যৌথ আহ্বান-শিক্ষাঙ্গনের অপরাজনীতি দূর হোক
মহাজোট সরকারের ২০২১ রূপকল্পে বর্ণিত শিক্ষা ও মানব উন্নয়নের লক্ষ্য আমরা সমর্থন করি। আমরা চাই বিপুল জনসমর্থনে নির্বাচিত এই সরকারের প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক ও আধুনিক সমাজ গঠন, সবার জন্য মান ও সমতার ভিত্তিতে শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের অঙ্গীকার সফল হোক।
বর্তমান সরকারের কাছে সচেতন নাগরিক সমাজসহ সব মানুষের প্রত্যাশা বিপুল। কিছু শঙ্কা ও উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, শিক্ষার সংস্কার যে গতিতে ও যতখানি অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন, তা অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে না। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য, সেগুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারকে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো আশু বিবেচনা করে যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।
১. ছাত্র ও তরুণ-সমাজকে অপরাজনীতি থেকে দূরে রাখা এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-অছাত্র সবার অপরাধমূলক ও নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপ কঠোরভাবে দমনের নির্দেশ দেওয়া হোক এবং এ ব্যাপারে সরকারের সর্বস্তর থেকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হোক। ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্যও এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য।
২. সম্প্রতি প্রকাশিত খসড়া শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্যসমূহ নিয়ে ব্যাপক মতৈক্য ও গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে আমরা মনে করি। কিছু ক্ষেত্রে মতের ভিন্নতা থাকলেও দেশের শিক্ষা উন্নয়নের অধিকাংশ প্রধান যেসব লক্ষ্যে সাধারণ মতৈক্য রয়েছে, সেগুলো ব্যাহত হওয়া মোটেই সংগত নয়। জাতীয় সংসদে আলোচনা ও অনুমোদন সাপেক্ষে যেসব অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও নীতিতে সাধারণ মতৈক্য আছে, সেগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
৩. যেসব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে বিশেষ বিতর্ক নেই, সেগুলোর মধ্যে আছে:
ক. সব রকম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে একটি মূল শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে সব শিশুর জন্য মানসম্মত একীভূত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।
খ. বাংলা, ইংরেজিসহ ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, সমাজপাঠ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে সব ধরনের বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর নির্ধারিত ন্যূনতম দক্ষতা ও জ্ঞান নিশ্চিত করা এবং দক্ষতা মূল্যায়নে বিজ্ঞানসম্মত উপায় প্রয়োগ করা।
গ. বাসস্থান, আর্থিক অবস্থান, গোত্র, শারীরিক-মানসিক বিশেষ প্রয়োজন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-নির্বিশেষে সব শিশুর জন্য ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগের মান নির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং এসব লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও এর সদ্ব্যবহারের অবস্থা।
ঘ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনকে অর্থবহভাবে বিকেন্দ্রায়িত করা, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিসহ ব্যাপকতর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব প্রদান এবং প্রাথমিক স্তর থেকে সব প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নেতৃত্বের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি, বেতন ও মর্যাদা প্রদান।
৪. একটি জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে সব রকম সমস্যার পূর্ণ সমাধান এবং সেগুলো বাস্তবায়নের বিশদ কর্মকৌশল আশা করা যায় না। অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বাস্তবায়নের প্রস্তুতি ও পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়ায় জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনা ও অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ স্থায়ী বিধিবদ্ধ শিক্ষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। খসড়া শিক্ষানীতিতে এই সুপারিশ করা হয়েছে।
৫. শিক্ষায় সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে রাষ্ট্র, সরকার ও নাগরিকের ভূমিকা এবং শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা, অর্থায়নের রূপরেখাসহ শিক্ষাব্যবস্থার আইনি কাঠামো হিসেবে শিক্ষানীতিতে সুপারিশকৃত একটি জাতীয় শিক্ষা আইন প্রণীত হওয়া দরকার। স্থায়ী শিক্ষা কমিশন এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে।
