প্রতিক্রিয়া-সহিংসতার কারণ ও অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা by সুমন রহমান

সম্প্রতি গুলশানে ঘটে যাওয়া জোড়া হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে আমি একটি লেখা দিই ‘তরল ভয়ের স্বরলিপি’ শিরোনামে। সেখানে এই হত্যাকাণ্ডটিকে কেন্দ্র করে নগর-মধ্যবিত্তের নিরাপত্তার বোধটি কীভাবে চিড় খাচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরি।


সহিংসতার যে একটা শ্রেণীগত ধারণা মধ্যবিত্তের মাঝে কাজ করে (অর্থাৎ কেবল ছোটলোকেরাই সহিংস, আর ভদ্রলোকেরা ভদ্রলোকদের সংস্পর্শে নিরাপদ থাকবে এই ধারণা) সেটাকেও এই ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করি। আরও বলি, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং ইভ টিজিংয়ের ধারাবাহিকতায় গুলশানে জোড়াখুন হলেও সেটি অন্য একটি মাত্রা পেয়ে যায়, যখন আমরা দেখি, কন্যার বিয়েতে পিতা-মাতা গররাজি হওয়ায় তাঁরা খুন হলেন, কিন্তু কন্যাটি অপহূত হলো না বা অন্য কোনো রকম সহিংসতার সরাসরি শিকার হলো না। সহিংসতার অনুমিত যে ফর্মুলা, তাতে দ্বিতীয়টাই হওয়ার কথা। এভাবে নগরে কি সমাজে বিদ্যমান যে ভয়ের সংস্কৃতি, সেটা আমাদের অনুমিত পথে যে সবসময় চলছে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা হাজির করি একে ‘তরল ভয়’ আখ্যা দিয়ে।
এই ভাবনাটি নিয়ে ওয়েবে প্রচুর আলোড়ন হয়েছে গত কয়েক দিনে, এবং সর্বশেষ চোখে পড়েছে ফারুক ওয়াসিফের ৯ এপ্রিলে প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া প্রতিক্রিয়া। এই সুযোগে সবাইকে ধন্যবাদ জানাই এই লেখাটি নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে তাঁদের মূল্যবান আলোচনার জন্য। আলাপে আলাপে ভয় কেটে যায় নিশ্চয়ই! যাক, যে সহিংসতার ওপর ভিত্তি করে আলোচনার সূত্রপাত, তাকে বোঝার জন্য ফারুক ওয়াসিফ ‘গোড়ায় হাত’ দিয়েছেন এবং জানাচ্ছেন, এই সহিংসতা ‘বিদ্যমান ব্যবস্থারও খেসারত’। গোড়ায় হাত দিয়ে তিনি যা পেলেন তাকে তিনি এভাবে লিখছেন, ‘পানি দূষিত হলে যেমন সবকিছুর মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়, তেমনি সামাজিক পরিমণ্ডলের দূষণও বিষিয়ে তোলে আমাদের জীবনকে।’ অর্থাৎ সমাজটি যেহেতু সার্বিকভাবেই পচে গেছে; যেহেতু ‘সরকার-প্রশাসন শিথিল এবং সমাজ প্রতিরোধহীন’, এখানে এসব সহিংসতা ঘটবেই। তাঁর মতে, বিষয়টিকে সেই জায়গা থেকে না দেখে আমি ‘হাওয়ার ওপর তাওয়া’ ভেজেছি!
গুলশানের জোড়াখুন কোথায় আমাদের অনুমিত শঙ্কার পথ ছেড়ে অন্য পথে গেছে, সেটা আমি আমার লেখায় ইঙ্গিত দিয়েছি। এখন কেউ যদি মনে করেন, সমাজে খুনোখুনি নতুন কিছু নয়, সেটা তার দায়। যেহেতু পানিটাই দূষিত হয়ে গেছে, সেটা বদলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়! আজকাল ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি চোখ বুজে একটা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন। রোগীর শরীরের ভেতরে কোথায় কী ঘটছে, এত সব শোনার সময় তাঁর নেই, তাঁর আছে অ্যান্টিবায়োটিক, যেখানে যা-ই ঘটুক, কড়া ডোজ পড়লে ঠিক হয়ে যাবে! ফারুক ওয়াসিফের ফর্মুলাটি এ রকমই শোনাল।
