আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৬)-বাংলাদেশের পতাকা by আলী যাকের
পরের দিন ওই একই মানসিক অবস্থা নিয়ে বেতারকেন্দ্রে গেলাম। দেখা হয় হাসান ইমামের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'একটা খবর আছে রে।' 'আবার কী?' কর্কশ স্বরে প্রায় চিৎকার করে উঠি। হাসান ইমাম বলেন, 'সেদিন যে ছেলেটি মারা গেছে, সে আমাদের মাহবুব না।' একটা প্রচণ্ড ভার যেন নেমে যায় আমার বুক থেকে। তারপর প্রচণ্ড গ্লানি বোধ হয়।
ছিঃ, এ কেমন মনোবৃত্তি আমার? এই মাহবুব আমাদের মাহবুব না বলেই আমরা পুলকিত এখন? অকুতোভয় এক সৈনিক। জীবনপণ যুদ্ধ করে হয়েছেন শহীদ। তিনিও তো কোনো বাঙালি মা-বাবার সন্তান! কেবল তাঁকে আমি চিনি না বলে বোধকে একেবারেই বিচলিত করছে না এই অকাল মৃত্যু, এ কেমন কথা?
পর দিন একটি যুদ্ধ প্রতিবেদনের বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করলাম আমি। আলমগীর কবিরকে পরিকল্পনাটি সম্পর্কে অবহিত করি। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে যে সাব-সেক্টর কমান্ডগুলো, সেগুলোর কমান্ডারদের সাক্ষাৎকার নেব আমি। এখানে তখন দাপটে যুদ্ধ করছেন ৮ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা। আলমগীর কবিরের সম্মতি পাওয়া গেল। ওই সাব-সেক্টরের কয়েক গজ দূরেই মুক্ত বাংলাদেশ। ওই সাব-সেক্টরের যিনি সেনাপতি তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'বাংলাদেশে যাবেন?' 'অবশ্যই!' 'চলুন।' আমাকে আত্মরক্ষার জন্য একটা স্টেনগান দেওয়া হয়। নলে অজস্র ফুটোওয়ালা এই অস্ত্রগুলোকে বলা হতো স্টার্লিং স্টেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের দ্বারা এই অস্ত্রের উদ্ভাবন।
অস্ত্র হাতে আমার মনে হয়, আমি যেন মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়েছি একজন সম্মুখ সমরে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধায়। এগিয়ে যাই আমরা তিন-চারজন। আমাদের সবার আগে সাব-সেক্টর কমান্ডার। শ তিনেক গজ দূরে একটা কুঁড়েঘর আর পুড়ে যাওয়া খড়ের গাদাসংলগ্ন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে এসে কমান্ডার বলেন, 'আমরা এখন বাংলাদেশে।' রোমাঞ্চিত হই আমি। শিরদাড়া দিয়ে একটা শীতল অনুভূতি নিচের দিকে নেমে যায়। আমি জিজ্ঞেস করি, 'পাকিস্তানিরা কোনদিকে?' পূবদিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। 'কত দূর?' 'এই আধ মাইল দূরেই ওদের ডিফেন্স। তবে ভয়ের কিছু নেই। গত কয়দিন যা মার খেয়েছে, আমাদের দেখলেও টু-শব্দটি করবে না।' এর পর তিনি যখন অন্যদের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত, আমি তখন বন্দুকটা ওপরে তুলে নিই। তাক করি পুবদিকে। ঘৃণার তাড়নায় মোহাবিষ্টের মতো কাজটা করতে যাই আমি। হঠাৎ তিনি দেখতে পান। হাত তুলে বাধা দেন। বলেন, 'করছেন কী? এখন গুলি করলে ওরা খামোখা এলোপাতাড়ি গোলাগুলি শুরু করে দেবে। চলুন যাওয়া যাক।'
তারপর আমি সেদিন কী সাক্ষাৎকার নিয়েছি, ট্রাকে চড়ে কিভাবে কৃষ্ণনগর স্টেশনে পৌঁছেছি, কিছুই মনে নেই। কেবল মনে আছে, কৃষ্ণনগর থেকে রাত ১২টায় একটি লোকাল ট্রেনে উঠে বসেছিলাম কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শিয়ালদহ স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছল তখন পুবদিক ফিকে হয়ে এসেছে। সূর্য উঠি উঠি করছে। বাড়িতে ফিরে একটা চিরকুট পাই। কাজলের বাবার হাতে লেখা...'বাবা, তুমি পারিলে সত্বর আমাদের বাড়িতে আসিও। ইতি, আশীর্বাদক, শরৎ গুপ্ত।'