৬. শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের জোগান ও যথার্থ ব্যবহার অপরিহার্য। শিক্ষার অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ষষ্ঠ পাঁচসালা পরিকল্পনার (২০১১-১৫) মেয়াদকালে সরকারি শিক্ষা-ব্যয় বর্তমান জাতীয় আয়ের দুই শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করা হোক এবং প্রেক্ষিত (২০১১-২১) পরিকল্পনার সময়সীমায় তা জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশে বাড়ানো হোক। ‘সকলের জন্য শিক্ষা’র আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে শিক্ষা-ব্যয়ের এই মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে।
৭. শিক্ষায় পর্যাপ্ত অর্থায়নের একটি উপায় হিসেবে শিক্ষা সংযোজনী কর (education cess) প্রবর্তন করা হোক। ভারতে ২০০৪-০৫ সাল থেকে মৌলিক শিক্ষার জন্য সকল বর্তমান করের ওপর দুই শতাংশ এবং ২০০৭-০৮ সাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য আরও এক শতাংশ যোগ করে সম্প্রতি প্রতিবছরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হচ্ছে। ‘প্রারম্ভিক শিক্ষা কোষ’ নামক স্থায়ী তহবিলে এ অর্থ জমা রাখা হয়, যা অর্থবছরের শেষে তামাদি হয়ে যায় না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন এবং সব শিশুর জন্য বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্ন আহারের ব্যয় বহন করা হয় এই তহবিল থেকে।
৮. সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে ও সমতার লক্ষ্যে উপজেলাভিত্তিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী সরকারি ব্যয় বরাদ্দের নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই নীতি কার্যকর করার জন্য প্রতি উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সর্বজনীন মৌলিক শিক্ষা প্রসারের জন্য সমন্বিত বিকেন্দ্রায়িত পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা দরকার।
৯. মানসম্মত ও সমতাভিত্তিক মৌলিক শিক্ষা প্রসারের জন্য আমরা ষষ্ঠ পাঁচসালা পরিকল্পনার আওতায় তিনটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম প্রস্তাব করছি।
ক. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৈনিক পাঠসময় বৃদ্ধির জন্য সব বিদ্যালয়ে অভিভাবক ও স্থানীয় সরকারকে সংযুক্ত করে মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা করা হোক।
খ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ও মেধাসম্পন্ন তরুণদের শিক্ষা পেশায় আনার জন্য কলেজের ডিগ্রি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিক্ষক প্রস্তুতি কোর্স চালু করা হোক। এই কোর্সে অংশগ্রহণকারীরা মানবিক, বিজ্ঞান ইত্যাদি স্নাতক ডিগ্রির সঙ্গে শিক্ষা ডিপ্লোমা পাবেন। মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য এই কোর্সের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত বৃত্তি দিতে হবে এবং পাঠ শেষে অন্তত পাঁচ বছর শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকার জন্য আকর্ষণীয় বেতন নির্ধারণ করতে হবে। তাঁদের নিয়ে একটি জাতীয় শিক্ষক কোর গঠন করা যেতে পারে। ১০ বছর সময়ে এই শিক্ষক কোরের এক থেকে দুই লাখ শিক্ষক সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করতে সক্ষম হবেন। এ উদ্যোগ সফল করতে হলে দেশের প্রতি জেলায় অন্তত একটি বা দুটি কলেজ নির্বাচিত করে এই কোর্স চালু করতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে কলেজগুলোরও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও গুণগত মানোন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও বয়স্ক শিক্ষার পরিকল্পিত কার্যসূচি জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ প্রসারের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। এই উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার, স্থানীয় সমাজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে গ্রামভিত্তিক স্থায়ী গণশিক্ষাকেন্দ্র ও পাঠাগারের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করা প্রয়োজন। এই কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যালয়বহির্ভূত কিশোর ও তরুণদের সাক্ষরতা, মৌলিক দক্ষতাসহ প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন গ্রামীণ তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্র ও প্রস্তাবিত কম্যুনিটি রেডিও এই শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। দস্তখতসর্বস্ব অক্ষরজ্ঞানে সীমাবদ্ধ ‘অভিযানের’ মাধ্যমে ‘নিরক্ষরতা নির্মূল’ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ নয়, বরং অর্থের অপচয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি ও সূক্ষ্ম রাজনৈতিক হিসাবের ঊর্ধ্বে উঠে সাহসী ও আদর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। বহুবিধ বাধা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেগুলো কার্যকর করার সদিচ্ছাসম্পন্ন প্রচেষ্টাকে দেশের মানুষ বিপুল সমর্থন দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
