বইয়ের মৃত্যু নেই-ছাপা বইয়ের মৃত্যু আসন্ন by হাসান ফেরদৌস

বইয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে যে গুজব রটেছে, তা অতিরঞ্জিত বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয়। বই বলতে আমরা এত দিন বুঝেছি কাগজে মুদ্রিত ও পরিপাটিভাবে বাঁধাই এক নথি। এই কাগুজে বই দ্রুত বদলে যাচ্ছে, যেমন বদলে যাচ্ছে খবরের কাগজ।


এখন থেকে বিশ বা পঁচিশ বছর পর এমন লোক খুব বেশি থাকবেই না, যারা প্রতিদিন সকালে সদ্য ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়ে আসা সংবাদপত্র হাতে না পেলে দিন শুরু করতে পারবে না। মোটা বই হাতে অলস মধ্যাহ্নে আরামকেদারায় বুঁদ হয়ে থাকবেন, এমন লোকের সংখ্যাও প্রায় নিশ্চিহ্ন হবে।
তার মানে এই নয়, বই থাকবে না, অথবা সংবাদপত্রের মৃত্যু হবে। অবশ্যই থাকবে। শুধু থাকবেই না, প্রকাশিত বই বা সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু বদলে যাবে তার প্রকাশের মাধ্যম। এখন বই বা পত্রিকা প্রকাশের ঝক্কি অনেক—কাগজ, কালি, যান্ত্রিক মুদ্রণ ছাড়াও রয়েছে সংরক্ষণ ও বণ্টনের সমস্যা। কিন্তু সেদিন খুব দূরে নয়, যখন যে-কেউ চাইলে বই লিখে নিজেই তা প্রকাশ করবে। একজন একাই একটি সংবাদপত্র প্রচারে সক্ষম হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সে বইয়ের বা সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা সম্ভাবনার অর্থে হবে অগুনতি। যে-কেউ দুনিয়ার যেকোনো স্থান থেকে সে বই বা পত্রিকা পড়তে পারবে। এই বই বা পত্রিকা ধুলোয় মলিন হবে না, বৃষ্টিতে ভিজে শতচ্ছিন্ন হবে না, উইপোকায় কাটা পড়বে না। এই বই বা পত্রিকা রাখতে তাকের পর তাক সাজাতে হবে না, স্থান সংকুলান হচ্ছে না বলে সে বই বাতিল করারও প্রয়োজন পড়বে না। তার চেয়ে বড় কথা, কাগজে ছাপার জন্য প্রতিদিন যে হাজার হাজার গাছ কেটে অরণ্য উজাড় হচ্ছে, সে বিপদও এড়ানো যাবে।
না, এ কোনো গালগপ্প নয়, ইন্টারনেটের কল্যাণে ইতিমধ্যেই এই রূপকথা এখন বাস্তব।
আমি জানি, বই বা খবরের কাগজ থাকবে না, এ কথা ভাবতেই কারও কারও হূৎকম্প জাগবে। বই হাতে নিয়ে, তার কাগজের গন্ধ শুকতে শুকতে সে বই পড়ার আনন্দই আলাদা, এ কথা হলফ করে বলবেন, এখনো এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। এঁদের সবার মনের কথাই প্রায় সাড়ে সাত শ বছর আগে বলে গেছেন ইতালীয় কবি পেত্রার্ক। তাঁর কথায়, বই ব্যাপারটাই আলাদা। সোনাদানা, মূল্যবান গয়না, মর্মর প্রাসাদ, চিত্রকর্ম বা বাজির ঘোড়া কেবল সাময়িক তৃপ্তি দিতে পারে, কিন্তু এদের কাছ থেকে শোনার-জানার কিছু নেই। কিন্তু বই আপনার হূদয়কে উষ্ণ করবে, সে আপনাকে বন্ধুর মতো সদোপদেশ দেবে, আপনার সঙ্গে তাজা ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণ করবে।
এক শ বছর আগে হলে পেত্রার্কের এই কথা নিয়ে কোনো তর্কের অবকাশ থাকত না। কিন্তু কঠিন, কঠোর সত্য হলো এই যে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কাগজের বইয়ের বা সংবাদপত্রের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এমন এক সময় আসছে—অথবা বলতে পারি, কারও কারও জন্য সে সময় ইতিমধ্যে এসে গেছে—যখন আমাদের জাগরিত প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রিত হবে শুধু একটি মুঠোফোনের মাধ্যমে। অথবা পেপারব্যাক বইয়ের আকারের কোনো ইলেকট্রনিক ট্যাবলেটে। আর কাগজে ছাপা বই নয়, ইলেকট্রনিক বই বা ই-বুক হবে আমাদের আশ্রয়।
