রক্ত ও তরবারির গান-বিরোধ ভুট্টোর উত্তরাধিকার নিয়েই by ফাতিমা ভুট্টো
১৭ আগস্ট ১৯৮৮, জেনারেল জিয়াউল হক পাঁচজন পাকিস্তানি জেনারেল, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেল ও পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সহায়তা মিশনের প্রধান জেনারেল হারবার্ট এন ওয়াসমকে নিয়ে তেমওয়ালি ফায়ারিং রেঞ্জে এসে পৌঁছালেন। উদ্দেশ্য, আমেরিকান এমওয়ান অ্যাবরামস ট্যাংকের মহড়া দেখা।
পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান ও আফগানিস্তানে সিআইএর হয়ে লড়াই করা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান জেনারেল আখতার আবদুর রেহমানও ছিলেন। যদিও দশবারই লক্ষ্যবস্তু মিস করায় মহড়াটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে সেখানে উদ্যাপন করার সুযোগ খুব সামান্যই ছিল এবং সম্মানিত অতিথিরাও ছিলেন তিরিক্ষি মেজাজে। তাঁরা অফিসার মেসে মধ্যাহ্নভোজ সারেন। জেনারেল জিয়াউল হক নামাজের জন্য কিছুটা সময় চেয়ে নিলেন এবং তারপর সঙ্গীদের ‘পাক ওয়ান’ বিমানে উঠতে বললেন।
প্রেসিডেন্টের বিমান ইসলামাবাদের উদ্দেশে রওনা হলো। এর আগে এ বছরই আল জুলফিকার ‘পাক ওয়ান’ বিমানে হামলা চালালেও অল্পের জন্য তা রেহাই পায়। ফলে এর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। বিমানের ককপিটে উইং কমান্ডার মাসুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল ছিল, যাঁরা সবাই জিয়াউল হক মনোনীত। বিমানটি যে রুটে ইসলামাবাদ থেকে এসেছিল, সেই রুটেই ফেরত যাচ্ছিল। বাওয়ালপুর থেকে তিনটা ৪৫ মিনিটে ‘পাক ওয়ান’ উড্ডয়ন করলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এডওয়ার্ড জে এপসটিন লিখেছেন, বিমানবন্দর থেকে ১৮ মাইল দূরত্বে গ্রামবাসী দেখতে পেলেন, পাক ওয়ান রোলার কোস্টারের মতো নিচে নামছে আর ওপরে উঠছে। এরপর এটি সরাসরি মরুভূমিতে এসে পড়ে এবং বিস্ফোরিত হয়। এর সব জ্বালানি পুড়ে যায় ও বিমানটি পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে। বিমানের আরোহী ৩১ জনই মারা যান।
দিনের বেলা সেদিন আবহাওয়া ছিল পরিষ্কার ও রোদঝলমলে। পাইলটের ভুল হওয়ারও কারণ ছিল না। সে সময় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে একটি আমের ঝুড়ি ‘পাক ওয়ান’-এ ওঠানো হয়েছিল এবং তাতে বিস্ফোরক ছিল। মানুষ বলাবলি করছিল, এই ফলই (ঝুড়িভর্তি আম) স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়।
এপসটিন আরও লিখেছেন, প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো দাবি ছিল না, ছিল না পাল্টা অভ্যুত্থানের চেষ্টা। অন্যদিকে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করারও সত্যিকার প্রচেষ্টা ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম থেকে জেনারেল জিয়া ও রেহমানের নাম উধাও হয়ে গেল।
পাকিস্তান বিমানবাহিনী গঠিত তদন্ত দল জানাল, বিমান দুর্ঘটনার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ কারণ নাশকতা। কিন্তু তারা পরবর্তী তদন্তকাজ বন্ধ করে দিল। প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনার ব্যাপকভিত্তিক তদন্তকাজ কখনোই হয়নি। পাকিস্তানে এ দুর্ঘটনার কোনো তথ্যপ্রমাণও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হেফাজতখানায় ২৫০ পৃষ্ঠার দলিল আছে, কিন্তু তা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত।
জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৮৮ সালেই নির্বাচন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যাতে নিজেকে একনায়কতন্ত্রী সরকারে ‘গণতান্ত্রিক’ প্রধান হিসেবে দেখানো যায়। তিনি বেনজিরের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেছিলেন, যিনি ১৯৮৫ সালের মতো নির্বাচন বয়কট করে ‘ক্ষমতা’ কেন্দ্রের বাইরে থাকতে চাননি। বেনজির বরাবরই সৌভাগ্যবতী, যা কিছু ঘটে তার সুফল তিনি পান। নির্বাচনের আগেই জিয়াউল হক মারা যান। বেনজির তাঁর অধীনে প্রধানমন্ত্রী পদ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন।
জান্তার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যাপারে দলের (পিপিপি) সিদ্ধান্ত কী হবে, তা নিয়ে বাবা (মুর্তজা ভুট্টো) বেনজিরের সঙ্গে কথাও বলেন। এ ব্যাপারে তিনি মৌখিকভাবে বেনজিরের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। আমি তাঁদের কথোপকথন স্মরণ করতে পারি।
বাবা বললেন, ‘অংশগ্রহণ’ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও? প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি কি জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে চাও?’