কবীর চৌধুরী, জামাল নজরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও আনিসুজ্জামান: শিক্ষাবিদ।
১. ছাত্র ও তরুণ-সমাজকে অপরাজনীতি থেকে দূরে রাখা এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-অছাত্র সবার অপরাধমূলক ও নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপ কঠোরভাবে দমনের নির্দেশ দেওয়া হোক এবং এ ব্যাপারে সরকারের সর্বস্তর থেকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হোক। ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্যও এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য।
২. সম্প্রতি প্রকাশিত খসড়া শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্যসমূহ নিয়ে ব্যাপক মতৈক্য ও গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে আমরা মনে করি। কিছু ক্ষেত্রে মতের ভিন্নতা থাকলেও দেশের শিক্ষা উন্নয়নের অধিকাংশ প্রধান যেসব লক্ষ্যে সাধারণ মতৈক্য রয়েছে, সেগুলো ব্যাহত হওয়া মোটেই সংগত নয়। জাতীয় সংসদে আলোচনা ও অনুমোদন সাপেক্ষে যেসব অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও নীতিতে সাধারণ মতৈক্য আছে, সেগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
৩. যেসব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে বিশেষ বিতর্ক নেই, সেগুলোর মধ্যে আছে:
ক. সব রকম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে একটি মূল শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে সব শিশুর জন্য মানসম্মত একীভূত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।
খ. বাংলা, ইংরেজিসহ ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, সমাজপাঠ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে সব ধরনের বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর নির্ধারিত ন্যূনতম দক্ষতা ও জ্ঞান নিশ্চিত করা এবং দক্ষতা মূল্যায়নে বিজ্ঞানসম্মত উপায় প্রয়োগ করা।
গ. বাসস্থান, আর্থিক অবস্থান, গোত্র, শারীরিক-মানসিক বিশেষ প্রয়োজন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-নির্বিশেষে সব শিশুর জন্য ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগের মান নির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং এসব লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও এর সদ্ব্যবহারের অবস্থা।
ঘ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনকে অর্থবহভাবে বিকেন্দ্রায়িত করা, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিসহ ব্যাপকতর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব প্রদান এবং প্রাথমিক স্তর থেকে সব প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নেতৃত্বের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি, বেতন ও মর্যাদা প্রদান।
৪. একটি জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে সব রকম সমস্যার পূর্ণ সমাধান এবং সেগুলো বাস্তবায়নের বিশদ কর্মকৌশল আশা করা যায় না। অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বাস্তবায়নের প্রস্তুতি ও পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়ায় জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনা ও অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ স্থায়ী বিধিবদ্ধ শিক্ষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। খসড়া শিক্ষানীতিতে এই সুপারিশ করা হয়েছে।
৫. শিক্ষায় সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে রাষ্ট্র, সরকার ও নাগরিকের ভূমিকা এবং শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা, অর্থায়নের রূপরেখাসহ শিক্ষাব্যবস্থার আইনি কাঠামো হিসেবে শিক্ষানীতিতে সুপারিশকৃত একটি জাতীয় শিক্ষা আইন প্রণীত হওয়া দরকার। স্থায়ী শিক্ষা কমিশন এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে।
৬. শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের জোগান ও যথার্থ ব্যবহার অপরিহার্য। শিক্ষার অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ষষ্ঠ পাঁচসালা পরিকল্পনার (২০১১-১৫) মেয়াদকালে সরকারি শিক্ষা-ব্যয় বর্তমান জাতীয় আয়ের দুই শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করা হোক এবং প্রেক্ষিত (২০১১-২১) পরিকল্পনার সময়সীমায় তা জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশে বাড়ানো হোক। ‘সকলের জন্য শিক্ষা’র আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে শিক্ষা-ব্যয়ের এই মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে।
