সপ্তাহের হালচাল-সংসদ যদি ‘চিড়িয়াখানা’ হয়, সাংসদেরা কী? by আব্দুল কাইয়ুম
খুলনায় বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংসদকে ‘মাছের বাজার ও চিড়িয়াখানা’ বানানোর অভিযোগ এনে বলেছেন, সংসদে তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। গণতন্ত্র ও সংসদের জন্য দেশবাসী রক্ত দিয়েছে।
সামরিক শাসনের জোয়াল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য দুবার দেশবাসীকে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম করতে হয়েছে। এত কিছুর পর কেউ যদি সংসদকে চিড়িয়াখানার সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে তো দেশবাসীর আত্মদানকে অবজ্ঞা করা হয়।
সংসদ অধিবেশন সুন্দরভাবে পরিচালনার দায়িত্ব সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েরই। সংসদে বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেওয়া, সুস্থ বিতর্ক না হওয়া, রাজনৈতিক বিতর্কের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক কথা বলা প্রভৃতি সমস্যা সংসদের ভেতর সাংসদদেরই সমাধান করতে হবে। সংসদের প্রথম সারিতে বেশি আসন না দিলে যদি বিএনপি মাসের পর মাস সংসদ অধিবেশন বর্জন করে, তাহলে দায় কার? এটা কি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হলো? আসনসংখ্যা নিয়ে দরাদরি করে এখন নিজেরাই ‘মাছের বাজার’ বানানোর অভিযোগ আনছেন। এটা হাস্যকর।
এই সংসদকে যদি খালেদা জিয়া ‘চিড়িয়াখানা’ বলেন, তাহলে বিগত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁদের আমলে সংসদ কী ছিল? তখন কি সবকিছু খুব ভালোভাবে চলছিল? তখন কি সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা হয়নি? হট্টগোল হয়নি?
আজ বিএনপি সংসদ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আনছে, তাদের আমলেও সেই একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হবিগঞ্জে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলে ওই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সংসদে আলোচনা করতে পর্যন্ত বাধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা ও তাঁকে হত্যাচেষ্টার নৃশংস ঘটনার পরও সংসদে আলোচনায় সরকারি দল বিএনপি বাধা দিয়েছে। গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ রকম আরও অনেক ঘটনায় বিগত বিএনপি সরকারের আমলে প্রায় পুরো সময়টাই সংসদ ডামাডোলের মধ্য দিয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগ বারবার সংসদ বর্জন করেছে। সংসদে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। এই সব কীর্তির পর এখন বিএনপির চেয়ারপারসন বলছেন, বর্তমান সংসদ ‘মাছের বাজার’! সুঁই যদি চালুনির ছিদ্রান্বেষণ করে, ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়?
আজ বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদকে চিড়িয়াখানার খেতাবে ভূষিত করছেন, আর ভাব দেখাচ্ছেন সব দোষ যেন সরকারি দলের। সরকারি দল আওয়ামী লীগ নিষ্কলুষ, তা কেউ বলবে না। কিন্তু তাদের কলুষতা দিয়ে তো বিএনপি নিজেদের কলুষমুক্ত করতে পারবে না। আর তা ছাড়া সংসদকে ‘মাছের বাজার’ বা ‘চিড়িয়াখানা’ বলার বিপদটা হলো, সংসদের সদস্যদের পরিচয়টাকেও সেই নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। আর তখন তাঁদের, অর্থাৎ বিএনপির সাংসদেরাও নিজেদের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিজেদের প্রাণিকুলের পর্যায়ে নামিয়ে আনেন, কারণ সংসদে তো তাঁরাও আছেন, সংখ্যা যত কমই হোক না কেন।
বিরোধী দলের রাজনীতি এক দিক দিয়ে সহজ, আবার অন্য দিক দিয়ে কঠিনও। দেশে তো সমস্যার অন্ত নেই। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে সময় লাগে না। বিএনপিও এখন হয়তো সে রকম ভাবছে। খুলনায় তাদের মহাসমাবেশ হয়ে গেল। এর আগে চট্টগ্রামে বড় সমাবেশ হয়েছে। গরম গরম কথাও তারা বলেছে। ছয়টি বিভাগীয় মহাসমাবেশের পর ১৯ মে ঢাকার মহাসমাবেশে তারা আগামী দিনের আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে। সেটা কী? সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগবে তারা? খুলনার সমাবেশে তো খালেদা জিয়া বলেই দিলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, ক্ষমতায় আসলে এমন মামলা হবে, দিনরাত আদালতের বারান্দায় ঘোরাফেরা করতে করতে সময় পার হবে’ (যুগান্তর, ১৯ এপ্রিল)।