আলোচ্য ঘটনাটি দেখুন: মেয়েকে চাইতে এসে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মেয়ের বাবা-মাকে খুন করে রেখে গেছে পাণিপ্রার্থী যুবক। নারীর প্রতি সহিংসতার জায়গা থেকে ঘটনাটিকে কীভাবে পাঠ করব আমি? তুলনার জন্য একটা দৃষ্টান্ত দিই: যুদ্ধের সময় ধর্ষণ একটা যুদ্ধকালীন কৌশল হিসেবে কাজ করে, যা দিয়ে শত্রুকে নৈতিক এবং মানসিকভাবে হীনবল করে তোলা হয়। এখানে নারীর প্রতি সহিংসতাকে যুদ্ধে জেতার উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গুলশানের ঘটনায়ও নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটেছে, সন্দেহ নেই। তবে সেখানে হত্যাকাণ্ডটিই বরং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রকাশের উপায় হিসেবে কাজ করেছে। দুটো ঘটনার সূক্ষ্ম তারতম্য খেয়াল না করলে লেজেগোবরে করে ফেলার আশঙ্কা আছে। দুটোই নারীর প্রতি সহিংসতা, কিন্তু এক জায়গায় সেটি উদ্দেশ্য এবং অন্য জায়গায় সেটি উপায়।
অবশ্য সমাজটাকে বদলে ফেললে এসব সূক্ষ্ম তারতম্যগুলো আমলে না নিলেও চলে। সে সমাজ-বিপ্লবীর ভাবনা, সমাজ-ভাবুকের নয়। আর তা ছাড়া সমাজটাকে তো বদলানো যাচ্ছে না। বরং সমাজ নিজে নিজেই এক ভয়ংকর পথে রওনা দিয়েছে। সে পথের খুঁটিনাটিগুলো খেয়াল করাকে আমি দায়িত্ব মনে করি। বলেছিলাম, এ রকম ঘটনা থেকে মধ্যবিত্ত সমাজে যে ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে তা শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণনির্বিশেষে আগের মতো জমাট বাঁধছে না। এ এক তরল ভয়, তারল্যের কারণেই সে সর্বগামী হয়ে উঠছে। এটা নিয়তিবাদ নয় কিংবা আধিবিদ্যক চিন্তা নয়। আমাদের চিন্তাপদ্ধতির পশ্চাৎপদতার কারণে এসব ঘটনার সূক্ষ্ম মাত্রাগুলো আমরা ধরতে পারি না। এখানেই ফারুক ওয়াসিফের সঙ্গে আমার পদ্ধতির পার্থক্য। তিনি অবরোহী, আমি আরোহী। তিনি জানেন ‘কী করিতে হইবে’ এবং সেই বোধকে সঙ্গে নিয়ে সমাজে কী ঘটেছে, সেটা জানতে চান। তাঁর গন্তব্যের বোধটি জমাট থাকার কারণেই হয়তো তিনি সহিংসতার ভয়কে জমাট ভাবার দায় বোধ করছেন। আর আমি প্রতিদিনের জীবন থেকে ভয়ের চেহারাটি আঁকতে চেষ্টা করেছি, চিরদিনের থিওরি থেকে নয়। ফেসবুক নোটে ফারুক আলোচ্য ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পুরুষালি-সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, কালচার ইন্ডাস্ট্রি, বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির কল্যাণে ঘটমান নীরব যৌনবিপ্লবকে এর কারণরূপে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর ভাষায়, এসব জিনিসকে ঘিরেই জোড়াখুন-সংক্রান্ত ভয়টুকু জমাট বাঁধছে। কিন্তু সে রকম হলে ‘যৌনবিপ্লব’-এর তীর্থভূমি পশ্চিমা দেশে এ রকম ঘটনা হরহামেশা ঘটত। সেটা যে ঘটছে না, তা ফারুক নিজেই স্বীকার করছেন। স্বীকার করে আবার দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন দেশীয় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের ওপর। চাঁদমারি এত ঢাউস করে বানালে তীর সেখানে না-আটকে যাবে কোথায়?
সমাজকে ব্যাখ্যার জন্য চিন্তাকাঠামো লাগে। চিন্তাকাঠামো কোনো অনড় জিনিস নয়, তাকে পরিবর্তিত বাস্তবতায় নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখা জরুরি। এই তো কয়েক দশক আগ পর্যন্ত সমাজচিন্তকেরা শ্রেণীর ধারণাটিকে সম্বল করে সামাজিক বৈষম্যকে ব্যাখ্যা করে এসেছেন। তারপর সত্তরের দশকের দিকে আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, শ্রেণীধারণা সব ধরনের বৈষম্যকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না এবং এর ধারাবাহিকতায় লিঙ্গীয় এবং বর্ণবৈষম্যের ধারণাগুলোকে যুক্ত করলাম শ্রেণীবৈষম্যের ধারণার সঙ্গে। চিন্তাকাঠামোর অন্ধ অনুসরণও যান্ত্রিকতা এনে দেয় ব্যাখ্যায়। ফলে আমরা যে নিক্তি দিয়ে সমাজ মাপি, তার পাল্লা-বাটখারা নিয়মিত যাচাই করে দেখার দরকার আছে। আমার মতে, প্রতিদিনের জীবনে ঘটতে থাকা সূক্ষ্ম ফারাকগুলো শনাক্ত করে রাখার মাধ্যমেই সেটা সম্ভব।
সুমন রহমান: কবি, কথাসাহিত্যিক।
sumanrahman@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.