তিনি (মুর্তজা ভুট্টো) দলের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি মা অথবা বোনকে কোনো পরামর্শও দেননি, কাউকে প্রার্থী দাঁড় করাননি; তাঁর সমর্থনও জানাননি। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তাঁরা আরেকবার কথা বলেছেন। বেনজিরের স্বামী আসিফ আলী জারদারিকে দলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত লিয়ারি থেকে পিপলস পার্টির মনোনয়ন দিলে মুর্তজা খুবই আশাহত হন। তিনি বলেন, ‘এই এলাকা তো পিপিপি কর্মীদের জন্য, এটি তাঁদের এলাকা। তুমি কীভাবে তাঁকে সেখানে চাপিয়ে দাও?’
বেনজির তাঁর বিরোধিতা করলেন এবং সংলাপও শেষ হয়ে গেল।
আমি স্মরণ করতে পারি, সেই গ্রীষ্মেই বাবা পাকিস্তানে ফেরার বিষয়ে আলাপ করেছিলেন। তিনি সব সময় বাড়ির কথা, দেশে ফেরার কথা বলতেন। কিন্তু এবারই তিনি যোগ করলেন ‘ওয়াদিকে (বেনজির) বোলো না, ঠিক আছে?’
আমি ওয়াদা করলাম, ‘কিছু বলব না।’ ইতিমধ্যে (সম্পর্কে) ফাটল ধরে গেছে।
আমি অমিতব্যয়ী ছেলের দেশে ফিরে আসার বিষয়ে আলাপ করলে, পিপিপির স্পষ্টবাদী কর্মী মাওলা বক্স বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিতে আসল উত্তরাধিকার হচ্ছেন মীর বাবা (মুর্তজা)। ভাইদের অনুপস্থিতিতে বেনজির তাঁর রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন। কেননা তারা দেশে থাকলে তাদের জন্য তা হতো আরও ভয়ংকর। জুলফিকার তাঁর ছেলেদের বাইরে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের উত্তরাধিকার হিসেবে ভেবেছিলেন বলেই। বেনজির সে সময়ে যা করেছেন তা ব্যক্তি নয়, বরং ভুট্টো পরিবারের সদস্য হিসেবে।’
আগামীকাল: আরাফাতকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন বেনজির!
গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: সোহরাব হাসান।
প্রেসিডেন্টের বিমান ইসলামাবাদের উদ্দেশে রওনা হলো। এর আগে এ বছরই আল জুলফিকার ‘পাক ওয়ান’ বিমানে হামলা চালালেও অল্পের জন্য তা রেহাই পায়। ফলে এর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। বিমানের ককপিটে উইং কমান্ডার মাসুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল ছিল, যাঁরা সবাই জিয়াউল হক মনোনীত। বিমানটি যে রুটে ইসলামাবাদ থেকে এসেছিল, সেই রুটেই ফেরত যাচ্ছিল। বাওয়ালপুর থেকে তিনটা ৪৫ মিনিটে ‘পাক ওয়ান’ উড্ডয়ন করলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এডওয়ার্ড জে এপসটিন লিখেছেন, বিমানবন্দর থেকে ১৮ মাইল দূরত্বে গ্রামবাসী দেখতে পেলেন, পাক ওয়ান রোলার কোস্টারের মতো নিচে নামছে আর ওপরে উঠছে। এরপর এটি সরাসরি মরুভূমিতে এসে পড়ে এবং বিস্ফোরিত হয়। এর সব জ্বালানি পুড়ে যায় ও বিমানটি পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে। বিমানের আরোহী ৩১ জনই মারা যান।
দিনের বেলা সেদিন আবহাওয়া ছিল পরিষ্কার ও রোদঝলমলে। পাইলটের ভুল হওয়ারও কারণ ছিল না। সে সময় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে একটি আমের ঝুড়ি ‘পাক ওয়ান’-এ ওঠানো হয়েছিল এবং তাতে বিস্ফোরক ছিল। মানুষ বলাবলি করছিল, এই ফলই (ঝুড়িভর্তি আম) স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়।
এপসটিন আরও লিখেছেন, প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো দাবি ছিল না, ছিল না পাল্টা অভ্যুত্থানের চেষ্টা। অন্যদিকে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করারও সত্যিকার প্রচেষ্টা ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম থেকে জেনারেল জিয়া ও রেহমানের নাম উধাও হয়ে গেল।