৭. শিক্ষায় পর্যাপ্ত অর্থায়নের একটি উপায় হিসেবে শিক্ষা সংযোজনী কর (education cess) প্রবর্তন করা হোক। ভারতে ২০০৪-০৫ সাল থেকে মৌলিক শিক্ষার জন্য সকল বর্তমান করের ওপর দুই শতাংশ এবং ২০০৭-০৮ সাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য আরও এক শতাংশ যোগ করে সম্প্রতি প্রতিবছরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হচ্ছে। ‘প্রারম্ভিক শিক্ষা কোষ’ নামক স্থায়ী তহবিলে এ অর্থ জমা রাখা হয়, যা অর্থবছরের শেষে তামাদি হয়ে যায় না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন এবং সব শিশুর জন্য বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্ন আহারের ব্যয় বহন করা হয় এই তহবিল থেকে।
৮. সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে ও সমতার লক্ষ্যে উপজেলাভিত্তিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী সরকারি ব্যয় বরাদ্দের নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই নীতি কার্যকর করার জন্য প্রতি উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সর্বজনীন মৌলিক শিক্ষা প্রসারের জন্য সমন্বিত বিকেন্দ্রায়িত পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা দরকার।
৯. মানসম্মত ও সমতাভিত্তিক মৌলিক শিক্ষা প্রসারের জন্য আমরা ষষ্ঠ পাঁচসালা পরিকল্পনার আওতায় তিনটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম প্রস্তাব করছি।
ক. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৈনিক পাঠসময় বৃদ্ধির জন্য সব বিদ্যালয়ে অভিভাবক ও স্থানীয় সরকারকে সংযুক্ত করে মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা করা হোক।
খ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ও মেধাসম্পন্ন তরুণদের শিক্ষা পেশায় আনার জন্য কলেজের ডিগ্রি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিক্ষক প্রস্তুতি কোর্স চালু করা হোক। এই কোর্সে অংশগ্রহণকারীরা মানবিক, বিজ্ঞান ইত্যাদি স্নাতক ডিগ্রির সঙ্গে শিক্ষা ডিপ্লোমা পাবেন। মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য এই কোর্সের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত বৃত্তি দিতে হবে এবং পাঠ শেষে অন্তত পাঁচ বছর শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকার জন্য আকর্ষণীয় বেতন নির্ধারণ করতে হবে। তাঁদের নিয়ে একটি জাতীয় শিক্ষক কোর গঠন করা যেতে পারে। ১০ বছর সময়ে এই শিক্ষক কোরের এক থেকে দুই লাখ শিক্ষক সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করতে সক্ষম হবেন। এ উদ্যোগ সফল করতে হলে দেশের প্রতি জেলায় অন্তত একটি বা দুটি কলেজ নির্বাচিত করে এই কোর্স চালু করতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে কলেজগুলোরও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও গুণগত মানোন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও বয়স্ক শিক্ষার পরিকল্পিত কার্যসূচি জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ প্রসারের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। এই উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার, স্থানীয় সমাজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে গ্রামভিত্তিক স্থায়ী গণশিক্ষাকেন্দ্র ও পাঠাগারের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করা প্রয়োজন। এই কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যালয়বহির্ভূত কিশোর ও তরুণদের সাক্ষরতা, মৌলিক দক্ষতাসহ প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন গ্রামীণ তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্র ও প্রস্তাবিত কম্যুনিটি রেডিও এই শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। দস্তখতসর্বস্ব অক্ষরজ্ঞানে সীমাবদ্ধ ‘অভিযানের’ মাধ্যমে ‘নিরক্ষরতা নির্মূল’ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ নয়, বরং অর্থের অপচয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি ও সূক্ষ্ম রাজনৈতিক হিসাবের ঊর্ধ্বে উঠে সাহসী ও আদর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। বহুবিধ বাধা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেগুলো কার্যকর করার সদিচ্ছাসম্পন্ন প্রচেষ্টাকে দেশের মানুষ বিপুল সমর্থন দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
কবীর চৌধুরী, জামাল নজরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও আনিসুজ্জামান: শিক্ষাবিদ।
No comments