ট্রামে, বাসে করে আমি যখন কাজলদের বাড়িতে পৌঁছলাম তখন সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টা হবে। সারা রাত নির্ঘুম থাকায় মাথা ভারী হয়ে আছে। বাড়ির আঙিনায় ঢুকে দেখি বারান্দার একটা দড়ির খাটিয়ায় বসে শরৎ কাকা। বারান্দার পাশাপাশি মেঝেতে বসা মনীষা, বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে তাকে এবং অন্যজন, এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, খুব সম্ভবত মনীষার স্বামী। এ ছাড়া এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে-বসে আছে পাড়ারই কিছু পুরুষ-মহিলা। আমাকে দেখে, যে যেখানে ছিল সেখানেই নিশ্চুপ বসে থাকে। পাথরের ভাস্কর্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে যেন সবাই। কেবল শরৎ কাকা আস্তে আস্তে মুখটা তুলে বললেন, 'বাবা, আসছো?' ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন কাজলের মা। বিলাপ করে উঠলেন, 'কী দেখতে আইছোস, বাবা?' শরৎ কাকা বললেন, যেন কিছু হয়নি এমনভাবে, 'কাজলটা চইলা গেল। রাইতে না খাইয়া শুইতে গেল। সকালে উইঠা দেখি ইলেক্ট্রিকের তার প্যাঁচানো সারা শরীরে। সারাদিন তোমারে খুঁজছে। বালীগঞ্জে বলে তোমাগো অফিস আছে? সেইখানেও গেছিল। তোমারে জরুরি কী জানি কইতে চাইছিল। ঘরের ভিতরে শুইয়া আছে। একবার দেইখা আসো। তোমার অপেক্ষায় সবাই বইসা আছে। তুমি ওর বাল্যকালের বন্ধু। শ্মশান বন্ধু হইবা না ওর?' কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ভেবেছি, আমাকে কী বলতে চেয়েছিল কাজল? সৎকার শেষে বাসে উঠে বসেছি। কোথায় নেমেছি লক্ষ্য করিনি। কোনদিকে হাঁটছি সেটাও খেয়াল করিনি। হঠাৎ খেয়াল হলো, আমি সার্কাস অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশ মিশনের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনতলা বাড়িটার ওপরে পত্্ পত্্ করে সগর্বে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। দুপুর দুটো তখন। ঝকঝকে রোদে আরো বর্ণময় হয়ে উঠেছে পতাকা। আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় সব কিছু। জীবন, মৃত্যু, সখ্য, শত্রু, ভীতি, আনন্দ। তাকিয়ে থাকি উড্ডীয়মান ওই পতাকার দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গাল বেয়ে অঝোরে নামে অশ্রুধারা। দুহাতে চোখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠি আমি।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
পর দিন একটি যুদ্ধ প্রতিবেদনের বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করলাম আমি। আলমগীর কবিরকে পরিকল্পনাটি সম্পর্কে অবহিত করি। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে যে সাব-সেক্টর কমান্ডগুলো, সেগুলোর কমান্ডারদের সাক্ষাৎকার নেব আমি। এখানে তখন দাপটে যুদ্ধ করছেন ৮ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা। আলমগীর কবিরের সম্মতি পাওয়া গেল। ওই সাব-সেক্টরের কয়েক গজ দূরেই মুক্ত বাংলাদেশ। ওই সাব-সেক্টরের যিনি সেনাপতি তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'বাংলাদেশে যাবেন?' 'অবশ্যই!' 'চলুন।' আমাকে আত্মরক্ষার জন্য একটা স্টেনগান দেওয়া হয়। নলে অজস্র ফুটোওয়ালা এই অস্ত্রগুলোকে বলা হতো স্টার্লিং স্টেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের দ্বারা এই অস্ত্রের উদ্ভাবন।
