চারদিক-শতবর্ষ পেরিয়ে জব্বারের বলীখেলা by মুহাম্মদ শামসুল হক

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার মধ্যে বড় পরিসরে ও বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানের আবদুল জব্বারের বলীখেলা। এ খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসে ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে। এ মেলা ‘বৈশাখী মেলা’ নামে খ্যাত।


মেলা বসে আন্দরকিল্লা মোড় থেকে বক্সিরহাট পুলিশ বিট হয়ে লালদিঘীর চারদিক, হজরত আমানত শাহ (রহ.) মাজার পেরিয়ে জেল রোডের বিস্তৃত অংশ, দক্ষিণে বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বর পেরিয়ে কোতোয়ালি থানার মোড় এবং পশ্চিমে কেসিদে রোড হয়ে সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪, ২৫ ও ২৬ এপ্রিল তিন দিনের জন্য আয়োজনের কথা বলা হলেও মেলা বসার প্রক্রিয়া শুরু থেকে ভাঙন পর্যন্ত পাঁচ-ছয় দিন ধরে চলতে থাকে মেলা-মেলা খেলা। এর মধ্যে বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ এপ্রিল (১২ বৈশাখ)।
জব্বারের বলীখেলার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম নগরের বক্সিরহাট ওয়ার্ডের বদরপাতি এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত আবদুল জব্বার সওদাগর। তাঁর গ্রামের বাড়ি ছিল হাটহাজারী থানার ফতেহপুর গ্রামে। প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে জানা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের ধারা বজায় রাখা, একই সঙ্গে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবে উদ্বুদ্ধ করে তাঁদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন এবং মনোবল সুদৃঢ় রাখার উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদিঘী মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বার্মার আরাকান থেকেও নামীদামি বলীরা জব্বারের বলীখেলায় অংশ নিতেন। বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রামের কিছু শৌখিন বলী এই খেলার ঐতিহ্য ধরে রাখছেন বলা যায়। কারণ, একসময় রাজা-বাদশা, গ্রামীণ সর্দার, মাতব্বরসহ বিভিন্ন মহলে বলী তথা কুস্তিগীরদের কদর ছিল। তাঁদের দেখা হতো বীর হিসেবে। আধুনিক যুগে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন কৌশল আবিষ্কৃত হওয়ায় কুস্তিচর্চা তেমন নেই বললেই চলে। তাই খেলার চেয়ে মেলাই জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে।
জব্বারের বলীখেলার মেলায় এমন কোনো পণ্যসামগ্রী নেই, যা পাওয়া যায় না। ছোটদের খেলনাপাতি, যেমন—নানা আকৃতি-প্রকৃতির প্লাস্টিকের পুতুল, ঘরবাড়ি, বন্দুক, বাস-কার, ঘড়ি, রেডিও, বল, পশুপাখি (মাটির তৈরিসহ), টমটম গাড়ি, বাঁশি, স্প্রিংযুক্ত বল, উড়োজাহাজ, মুখোশ, নৌকা, তালপাতার সেপাই, ঘর সাজানোর নানা কারুপণ্য, তৈজসপত্র, ফ্লোরম্যাট, কার্পেট, মাটির পুতুল, ফুল ও ফুলদানি, শীত১ল পাটি, চাটাই, মাদুর, ঝাড়ু; তামা, পিতল ও কাঁসার সামগ্রী, পালকের তৈরি বিভিন্ন পশুপাখি, ক্রোকারিজ সামগ্রী, কসমেটিকস, চুড়ি-গয়নাসহ মনোহারি দ্রব্য; ঘরগেরস্থির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কুলা, চালুনি, রুটি বেলার পিঁড়ি, পাটা-পুতা (শিল), দা-খুন্তি, কুড়াল, কোদাল, বঁটি, ছুরি, নাশতা-পিঠা তৈরির বিভিন্ন নকশার ডায়াস; হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, যেমন—পাটের শিকা, দোলনা, থলে, টেবিলম্যাট, শাড়ি, লুঙ্গি, শার্টসহ ছেলেমেয়েদের নানা রকম কাপড়; কাঠ, স্টিল, প্লাস্টিক ও বেতের চেয়ার-টেবিলসহ নানা ডিজাইনের আসবাব; গ্রাম-গ্রামান্তরে তৈরি হরেক রং-রূপে সাজানো ঐতিহ্যবাহী খাদ্যদ্রব্য, যেমন—গজা, খই, মুড়ি-খইয়ের মোয়া, তিলের মোয়া, চিনিমাখা ছোলাবুট, মুড়ি, বাতাসা, নাড়ু, জব ও ভুট্টা, জিলাপি, মিষ্টি, দই, পাপড়ি, চনাচুর, বাঙি, তরমুজ, ডাব-নারকেলসহ মৌসুমি ফলমূল, বিভিন্ন জাতের ফলমূলের বীজ, গাছের চারা (পুরো নার্সারি সাজিয়ে বসে মেলায়), দেশি-বিদেশি পোষাপাখি, নানা জাতের শুঁটকিসহ কী থাকে না মেলায়। মাটির তৈরি অনেক পাত্রকে মনে হবে মেটালিক বা সিরামিকের সামগ্রী। এসবের পাশাপাশি মেলায় থাকে নাগরদোলা, ভ্যারাইটি শো, সার্কাস, পুতুলনাচ, কৌতুক-ম্যাজিক প্রদর্শনী ইত্যাদি।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উদ্যোক্তা-বিক্রেতারা আসেন তাঁদের বাছাই করা পণ্য নিয়ে।
একসময় মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল মৃৎপাত্র। মিষ্টি ও রান্নাবান্নার হাঁড়িপাতিল, তরকারি রান্নার তেলইন, বরুনা (ঢাকনা), ভাত খাওয়ার পাত্র ‘হানক’, ‘হদ্দা’ বা খোড়া (ছোট আকারের মাটির গামলা), মাছের আঁশ ছাড়ানোর পাত্র, মেজবানি বা বিয়ের অনুষ্ঠানের মাংস পরিবেশনের বড় পাত্র, বদনা, পিঠা তৈরির পাতিল ‘ফঁইন’, দুধের পাত্র ‘আউত্তা’, ধান, চাল, ডাল, সুপারি রাখার বড় পাত্র মটকা, চেরাগ, শীতে আগুন পোহানোর পাত্র ‘আইল্যা’, বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির ডায়াস (ভ্যুঁই), কলসি, ফিরনির বাটি ইত্যাদি ঘরে ঘরে ব্যবহূত হতো। বছরের চাহিদা অনুযায়ী মানুষ মেলা থেকে নিয়ে যেত এসব সামগ্রী। রাউজানের কদলপুর, হাটহাজারীর মির্জাপুর, জোবরা, পটিয়ার কেলিশহর, চন্দনাইশের কাঞ্চননগর কুলালপড়া, হাশিমপুর, বাঁশখালীর কালিপুর ও ঢেঁইছড়া এলাকার মৃিশল্পের (মাটির তৈরি পাত্র) সুনাম ছিল ক্রেতা-বিক্রেতা সবার মুখে মুখে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির উত্কর্ষের যুগে এসবের ব্যবহার আজকাল নেই বললেই চলে। মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার এখন চলে অন্যভাবে, ভিন্ন আকর্ষণে। ঘরগেরস্থির কাজে নিত্যব্যবহারের পরিবর্তে মধ্যবিত্ত পরিবারের বৈঠকখানা কিংবা বাগানের শোভা বাড়ানোর জন্য তৈজসপত্রের সমাদর এখন বেশি দেখা যায়।
যুগের বিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৌন্দর্য অন্বেষার ফলে মৃৎপাত্রগুলোর গঠন, অলংকরণ, নকশা এখন বহুগুণে রুচিশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম।
১২ বৈশাখ (২৫ এপ্রিল) ১০১ বছর পূর্ণ হবে এ মেলার।

No comments

Powered by Blogger.