প্রশ্ন হলো বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সময় কি এসে গেছে? আন্দোলনের কর্মকৌশল ঠিক করার আগে তাদের অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করতে হবে। কারণ, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সময় একটু আলাদা।
কোন দিক থেকে আলাদা? নানা দিক থেকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এক-এগারো নামে পরিচিত ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তন বিশেষভাবে বিএনপির রাজনীতি কঠিন করে তুলেছে। এত কঠিন যে জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরসূরি বলে বিবেচিত তারেক রহমানকে ‘চিকিৎসার’ জন্য দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি লন্ডনে চলে যান। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তখন বলতে হয়েছে যে তারেক রহমান দু-তিন বছরের জন্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, তারেক রহমান ‘আপাতত রাজনীতি থেকে একদম দূরে থাকবে’। এর প্রায় সাড়ে তিন মাস পর ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তাঁদের শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
আগে তো কখনো এ রকম হয়নি। অতীতে, বিশেষ করে, আশির দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সময় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে। কিন্তু কখনো এত খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়নি। বরং আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি শক্তিশালী হয়েছে। ‘আপসহীন’ খ্যাতি অর্জন করেছে। তাহলে এবার কেন বিএনপির রাজনীতি এমন মার খেল? বিএনপি হয়তো নিজেদের বুঝ দিচ্ছে এই কথা বলে যে, এক-এগারোর মধ্য দিয়ে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটেছে, চক্রান্ত করে তাদের রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা হয়েছে, ইত্যাদি।
এ ধরনের কথাবার্তা দলীয় লোকজনকে প্রবোধ দেওয়ার কাজে লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু মানুষ কি বিনা বাক্যে তা মেনে নেবে? সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ তো তাদেরই নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। আস্থার মানুষ ছাড়া ওই সব গুরুত্বপূর্ণ পদে কারও নিয়োগ লাভের কথা নয়। রাষ্ট্রপতিও ছিলেন তাদেরই নির্বাচিত ও আস্থাভাজন। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির একেবারে কেন্দ্রের কাছাকাছি ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে শুধু রাষ্ট্রপতি পদ থেকে নয়, দল থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছিল অন্ধ আনুগত্য মেনে না নেওয়ার কারণে। তাই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার প্রধান শর্ত নিশ্চয়ই ছিল বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রতি প্রশ্নাতীত সমর্থন। এই খাস লোকগুলো কেন বিএনপির রাজনীতি বিলোপের জন্য উঠেপড়ে লাগতে যাবেন? এই প্রশ্নের একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর বিএনপিকেই বের করতে হবে। কল্পিত কিছু মুখরোচক কথা দিয়ে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটা হবে আত্মপ্রতারণার মতো ব্যাপার।
বিএনপি বিভিন্ন সময় বলেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে সেনা-সমর্থন ছিল বলেই তাদের এই পরিণতি বহন করতে হচ্ছে। এটা অন্তত বিএনপির বেলায় খাটে না। কারণ, সম্প্রতি ভোলা-৩ আসনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারাই সেনা নিয়োগের দাবি করছে। বিএনপি সবসময়ই মনে করে, সেনা-উপস্থিতি তাদের জন্য আশীর্বাদ। বিএনপির জন্মও সেনাছাউনি থেকে। সেনা-পরিবেশের শাসন তাদের বেশি পছন্দ। সে জন্যই আজ ভোলায় সেনা-উপস্থিতি তাদের একান্ত কাম্য। তাহলে মাত্র সোয়া এক বছর আগের নির্বাচনে সেনা-উপস্থিতি তাদের জন্য অভিশাপ হয় কীভাবে?