বই বলতে আমরা এখন যা বুঝি, তার বয়স কিন্তু খুব বেশি নয়, বড়জোর ৬০০ বছর। হাতের লেখা অবশ্য আবিষ্কৃত হয় এর অনেক আগে, আজ থেকে হাজার তিনেক বছর আগে। প্রথমদিকে পাথরে খোদাই করে অথবা কাঠের ওপর অক্ষর—অথবা অক্ষরজাতীয় প্রতীক—সাজিয়ে লেখার চেষ্টা করেছে মানুষ। প্রথম ‘মুদ্রিত বই’ মানুষের হাতে পৌঁছায় ১৪৫৩-৫৪ সালে, গুটেনবার্গের ছাপাখানার কল্যাণে। এর আগ পর্যন্ত বই বলতে বোঝাত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি বা পুঁথি ও স্ক্রল। প্যাপিরাসে, রেশমি কাপড়ে, এমনকি চামড়ায় লেখা হতো সে পাণ্ডুলিপি। প্যাপিরাসে লেখা বই দেখেছি মিসরের পৌরাণিক জাদুঘরে ও নবনির্মিত আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগারে। ছোট মাদুরের মতো গোটানো স্ক্রল, ভাঁজ ভেঙে ভেঙে পড়তে হয়। সে বই লেখা যেমন কঠিন, তা পড়াও মস্ত ঝক্কি। প্রস্তরে খোদাই করা লেখাও দেখেছি নানা জাদুঘরে, কিন্তু তাকে আর যা-ই বলি, বই বলা যায় না।
হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি বা পুঁথিই হলো মানুষের বানানো প্রথম বই। পেশাদারি লিখিয়ে থাকতেন, যাঁদের কাজ ছিল সে বই নকল করা। কোনো কোনো বই হাজার বা তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় কপি করা হতো। যেমন, তেরো ও চৌদ্দ শতকে অ্যারিস্টটলের কোনো কোনো বইয়ের হাতে লেখা কপির সংখ্যা ২০০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল। ধর্মগ্রন্থ কপি করা হতো আরও বেশি।
মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সহজভাবে পড়া যায়, বহন বা বিতরণ করা যায়, এমন বই আবিষ্কার করেছে। এই কাজে বড় একটি আবিষ্কার ছিল কাগজ। প্রথম খ্রিষ্টাব্দের শেষে বা দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে চীনে কাগজ আবিষ্কৃত হয়। এর ফলে সে দেশে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি/বইয়ের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। গল্প-কবিতা নয়, রাজার ফরমান জারিই ছিল তার প্রধান কাজ। অন্য বড় কাজ ছিল রাজপুরোহিতের নামে ঈশ্বরের বাণী প্রচার। প্রথমে হাতে লিখে, পরে কাঠের অক্ষরে ছাপ দিয়ে প্রস্তুত হতো সে গ্রন্থ। ১৪৫৩ সালে জার্মানিতে গুটেনবার্গ যে বই ছাপানোর যন্ত্র আবিষ্কার করেন, তার পেছনেও মূল প্রেরণা ছিল বাইবেলের প্রচার। সেই যন্ত্রের আবির্ভাবের পর রাতারাতি বদলে গেল বইয়ের জগৎ।
জার্মানির মাইনজ শহরের বাসিন্দা য়োহান গুটেনবার্গ সোনার চাক্তির ওপর খোদাই কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর মাথায় ধাতব অক্ষর সাজিয়ে তার ওপর ছাপ দিয়ে ছাপার মেশিন আবিষ্কারের ধারণা আসে। ভগ্নিপতির কাছ থেকে টাকা ধার করে ছাপার মেশিন বানিয়েছিলেন গুটেনবার্গ; কিন্তু সে টাকা শোধ করতে না পারায় তার মেশিনের মালিকানা চলে যায় সেই ভগ্নিপতির হাতে। সেই লোকের নাম অবশ্য কেউ মনে রাখেনি, ছাপার যন্ত্র মানে এখনো সেই গুটেনবার্গের টাইপসেটার। বাইবেল দিয়েই শুরু ছাপানো বইয়ের কাজ। প্রতি পাতায় ৪২ লাইনের গুটেনবার্গের বাইবেল হাজার হাজার কপি ছেপে বেরোয় কয়েক বছরের মধ্যে। সে সময় খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্য ধর্মযুদ্ধ—ক্রুসডে—চলছে। যুদ্ধে না যাওয়া মহা পাপ, কিন্তু চার্চ থেকে নগদ পয়সায় যুদ্ধে যাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। ক্যাথলিক চার্চ এই যন্ত্রের বদৌলতে সেই মওকুফনামা ছাপিয়ে বিক্রি শুরু করে দেদার পয়সা কামিয়ে নেয়।
ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের সেই শুরু। এরপর গত ৫০০ বছরে বইয়ের আকার বদলেছে, তার মাধ্যম বদলেছে, সবচেয়ে বড় কথা, বদলে গেছে তার মুদ্রণ ও প্রচার। বিশ শতকের শেষার্ধে এসে আমরা পেলাম ইন্টারনেট। প্রথমে সামরিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার শুরু। বিশ শতকের শেষ কুড়ি বছরে এসে আমরা শিখলাম ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদপত্র ও বইয়ের প্রকাশ। নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশ-বারো বছরে তথ্যমাধ্যম ও মুদ্রণশিল্পকে আমূল বদলে দিল এই ইন্টারনেট। কারিগরি ব্যাখ্যায় যাব না, আমার সে যোগ্যতা নেই। বরং আমি নিজে কীভাবে এর ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছি তার উদাহরণটি দিই।
তেইশ বছর আগে আমেরিকায় ডেরা বাঁধার পর আমার প্রথম কাজ ছিল নিউইয়র্ক টাইমস নামক পত্রিকাটির গ্রাহক হওয়া। রোজ সকালে গাড়ি করে এক সাহেব (পরে মেক্সিকান যুবক) আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেন, দড়ি দিয়ে মুড়ে দিনের পত্রিকাটি সজোরে তিনি ছুড়ে মারতেন, যা ঠিক ঠিক আমার দোরগোড়ায় এসে পড়ত। আমি প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করি পাতালরেলে, সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। সকালে ও বিকেলে প্রচণ্ড ভিড়। সেই ভিড়ের ভেতর ঝুলতে ঝুলতে কাগজখানা আড়াআড়ি ভাঁজ করে পড়া আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। ভিড়ের কারণে কখনো সে পত্রিকা চার বা আট ভাঁজে ভাঁজ করে পড়ি। ভিড় কমে গেলে সে পত্রিকাই পুরোটা খুলে পড়ি। সহযাত্রী কেউ এতে বিরক্ত হয়, কেউ বা পাশে বসে আড়চোখে সেই পত্রিকায় ভাগ বসায়। খুব যে আনন্দকার অভিজ্ঞতা তা বলা যাবে না। কোনো কোনো দিন পত্রিকা না পড়ে বই হাতে নিয়ে বসি। মোটা বই হলে হাত ধরে আসে, পাতা ওল্টাতে গিয়ে বই ছিটকে পড়ে। সহযাত্রীরা বিরক্ত হয়।
তিন বছর আগে আমি কিন্ডল নামের যন্ত্রটি আবিষ্কার করি। এটি একটি ই-বুক রিডার, অর্থাৎ এই যন্ত্রে যেকোনো বই বা পত্রিকা পড়া যায়। মাত্র ১০ আউন্স ওজনের, ৮×৫ ইঞ্চি আয়তনের (এখন অবশ্য আরও ছোট ও হালকা হয়ে এসেছে) এই যন্ত্র। কম করে হলেও ২০০ বই এতে জমিয়ে রাখা যায়। অনেক বই, বিশেষ করে ক্ল্যাসিকস, বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। নতুন বই কিনতে হয়, তবে কাগুজে বইয়ের অর্ধেক দামে। কিন্ডলে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক পত্রিকাই পড়া যায়, তবে সে জন্য গ্রাহক হতে হবে। কাগজের পত্রিকার মাসিক দাম যদি হয় ৩০ ডলার, তো কিন্ডলে তার দাম অর্ধেক বা তার চেয়েও কম। কিন্ডল প্রথম ছিল সাদা-কালো, দামেও কিছুটা চড়া। এখন সে দাম কমে এসেছে, রঙিন কিন্ডলও বাজারে এসেছে। নিজ চোখে পড়তে না চাইলে যান্ত্রিকভাবে কিন্ডল থেকে বই বা পত্রিকা পড়া যায়। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে বসে থাকুন, বা রেলের কামরায় হাতল ধরে ঝুলুন। কেউ কিসসু টের পাবে না।
শুধু কিন্ডল নয়, আরও নানা ব্র্যান্ডের ই-বুক রিডার বেরিয়েছে। এদের মধ্যে বার্নস ও নোবেলের ‘নুক’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। গত মাসে মাইক্রোসফট কোম্পানি নুক কিনে নেওয়ার পর বাজার দখল নিয়ে কিন্ডলের মালিক আমাজন ডটকমের সঙ্গে তার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হয়েছে। এতে অবশ্য পাঠকেরই সুবিধা, কারণ যন্ত্রের দাম কমবে, বই বা পত্রিকার মূল্যও হ্রাস পাবে। অ্যাপল কোম্পানির অত্যন্ত জনপ্রিয় আইপডেও এখন ই-বুক পড়া যায়। অধিকাংশ স্মার্ট ফোনেও বই পড়ার ব্যবস্থা আছে। ওয়ার অ্যান্ড পিসের মতো মস্ত একখানা বই আপনার মুঠোফোনে ঢুকিয়ে তা আপনার সুবিধামতো সময়ে, ধীরেসুস্থে পড়ে নিতে পারেন। এ বই লাইব্রেরি থেকেও ধার নেওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য আপনাকে লাইব্রেরিতে যাওয়ার সময় বের করতে হবে, সময়মতো বই ফেরত না দিলে জরিমানা দিতে হবে। বই হারালে তো হ্যাপা আরও বাড়বে।
ভাববেন না, কিন্ডল আছে বলে আমি আর ছাপা বই পড়ি না। নতুন বই দেখলে, সস্তায় পুরোনো বই পেলে, এখনো হুমড়ি দিয়ে পড়ি। কিন্তু কত বই কিনব, কোথায় সে বই রাখব? সে কথা ভাবলে কিন্ডল এক মস্ত মুশকিল আসান। তবে সমস্যাও আছে। সব বই কিন্ডলে পাওয়া যায় না। বাংলা বইও মেলে না। তার পরও যা মেলে তার সংখ্যা বিস্তর। শুধু কিন্ডল কেন, ইন্টারনেটে এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব বইই মেলে। সেসব কিন্ডলে বা অন্য যেকোনো ই-বুক রিডারে ‘ডাউনলোড’ করা কোনো সমস্যাই নয়। রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছিলেন বাঁকুড়ার স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক এডওয়ার্ড থমসন ১৯১৮ সালে। ১৯১২ সালে, তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ারও আগে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিকাগোতে সাক্ষাৎকার নিয়ে এক বই লিখেছিলেন বাঙালি লেখক বসন্ত কুমার রায়। দুটো বইই পাবেন ইন্টারনেটে, নিখরচায়। গত ৫০ বছরে প্যারিস রিভিউ পত্রিকা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সব আধুনিক লেখকের সাক্ষাৎ নিয়েছে, ইন্টারনেটে তাও পাবেন নিখরচায়। আমাজন ডটকম উদ্যোগ নিয়েছে পৃথিবীর যত বই সম্ভব তা কপি করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে। কপিরাইট নিয়ে কিছুটা ঘাপলা এখনো চলছে, কিন্তু সত্যি সত্যি যদি এ ঘটনা ঘটে, তাহলে ঘরে বসে, হাঁটতে হাঁটতে, পাতালরেলে ঝুলতে ঝুলতে বিশ্বের সেরা লাইব্রেরি নিয়ে চলতে পারব।
আগেই বলেছি, বই মরছে না, মরবেও না। বস্তুত, প্রতিবছরই প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু আমেরিকাতেই প্রতিবছর বেরোচ্ছে এমন বইয়ের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেসকো প্রতিবছর প্রকাশিত বইয়ের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। আগ্রহী পাঠক সেটি মিলিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সেসব বইয়ের অনেকগুলো এখন আর মুদ্রিত অবস্থায় মেলে না, মেলে শুধু ই-বুক হিসেবে। ২৪৪ বছর ধরে ইংল্যান্ডের ব্রিটানিকা কোম্পানি তাদের বহু খণ্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশ করেছে। মনে পড়ছে, ষাটের দশকে কোনো একসময় অভিনেতা মোস্তফা মুটের মাথায় বোঝাই করে সেই এনসাইক্লোপিডিয়া বাড়ি বয়ে এনেছিলেন। ইত্তেফাকে সে ছবিও ছাপা হয়েছিল। আমি নিজে শস্তায় পেয়ে পুরোনো একসেট কিনেছি। সক্ষম ও শিক্ষিত মানুষ বরাবর এই বই নিজের সংগ্রহে রেখেছে, শুধু দরকারি বলে নয়, এর পেছনে এক ভিন্ন শ্লাঘাও নিশ্চয় কাজ করে বলে। দুই মাস আগে ব্রিটানিকা কোম্পানি জানিয়েছে, এখন থেকে এই বই আর ছেপে বেরোবে না। শুধু ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। সে খবরে পরে চারদিকে হায় হায় পড়ে গেছে, এমন কথা শুনিনি।
ছাপা বই বদলে ই-বুক হয়ে বেরোচ্ছে, সে কেবল ব্যবহারে সুবিধা বলে নয়। আসল কারণ অর্থনৈতিক। প্রাথমিক উৎপাদন খরচ বাদ দিলে প্রতিটি ছাপা বইয়ের খরচ কমবেশি একই। যত বই ছাপা হবে, তত খরচ। ই-বইতে সে ঝামেলা নেই। প্রাথমিক খরচের পর যত খুশি কপি করুন। কার্যত, বাড়তি এক পয়সাও লাগবে না। আর্থিক বিবেচনা ছাড়া অন্য যে বড় কারণে আজ হোক বা কাল আমাদের ই-বইয়ের দিকে ঝুঁকতে হবে তা হলো পরিবেশগত। গাছ এখনো বই উৎপাদনের প্রধান উপাদান। ভাবতে পারেন, কী পরিমাণ গাছ আমরা কেটে চলেছি শুধু বই বা খবরের কাগজের জন্য?
একটা হিসাব দিই। গোড়ায় যে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কথা বলেছি, তার প্রতি রবিবাসরীয় সংখ্যার জন্য যে পরিমাণ কাগজ চাই, তার জন্য দরকার কম করে হলেও ৭৫ হাজার গাছ। অন্য কথায়, শুধু রোববারের টাইমস-এর জন্য প্রতিবছর কাটা হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ গাছ। এই শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত উদ্যানের নাম সেন্ট্রাল পার্ক, সেখানে মোট বৃক্ষ ২৬ হাজার। এখন ভাবুন প্রতিদিন সেন্ট্রাল পার্কের মতো কতগুলো উদ্যান আমরা উজাড় করছি। এ তো গেল খবরের কাগজ। এখন তার সঙ্গে যোগ করুন বই। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ বই মুদ্রিত হয়ে বেরোচ্ছে। ভাবুন তো, কী পরিমাণ গাছ উজাড় হচ্ছে সে বইয়ের জন্য! পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে, ভূ-ভাগের উষ্ণতা বাড়ছে, বাংলাদেশের মতো দেশের এক-তৃতীয়াংশ তলিয়ে যেতে পারে এমন ভয়ও আছে। এর পেছনে আমাদের কাগজের বই ও পত্রিকাও কম দায়ী নয়।
বই মরবে না, কিন্তু কাগজের বইয়ের মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সে মৃত্যু, এ কথা যত দ্রুত আমরা বুঝতে শিখব, পৃথিবীর জন্য ততই মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.