পাকিস্তান বিমানবাহিনী গঠিত তদন্ত দল জানাল, বিমান দুর্ঘটনার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ কারণ নাশকতা। কিন্তু তারা পরবর্তী তদন্তকাজ বন্ধ করে দিল। প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনার ব্যাপকভিত্তিক তদন্তকাজ কখনোই হয়নি। পাকিস্তানে এ দুর্ঘটনার কোনো তথ্যপ্রমাণও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হেফাজতখানায় ২৫০ পৃষ্ঠার দলিল আছে, কিন্তু তা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত।
জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৮৮ সালেই নির্বাচন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যাতে নিজেকে একনায়কতন্ত্রী সরকারে ‘গণতান্ত্রিক’ প্রধান হিসেবে দেখানো যায়। তিনি বেনজিরের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেছিলেন, যিনি ১৯৮৫ সালের মতো নির্বাচন বয়কট করে ‘ক্ষমতা’ কেন্দ্রের বাইরে থাকতে চাননি। বেনজির বরাবরই সৌভাগ্যবতী, যা কিছু ঘটে তার সুফল তিনি পান। নির্বাচনের আগেই জিয়াউল হক মারা যান। বেনজির তাঁর অধীনে প্রধানমন্ত্রী পদ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন।
জান্তার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যাপারে দলের (পিপিপি) সিদ্ধান্ত কী হবে, তা নিয়ে বাবা (মুর্তজা ভুট্টো) বেনজিরের সঙ্গে কথাও বলেন। এ ব্যাপারে তিনি মৌখিকভাবে বেনজিরের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। আমি তাঁদের কথোপকথন স্মরণ করতে পারি।
বাবা বললেন, ‘অংশগ্রহণ’ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও? প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি কি জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে চাও?’
তিনি (মুর্তজা ভুট্টো) দলের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি মা অথবা বোনকে কোনো পরামর্শও দেননি, কাউকে প্রার্থী দাঁড় করাননি; তাঁর সমর্থনও জানাননি। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তাঁরা আরেকবার কথা বলেছেন। বেনজিরের স্বামী আসিফ আলী জারদারিকে দলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত লিয়ারি থেকে পিপলস পার্টির মনোনয়ন দিলে মুর্তজা খুবই আশাহত হন। তিনি বলেন, ‘এই এলাকা তো পিপিপি কর্মীদের জন্য, এটি তাঁদের এলাকা। তুমি কীভাবে তাঁকে সেখানে চাপিয়ে দাও?’
বেনজির তাঁর বিরোধিতা করলেন এবং সংলাপও শেষ হয়ে গেল।
আমি স্মরণ করতে পারি, সেই গ্রীষ্মেই বাবা পাকিস্তানে ফেরার বিষয়ে আলাপ করেছিলেন। তিনি সব সময় বাড়ির কথা, দেশে ফেরার কথা বলতেন। কিন্তু এবারই তিনি যোগ করলেন ‘ওয়াদিকে (বেনজির) বোলো না, ঠিক আছে?’
আমি ওয়াদা করলাম, ‘কিছু বলব না।’ ইতিমধ্যে (সম্পর্কে) ফাটল ধরে গেছে।
আমি অমিতব্যয়ী ছেলের দেশে ফিরে আসার বিষয়ে আলাপ করলে, পিপিপির স্পষ্টবাদী কর্মী মাওলা বক্স বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিতে আসল উত্তরাধিকার হচ্ছেন মীর বাবা (মুর্তজা)। ভাইদের অনুপস্থিতিতে বেনজির তাঁর রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন। কেননা তারা দেশে থাকলে তাদের জন্য তা হতো আরও ভয়ংকর। জুলফিকার তাঁর ছেলেদের বাইরে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের উত্তরাধিকার হিসেবে ভেবেছিলেন বলেই। বেনজির সে সময়ে যা করেছেন তা ব্যক্তি নয়, বরং ভুট্টো পরিবারের সদস্য হিসেবে।’
আগামীকাল: আরাফাতকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন বেনজির!
গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: সোহরাব হাসান।
No comments