তাহলে বিএনপির রাজনীতির বিপর্যয় ঘটল কেন? ঘটল এ জন্য যে মানুষ তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এক-এগারোর পরিবর্তন বিএনপির মনঃপূত ছিল না, কিন্তু দলমত-নির্বিশেষে দেশের মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ, মানুষ সহিংস রাজনীতি চায় না, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ চায়। বিএনপির পাঁচ বছরের সরকার পরিচালনায় এসব ব্যাপারে মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে, নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করেছে। এই বিজয়ের সুফল তারা ধরে রাখতে পারবে কি পারবে না, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর। কিন্তু নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি যে ঘটেছে মানুষের সমর্থনবিচ্যুত হওয়ার কারণে, সেটাই বিএনপির জন্য বিবেচনার প্রধান বিষয়। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে এই সত্যটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
আর একটি বিষয়ে বিএনপির নজর দেওয়া দরকার। জামায়াতের সঙ্গে তাদের সনাতন জোট থাকবে কি থাকবে না। তৃণমূল কর্মীরা তো জামায়াতের সঙ্গে চলতে পছন্দ করে না। ‘আমাদের জামায়াত কর্মী ডাকে, আমরা লজ্জিত হই’। কথাগুলো বলেছেন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা। গত ১৭ এপ্রিল শনিবার রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের এ ধরনের যে মন্তব্য প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে তা এক কথায় ব্যতিক্রমী ও উৎসাহিত হওয়ার মতো। বদরগঞ্জে বিগত দুটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে চারদলীয় জোটের পক্ষে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বিএনপির প্রার্থী হতে না পারায় দলের মধ্যে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের ক্ষোভ অন্যখানে। তারা জামায়াতের লোক হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের চিন্তাভাবনার এই বাস্তবতা নিয়ে বিএনপিকে ভাবতে হবে।
সরকারের সামনে তিনটি সমস্যা। একদিকে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সমস্যায় মানুষ জর্জরিত, সরকার বেকায়দায়। অন্যদিকে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সহিংস ঘটনা এখন বলা যায় ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, হঠাৎ হঠাৎ ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, দোষ দেওয়া হয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের। এই তিন সংকটকে মূলধন করে বিরোধী দল সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করবে। বিরোধী দলের কাজই তো সরকারকে চাপে রাখা। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি সংসদকে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে, তাহলে বিএনপি ভুল করবে। সংসদকে বরং ব্যবহার করতে হবে।
এখন ভবিষ্যৎ রাজনীতির কৌশল নিয়ে বিএনপির গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
সংসদ অধিবেশন সুন্দরভাবে পরিচালনার দায়িত্ব সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েরই। সংসদে বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেওয়া, সুস্থ বিতর্ক না হওয়া, রাজনৈতিক বিতর্কের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক কথা বলা প্রভৃতি সমস্যা সংসদের ভেতর সাংসদদেরই সমাধান করতে হবে। সংসদের প্রথম সারিতে বেশি আসন না দিলে যদি বিএনপি মাসের পর মাস সংসদ অধিবেশন বর্জন করে, তাহলে দায় কার? এটা কি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হলো? আসনসংখ্যা নিয়ে দরাদরি করে এখন নিজেরাই ‘মাছের বাজার’ বানানোর অভিযোগ আনছেন। এটা হাস্যকর।
এই সংসদকে যদি খালেদা জিয়া ‘চিড়িয়াখানা’ বলেন, তাহলে বিগত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁদের আমলে সংসদ কী ছিল? তখন কি সবকিছু খুব ভালোভাবে চলছিল? তখন কি সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা হয়নি? হট্টগোল হয়নি?
আজ বিএনপি সংসদ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আনছে, তাদের আমলেও সেই একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হবিগঞ্জে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলে ওই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সংসদে আলোচনা করতে পর্যন্ত বাধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা ও তাঁকে হত্যাচেষ্টার নৃশংস ঘটনার পরও সংসদে আলোচনায় সরকারি দল বিএনপি বাধা দিয়েছে। গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ রকম আরও অনেক ঘটনায় বিগত বিএনপি সরকারের আমলে প্রায় পুরো সময়টাই সংসদ ডামাডোলের মধ্য দিয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগ বারবার সংসদ বর্জন করেছে। সংসদে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। এই সব কীর্তির পর এখন বিএনপির চেয়ারপারসন বলছেন, বর্তমান সংসদ ‘মাছের বাজার’! সুঁই যদি চালুনির ছিদ্রান্বেষণ করে, ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়?