অস্ত্র হাতে আমার মনে হয়, আমি যেন মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়েছি একজন সম্মুখ সমরে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধায়। এগিয়ে যাই আমরা তিন-চারজন। আমাদের সবার আগে সাব-সেক্টর কমান্ডার। শ তিনেক গজ দূরে একটা কুঁড়েঘর আর পুড়ে যাওয়া খড়ের গাদাসংলগ্ন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে এসে কমান্ডার বলেন, 'আমরা এখন বাংলাদেশে।' রোমাঞ্চিত হই আমি। শিরদাড়া দিয়ে একটা শীতল অনুভূতি নিচের দিকে নেমে যায়। আমি জিজ্ঞেস করি, 'পাকিস্তানিরা কোনদিকে?' পূবদিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। 'কত দূর?' 'এই আধ মাইল দূরেই ওদের ডিফেন্স। তবে ভয়ের কিছু নেই। গত কয়দিন যা মার খেয়েছে, আমাদের দেখলেও টু-শব্দটি করবে না।' এর পর তিনি যখন অন্যদের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত, আমি তখন বন্দুকটা ওপরে তুলে নিই। তাক করি পুবদিকে। ঘৃণার তাড়নায় মোহাবিষ্টের মতো কাজটা করতে যাই আমি। হঠাৎ তিনি দেখতে পান। হাত তুলে বাধা দেন। বলেন, 'করছেন কী? এখন গুলি করলে ওরা খামোখা এলোপাতাড়ি গোলাগুলি শুরু করে দেবে। চলুন যাওয়া যাক।'
তারপর আমি সেদিন কী সাক্ষাৎকার নিয়েছি, ট্রাকে চড়ে কিভাবে কৃষ্ণনগর স্টেশনে পৌঁছেছি, কিছুই মনে নেই। কেবল মনে আছে, কৃষ্ণনগর থেকে রাত ১২টায় একটি লোকাল ট্রেনে উঠে বসেছিলাম কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শিয়ালদহ স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছল তখন পুবদিক ফিকে হয়ে এসেছে। সূর্য উঠি উঠি করছে। বাড়িতে ফিরে একটা চিরকুট পাই। কাজলের বাবার হাতে লেখা...'বাবা, তুমি পারিলে সত্বর আমাদের বাড়িতে আসিও। ইতি, আশীর্বাদক, শরৎ গুপ্ত।'
ট্রামে, বাসে করে আমি যখন কাজলদের বাড়িতে পৌঁছলাম তখন সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টা হবে। সারা রাত নির্ঘুম থাকায় মাথা ভারী হয়ে আছে। বাড়ির আঙিনায় ঢুকে দেখি বারান্দার একটা দড়ির খাটিয়ায় বসে শরৎ কাকা। বারান্দার পাশাপাশি মেঝেতে বসা মনীষা, বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে তাকে এবং অন্যজন, এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, খুব সম্ভবত মনীষার স্বামী। এ ছাড়া এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে-বসে আছে পাড়ারই কিছু পুরুষ-মহিলা। আমাকে দেখে, যে যেখানে ছিল সেখানেই নিশ্চুপ বসে থাকে। পাথরের ভাস্কর্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে যেন সবাই। কেবল শরৎ কাকা আস্তে আস্তে মুখটা তুলে বললেন, 'বাবা, আসছো?' ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন কাজলের মা। বিলাপ করে উঠলেন, 'কী দেখতে আইছোস, বাবা?' শরৎ কাকা বললেন, যেন কিছু হয়নি এমনভাবে, 'কাজলটা চইলা গেল। রাইতে না খাইয়া শুইতে গেল। সকালে উইঠা দেখি ইলেক্ট্রিকের তার প্যাঁচানো সারা শরীরে। সারাদিন তোমারে খুঁজছে। বালীগঞ্জে বলে তোমাগো অফিস আছে? সেইখানেও গেছিল। তোমারে জরুরি কী জানি কইতে চাইছিল। ঘরের ভিতরে শুইয়া আছে। একবার দেইখা আসো। তোমার অপেক্ষায় সবাই বইসা আছে। তুমি ওর বাল্যকালের বন্ধু। শ্মশান বন্ধু হইবা না ওর?' কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ভেবেছি, আমাকে কী বলতে চেয়েছিল কাজল? সৎকার শেষে বাসে উঠে বসেছি। কোথায় নেমেছি লক্ষ্য করিনি। কোনদিকে হাঁটছি সেটাও খেয়াল করিনি। হঠাৎ খেয়াল হলো, আমি সার্কাস অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশ মিশনের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনতলা বাড়িটার ওপরে পত্্ পত্্ করে সগর্বে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। দুপুর দুটো তখন। ঝকঝকে রোদে আরো বর্ণময় হয়ে উঠেছে পতাকা। আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় সব কিছু। জীবন, মৃত্যু, সখ্য, শত্রু, ভীতি, আনন্দ। তাকিয়ে থাকি উড্ডীয়মান ওই পতাকার দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গাল বেয়ে অঝোরে নামে অশ্রুধারা। দুহাতে চোখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠি আমি।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments