স্বপ্ন যাঁর ‘মধুর দুনিয়া’ by ইফতেখার মাহমুদ

৬৫ বছর বয়স তাঁর। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন দুনিয়ার নানা ম্যানগ্রোভ বন ঘুরে ঘুরে। কিন্তু সুন্দরবনে এর আগে কখনো আসেননি। শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনে এলেন এবং চরম বিস্ময়ের সঙ্গে দুনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যানগ্রোভ বনটি দেখে ধরা গলায় বললেন, ‘অসাধারণ! সুন্দর।


এই বনে না এলে আমার এত বছরের জীবনের সব জ্ঞান তুচ্ছ হয়ে যেত।’
সুন্দরবন দেখে দুনিয়ার অনেক মানুষের মতো বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে যাওয়া এই মানুষটি জিনি ডি বেয়ার। এখন পৃথিবীর বেশ নামকরা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিশেষজ্ঞ। কাঠ ছাড়া (নন-টিম্বার) বনজ সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের জনক বলে খ্যাতিও পেয়ে গেছেন তিনি। ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ফরেস্ট্রি রিসার্চ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি লতা, গুল্ম, মধুসহ বনের অকাঠ-জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর নেচার’ (আইইউসিএন) নেদারল্যান্ড শাখার জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এখন তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়—মধুর দুনিয়ার স্বপ্নে বিভোর একজন মানুষ।
নেদারল্যান্ডের প্রকৃতিপ্রেমিক জিনি ডি বেয়ার সুন্দরবনে আসার পরিকল্পনা করছিলেন অনেক দিন ধরেই। তবে আগ্রহটা তাঁর তীব্র হয়ে ওঠে ‘মধুর দুনিয়া’ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর। দুই বছর আগে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে শুরু হয়েছে দুনিয়ার নানা কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মধু-শিল্প সংরক্ষণের এই আন্দোলন। অবশ্যই এই আন্দোলনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বন বাংলাদেশের সুন্দরবন।
শেষ পর্যন্ত সেই সুন্দরবন ও এর মধুকে কাছ থেকে দেখতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন বেয়ার। যথারীতি এখানে এসেই জোর দিয়েছেন সুন্দরবনের মধু ও মৌয়ালদের রক্ষা করার ওপর। বেয়ারের ভাষায়, ‘মধু বাঁচলে বন বাঁচবে।’
কিন্তু বনের এত সম্পদ থাকতে মধু রক্ষায় আন্দোলন শুরুর কারণটা কী? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলেন বেয়ার, ‘এটা বুঝতে পারছ না। বনে বেশি মধু থাকা ভালো বনের লক্ষণ। ম্যানগ্রোভ বনে মধু থাকা মানে গাছ, পানি, মাটিসহ পুরো প্রতিবেশব্যবস্থা ভালোমতো টিকে আছে। বনের মধু যথেষ্ট থাকলে বুঝতে হবে সেখানে হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর খাদ্যের জোগানও ভালো। আর এই প্রাণীগুলো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারও এদের খাওয়ার জন্য ওই এলাকায় বেশি বিচরণ করবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঁচলে মানুষের উৎপাত থেকে সুন্দরবন বাঁচবে। তাই মধু রক্ষা করতে পারলে সুন্দরবন রক্ষা করা যাবে।’
অবশ্য বেয়ারের কাছে বন সংরক্ষণ মানে বনজীবীদের তাড়িয়ে দিয়ে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ গড়ে তোলা নয়। তাঁর কাছে বন টিকে থাকার প্রধান শর্ত, স্থানীয় লোকজনকে বনের সত্যিকারের অংশীদার করে তোলা, ‘আমি যদি বন থেকে বনজীবীদের সরিয়ে ফেলি, তাহলে তারা বন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবা শুরু করবে। এতে বনজ সম্পদ চুরির পরিমাণ বাড়বে। ভারতের মহারাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যানে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় ওই বনের অর্ধেকই মানুষ কেটে শেষ করে ফেলে। অথচ জাতীয় উদ্যানের পাশেই স্থানীয় বাসিন্দারা বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সংরক্ষণ করে চলেছে।’
বেয়ার এবং মধুর দুনিয়া আন্দোলনকারীদের মতে, বনজীবীদের জীবিকার উৎস হিসেবে মধু সংগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বনজীবীরা মধুর ন্যায্য দাম পেলে তাঁরাই বনকে টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে আসবেন।
বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে জিনি ডি বেয়ার সুন্দরবনের ওপর একটি বই লিখবেন। মৌয়াল ও বাওয়ালিরা কীভাবে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মাধ্যমে টিকে আছেন, সুন্দরবন রক্ষায় বনজীবীদের কীভাবে যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে কিছু সুপারিশসহ একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে দেওয়ারও পরিকল্পনা আছে তাঁর।
বেয়ারের পরিকল্পনা আরও অনেক পরিকল্পনার মতো আমরা হারিয়ে ফেলব না তো?

No comments

Powered by Blogger.