আজ বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদকে চিড়িয়াখানার খেতাবে ভূষিত করছেন, আর ভাব দেখাচ্ছেন সব দোষ যেন সরকারি দলের। সরকারি দল আওয়ামী লীগ নিষ্কলুষ, তা কেউ বলবে না। কিন্তু তাদের কলুষতা দিয়ে তো বিএনপি নিজেদের কলুষমুক্ত করতে পারবে না। আর তা ছাড়া সংসদকে ‘মাছের বাজার’ বা ‘চিড়িয়াখানা’ বলার বিপদটা হলো, সংসদের সদস্যদের পরিচয়টাকেও সেই নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। আর তখন তাঁদের, অর্থাৎ বিএনপির সাংসদেরাও নিজেদের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিজেদের প্রাণিকুলের পর্যায়ে নামিয়ে আনেন, কারণ সংসদে তো তাঁরাও আছেন, সংখ্যা যত কমই হোক না কেন।
বিরোধী দলের রাজনীতি এক দিক দিয়ে সহজ, আবার অন্য দিক দিয়ে কঠিনও। দেশে তো সমস্যার অন্ত নেই। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে সময় লাগে না। বিএনপিও এখন হয়তো সে রকম ভাবছে। খুলনায় তাদের মহাসমাবেশ হয়ে গেল। এর আগে চট্টগ্রামে বড় সমাবেশ হয়েছে। গরম গরম কথাও তারা বলেছে। ছয়টি বিভাগীয় মহাসমাবেশের পর ১৯ মে ঢাকার মহাসমাবেশে তারা আগামী দিনের আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে। সেটা কী? সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগবে তারা? খুলনার সমাবেশে তো খালেদা জিয়া বলেই দিলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, ক্ষমতায় আসলে এমন মামলা হবে, দিনরাত আদালতের বারান্দায় ঘোরাফেরা করতে করতে সময় পার হবে’ (যুগান্তর, ১৯ এপ্রিল)।
প্রশ্ন হলো বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সময় কি এসে গেছে? আন্দোলনের কর্মকৌশল ঠিক করার আগে তাদের অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করতে হবে। কারণ, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সময় একটু আলাদা।
কোন দিক থেকে আলাদা? নানা দিক থেকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এক-এগারো নামে পরিচিত ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তন বিশেষভাবে বিএনপির রাজনীতি কঠিন করে তুলেছে। এত কঠিন যে জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরসূরি বলে বিবেচিত তারেক রহমানকে ‘চিকিৎসার’ জন্য দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি লন্ডনে চলে যান। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তখন বলতে হয়েছে যে তারেক রহমান দু-তিন বছরের জন্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, তারেক রহমান ‘আপাতত রাজনীতি থেকে একদম দূরে থাকবে’। এর প্রায় সাড়ে তিন মাস পর ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তাঁদের শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
আগে তো কখনো এ রকম হয়নি। অতীতে, বিশেষ করে, আশির দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সময় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে। কিন্তু কখনো এত খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়নি। বরং আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি শক্তিশালী হয়েছে। ‘আপসহীন’ খ্যাতি অর্জন করেছে। তাহলে এবার কেন বিএনপির রাজনীতি এমন মার খেল? বিএনপি হয়তো নিজেদের বুঝ দিচ্ছে এই কথা বলে যে, এক-এগারোর মধ্য দিয়ে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটেছে, চক্রান্ত করে তাদের রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা হয়েছে, ইত্যাদি।
এ ধরনের কথাবার্তা দলীয় লোকজনকে প্রবোধ দেওয়ার কাজে লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু মানুষ কি বিনা বাক্যে তা মেনে নেবে? সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ তো তাদেরই নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। আস্থার মানুষ ছাড়া ওই সব গুরুত্বপূর্ণ পদে কারও নিয়োগ লাভের কথা নয়। রাষ্ট্রপতিও ছিলেন তাদেরই নির্বাচিত ও আস্থাভাজন। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির একেবারে কেন্দ্রের কাছাকাছি ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে শুধু রাষ্ট্রপতি পদ থেকে নয়, দল থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছিল অন্ধ আনুগত্য মেনে না নেওয়ার কারণে। তাই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার প্রধান শর্ত নিশ্চয়ই ছিল বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রতি প্রশ্নাতীত সমর্থন। এই খাস লোকগুলো কেন বিএনপির রাজনীতি বিলোপের জন্য উঠেপড়ে লাগতে যাবেন? এই প্রশ্নের একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর বিএনপিকেই বের করতে হবে। কল্পিত কিছু মুখরোচক কথা দিয়ে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটা হবে আত্মপ্রতারণার মতো ব্যাপার।
বিএনপি বিভিন্ন সময় বলেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে সেনা-সমর্থন ছিল বলেই তাদের এই পরিণতি বহন করতে হচ্ছে। এটা অন্তত বিএনপির বেলায় খাটে না। কারণ, সম্প্রতি ভোলা-৩ আসনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারাই সেনা নিয়োগের দাবি করছে। বিএনপি সবসময়ই মনে করে, সেনা-উপস্থিতি তাদের জন্য আশীর্বাদ। বিএনপির জন্মও সেনাছাউনি থেকে। সেনা-পরিবেশের শাসন তাদের বেশি পছন্দ। সে জন্যই আজ ভোলায় সেনা-উপস্থিতি তাদের একান্ত কাম্য। তাহলে মাত্র সোয়া এক বছর আগের নির্বাচনে সেনা-উপস্থিতি তাদের জন্য অভিশাপ হয় কীভাবে?
তাহলে বিএনপির রাজনীতির বিপর্যয় ঘটল কেন? ঘটল এ জন্য যে মানুষ তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এক-এগারোর পরিবর্তন বিএনপির মনঃপূত ছিল না, কিন্তু দলমত-নির্বিশেষে দেশের মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ, মানুষ সহিংস রাজনীতি চায় না, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ চায়। বিএনপির পাঁচ বছরের সরকার পরিচালনায় এসব ব্যাপারে মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে, নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করেছে। এই বিজয়ের সুফল তারা ধরে রাখতে পারবে কি পারবে না, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর। কিন্তু নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি যে ঘটেছে মানুষের সমর্থনবিচ্যুত হওয়ার কারণে, সেটাই বিএনপির জন্য বিবেচনার প্রধান বিষয়। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে এই সত্যটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
আর একটি বিষয়ে বিএনপির নজর দেওয়া দরকার। জামায়াতের সঙ্গে তাদের সনাতন জোট থাকবে কি থাকবে না। তৃণমূল কর্মীরা তো জামায়াতের সঙ্গে চলতে পছন্দ করে না। ‘আমাদের জামায়াত কর্মী ডাকে, আমরা লজ্জিত হই’। কথাগুলো বলেছেন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা। গত ১৭ এপ্রিল শনিবার রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের এ ধরনের যে মন্তব্য প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে তা এক কথায় ব্যতিক্রমী ও উৎসাহিত হওয়ার মতো। বদরগঞ্জে বিগত দুটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে চারদলীয় জোটের পক্ষে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বিএনপির প্রার্থী হতে না পারায় দলের মধ্যে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের ক্ষোভ অন্যখানে। তারা জামায়াতের লোক হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের চিন্তাভাবনার এই বাস্তবতা নিয়ে বিএনপিকে ভাবতে হবে।
সরকারের সামনে তিনটি সমস্যা। একদিকে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সমস্যায় মানুষ জর্জরিত, সরকার বেকায়দায়। অন্যদিকে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সহিংস ঘটনা এখন বলা যায় ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, হঠাৎ হঠাৎ ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, দোষ দেওয়া হয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের। এই তিন সংকটকে মূলধন করে বিরোধী দল সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করবে। বিরোধী দলের কাজই তো সরকারকে চাপে রাখা। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি সংসদকে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে, তাহলে বিএনপি ভুল করবে। সংসদকে বরং ব্যবহার করতে হবে।
এখন ভবিষ্যৎ রাজনীতির কৌশল নিয়ে বিএনপির গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments