালার আলসেতে রাখা ক্যাকটাসের টবের গোড়ায় একটি নতুন, প্রাণময়, ডগমগে গজিয়ে ওঠা ঘাস যখন আমি দেখি, আমার মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে; ওই তো ধান-শালিকটাও এসে জুটেছে আমার আলসের ওপর। আসলে আমার মনে হয়, আমাদের সবারই এ ধরনের আপাত তুচ্ছ বিষয়গুলো থেকে আনন্দ আহরণ করার একটা উপায় বের করে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে খুব সহজেই নিজেকে নিয়ে, ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিয়ে কিংবা নিসর্গকে নিয়ে একটি মানুষ তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত দিব্যি আনন্দে বেঁচে থাকতে পারে। বেঁচে থাকতে পারে গুজবের কারণে গার্মেন্ট পল্লী রণক্ষেত্র হয়ে উঠলেও। বেঁচে থাকতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতে সারা শহর দাউদাউ করে জ্বললেও। বেঁচে থাকতে পারে এ ধরনের অপঘাতে নিজের মৃত্যু অনিবার্য জানা থাকলেও। রবীন্দ্রনাথের মতো যদি ভাবা যায়, 'আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে।' যদি এ ধরনের আদান-প্রদানে নিজেকে নিয়োজিত রাখা যায়, তাহলে অনভিপ্রেত কোনো ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। যখন চড়ূই খেলা করে আমার টবে সংরক্ষিত গাছগুলোর সঙ্গে, আমি সহজেই ভুলে যেতে পারি স্বার্থপর রাজনীতিবিদদের অবিমৃষ্যকারিতা। আমি ভুলে যেতে পারি গুজবনির্ভর মানুষের আহাম্মকি। আমি ভুলে যেতে পারি 'নাই কাজ তো খই ভাজ'কে। ওরা ওদের ধ্বংসে মাতুক_ আমি পড়ে রই সৃজন নিয়ে।
(আজ থেকে 'ধর নির্ভয় গান'কে দিলাম ছুটি। একটু হৃদয়বৃত্তির দিকে চোখ ফেরাই। অতএব, আমার এই কলামের শিরোনামে পরিবর্তন। এখন থেকে হৃদয়নন্দন বনে ঘুরে ঘুরে কুড়িয়ে আনা নানা পুষ্প দিয়ে আমি ডালি সাজাব আমার পাঠকদের জন্য। আশা করি, আপনাদের ভালো লাগবে। _আলী যাকের)
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments