ভাঙন by নিরমিন শিমেল
সেদিন খুব ভোর থেকেই কুয়াশা জেঁকে বসেছিল। দুধের সরের মতো ঘন সাদা পর্দা আকাশ প্রকৃতি জুড়ে, চারধারে ছড়ানো অসীম শূন্যতা। মধ্য মাঘের কনকনে শীতে কাঁথার ওম থেকে বেরোতে ছগির উদ্দিনের একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। পুবের ঘরের ইন্দুর মা ভাপা পিঠা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। গলির ধারে মোড়ের ওপর তার পিঠার ছোট্ট দোকান এতক্ষণে জমজমাট।
টিনের চালে লতিয়ে ওঠা শিমডগায় মুক্তোদানার মতো শিশিরবিন্দু। উঠোনের কোণে মাটির উনুনে ঘুঁটের ঘুষঘুষে আগুনের স্বর্ণাভ লালিমা। খানিকক্ষণ আগে স্ত্রী নুরবানু গরম ভাতের হাঁড়ি নামিয়েছে। উনুনের কাছাকাছি আরামদায়ক উষ্ণতায় পিঁড়ি পেতে বসে ছগির। কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ ও সরষের তেল মেশানো শিমভর্তা দিয়ে মাখা গরমভাতের প্রথম গ্রাসটি যেই মুখে তুলেছে, খবরটা তখনই এল আচমকা, হাওয়ার গতিতে লোকমুখে। ভাতের থালা ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়েছিল ছগির।
বড়বাজারের কাছে আসতেই শোরগোলটা কানে গেল। মানুষের এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি, হাঁকাহাঁকি, যন্ত্রযানের যান্ত্রিক গর্জন ঠেলে সেই অবাঞ্ছিত দৃশ্যটি চোখে পড়ে। বুলডোজারের তাণ্ডবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার সাধের দোকানটি।
রাস্তার ধারের অবৈধ স্থাপনা, ফুটপাতের সারবদ্ধ দোকান—সব ভেঙে একাকার করে দিচ্ছে। উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে পলেস্তারা খসা ইটের দেয়াল ভেঙে চুরমার। দোকানের অধিকাংশ টুকরি চিড়ে-চ্যাপটা। কমলা, কলা, আপেল, আঙুর নিষ্পেষিত হয়ে মাটিতে লেপটে জাব জাব। ছগির দৌড়ে গিয়ে ফলগুলো জাপটে ধরে। থেঁতলানো ফলের রসাল কাদামাখা নির্যাস হাতে লেগে যায়। মুষ্টিবদ্ধ সে হাত বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
—হায় আল্লাহ, আমার দোকানডা ভাইঙ্গা দিল। আমার মালডি... আমার ফলডি...হা. হা. হায় আল্লাহ...।
বড় কষ্ট করে শহরে এ দোকানটি দিয়েছিল ছগির। পদ্মার করাল গ্রাসে ভিটেসহ আবাদি জমির সিংহভাগ যখন নদীগর্ভে তলিয়ে গেল, আশ্রয়হীন অনিশ্চয়তার দোলাচলে তখন চোখে সে সরষের ফুল দেখেছিল। ভিটেটুকু বিলীন হলেও টিনগুলো কোনোরকমে রক্ষা করতে পেরেছিল। তা-ই দিয়ে বাঁধের ধার ঘেঁষে শহরের শেষ মাথায় একটুকরো খাসজমির ওপর পরগাছার মতো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিল। কিন্তু উপার্জনহীন, খাদ্যহীন বেকার দিনগুলো বড় দীর্ঘ, যেন কাটতেই চায় না। পেটে ক্ষুধার উত্তাপ অথচ উনুনে উত্তাপহীন নির্জলা শূন্য হাঁড়ি, ছেলেমেয়েদের উপোসী শুষ্ক মুখ শেষ পর্যন্ত এনজিওর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ধরনের সাহায্যে সংস্থাগুলো প্রয়োজনে ভূমিহীন উদ্বাস্তু মহিলাদের নাকি তুলনামূলকভাবে সহজেই ঋণ দিয়ে থাকে।
স্ত্রীর নামে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিয়ে পণ্যসামগ্রী কিনে পসরা সাজায় ছগির। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে অযাচিতভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা দোকানটি। রোজগারের টাকায় উদ্বৃত্ত অংশ নগণ্য হলেও রোজকার খোরাকি জুটে যাচ্ছিল বেশ সচ্ছলভাবেই।
আহা, নিত্যদিনের মতো কাল রাতেও বেচাকেনা শেষে বাড়ি ফেরার আগে মালগুলো পলিথিন, চট ও মোটা রশি দিয়ে ভালো করে ঢেকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল, যা এত দিন ছিল নিশ্চিত নিরাপত্তায়, তা আজ ভেঙেচুরে একাকার।
কিছু ফল অগোচরে রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছিল। উৎসুক দর্শক, টোকাই এমনকি পথচলতি পথচারী সেগুলো হুড়োহুড়ি করে মহা-উৎসাহে কুড়িয়ে নিতে থাকে। ভাঙা তক্তা, বালি, ধ্বংসস্তূপের ভেতর লুটিয়ে পড়া ফল ছগির হামা দিয়ে খুঁজে খুঁজে তুলে নেয়। ধুলো ঝেড়ে সেগুলো টুকরিতে তোলে। মাত্র অর্ধেক ঝুড়ি ফল সে অক্ষত অবস্থায় কোনোরকমে রক্ষা করতে পারে।
এরপর শুরু হয় সংগ্রাম। ঝড়ে বিধ্বস্ত জীবনসংসার মাঝির নৌকাটিতে স্রোতের বিপরীতে গুণ টেনে চলার অবিরাম চেষ্টা..., গলির মোড়ের সরু বাঁকে অবশিষ্ট ফলগুলো নিয়ে ক্রেতার প্রতীক্ষায় থাকা...অবশেষে পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া।
ধীরে ধীরে ফলগুলো চোখের সামনে পচে যায়, নষ্ট হয়ে যায় এনজিও থেকে পাওয়া পুঁজিটুকু। বেকার জীবনের নিরন্ন হা-শূন্যতা অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এনজিও থেকে পাওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা, শেষ সম্বল স্ত্রীর নাকের সোনার বালিটিও শেষ পর্যন্ত এনজিওর গর্ভে তলিয়ে যায় অবলীলায়।
ছগিরের ওপর কিস্তি পরিশোধের উপর্যুপরি চাপ এখন পাল্টা প্রতিধ্বনি হয়ে নুরবানুর বুকে আঘাত হানে। ছগিরের কণ্ঠে সাপের হিসহিসানি।
—তর নামের দেনা, তুই শোধ করগা।
—আমি ক্যামনে শোধ করমু? আমার ট্যাকা আছেনি?
—ক্যা, বাপ-ভাইগো থন আইন্যা দেগা।
পরোক্ষ যৌতুকের এই দাবিটুকু নুরবানু মেনে নিতে পারে না, সে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে।
দেখতে দেখতে বর্ষা চলে আসে। ছগিরের ঘরের টিনের চালে এখন শিমলতার বদলে ঝিঙেলতা দোল খায়।
ছোট্ট শহরতলিতে রিকশা চলে না। তাই সে এখন ভ্যান চালায়। দিনশেষে আয়ের টাকায় ভ্যানভাড়া শোধ দিয়ে সামান্য যা হাতে থাকে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তা দিয়ে চার-চারটি পেটের খোরাকি মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ আর হয়ে ওঠে না। চক্রবৃদ্ধির হারে সেই ঋণের বোঝা স্ফীত হতে থাকে। উনুনে দুবেলা হাঁড়ি চড়ে না।
শ্রাবণের মাঝামাঝি এমনি এক দিনে সকাল থেকেই আকাশের পুব কোণে মেঘ জমেছিল। সুরমাধূসর গাঢ় মেঘের আস্তরণ ক্রমশ সমস্ত আকাশকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। ছগির উদ্দিনের ছোট্ট উঠানে ছোটখাটো একটা জটলা, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আঙিনার সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল।
ছগিরের ঘর থেকে টিন খুলে নেওয়া হচ্ছে। অদূরে দাঁড়িয়ে এনজিও কর্মী নিশীথ পোদ্দার তদারক করছিলেন। বাঁধন খুলে নামানোর সময় মেঘের গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিনগুলো ঝমঝম শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে। ছগিরের হূৎপিণ্ডে তা ড্রাম পেটানোর মতো বাজতে থাকে।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পুরোনো দিনের টিন, বেশ শক্ত, এখনকার মতো পাতলা ফ্যারফ্যারে না।
টিনগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ছগিরের কষ্ট হয়। সে পোদ্দার সাহেবের সামনে হাতজোড় করে মিনতি জানায়।
—হুজুর, আমগো মা-বাপ, এইবারকার মতো খ্যামতি দ্যান, আর কডা মাস অন্তত সময় দিলে...।
ছগিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই পোদ্দার তেড়ে ওঠেন।
—আহ্। ফ্যাঁচফ্যাঁচ করো না। এত দিন ধরে তো বহুত হাত কচলিয়েছ। সংস্থাকে কাঁচকলা দেখিয়েছ। এখন সরে দাঁড়াও। আমাদের কাজ করতে দাও।
নুরবানু ঘরের খুঁটি ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছিল। নিশীথ পোদ্দারের কথায় তার কান্নাজড়িত কণ্ঠ আরও জোরালো রূপ নেয়।
—আপনের পাও ধরি হুজুর, দয়া করেন। হারাদিন খাইট্টা আধপেট খাইয়া না-খাইয়া দেনা শোধ করমু, আর এট্টু সময় দেন।
—দেখো, সংস্থার একটি নিয়ম আছে। দেনা শোধের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। আর তো সময় দেওয়া যায় না।
টিনগুলো অনায়াসে ভ্যানে তোলা হয়। ধীরে ধীরে কতগুলো অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিছু পুরোনো স্মৃতি, মাথা বাঁচানোর শেষ আচ্ছাদনটুকু গলির মোড়ের শেষ বাঁকে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায়।
ছগিরের ঝাপসা দৃষ্টি গলির শেষ সীমানা থেকে ঘুরে এসে শূন্যে আঙিনায় ধাক্কা খায়। টিন খুলে নেওয়ার পর ঘরটি এখন প্রায় দিগম্বর। চাল থেকে খসে পড়া ঝিঙেলতা মাটিতে লুটানো। ওপাড়ার ক্ষেন্তিবুড়ি ও ইন্দুর মা ঝিঙেগুলো নির্দ্বিধায় ছিঁড়ে কোচরে ভরতে থাকে।
আকাশে ঘন কালো মেঘের পসরা, জোরে হাওয়া ছাড়ে। বাটুলগাছের শুকনো পাতা বানাডুলীর ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খায়। আঙিনায় ভিড় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে।
ছগির উদাসমুখে একবার আকাশের দিকে তাকায়। তারপর চালহীন ঘরের দরজায় ফাঁক দিয়ে তার দৃষ্টি ঝুলে থাকে। একটি ছোট তোরঙ্গ, রশিতে ঝোলানো কাপড়, তক্তপোষের ওপর দুই মাসের ছোট্ট শিশুসন্তান, মমতামাখা আটপৌরে ঘরকন্না আব্রুহীন পড়ে থাকে।বড়বাজারের কাছে আসতেই শোরগোলটা কানে গেল। মানুষের এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি, হাঁকাহাঁকি, যন্ত্রযানের যান্ত্রিক গর্জন ঠেলে সেই অবাঞ্ছিত দৃশ্যটি চোখে পড়ে। বুলডোজারের তাণ্ডবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার সাধের দোকানটি।
রাস্তার ধারের অবৈধ স্থাপনা, ফুটপাতের সারবদ্ধ দোকান—সব ভেঙে একাকার করে দিচ্ছে। উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে পলেস্তারা খসা ইটের দেয়াল ভেঙে চুরমার। দোকানের অধিকাংশ টুকরি চিড়ে-চ্যাপটা। কমলা, কলা, আপেল, আঙুর নিষ্পেষিত হয়ে মাটিতে লেপটে জাব জাব। ছগির দৌড়ে গিয়ে ফলগুলো জাপটে ধরে। থেঁতলানো ফলের রসাল কাদামাখা নির্যাস হাতে লেগে যায়। মুষ্টিবদ্ধ সে হাত বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
—হায় আল্লাহ, আমার দোকানডা ভাইঙ্গা দিল। আমার মালডি... আমার ফলডি...হা. হা. হায় আল্লাহ...।
বড় কষ্ট করে শহরে এ দোকানটি দিয়েছিল ছগির। পদ্মার করাল গ্রাসে ভিটেসহ আবাদি জমির সিংহভাগ যখন নদীগর্ভে তলিয়ে গেল, আশ্রয়হীন অনিশ্চয়তার দোলাচলে তখন চোখে সে সরষের ফুল দেখেছিল। ভিটেটুকু বিলীন হলেও টিনগুলো কোনোরকমে রক্ষা করতে পেরেছিল। তা-ই দিয়ে বাঁধের ধার ঘেঁষে শহরের শেষ মাথায় একটুকরো খাসজমির ওপর পরগাছার মতো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিল। কিন্তু উপার্জনহীন, খাদ্যহীন বেকার দিনগুলো বড় দীর্ঘ, যেন কাটতেই চায় না। পেটে ক্ষুধার উত্তাপ অথচ উনুনে উত্তাপহীন নির্জলা শূন্য হাঁড়ি, ছেলেমেয়েদের উপোসী শুষ্ক মুখ শেষ পর্যন্ত এনজিওর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ধরনের সাহায্যে সংস্থাগুলো প্রয়োজনে ভূমিহীন উদ্বাস্তু মহিলাদের নাকি তুলনামূলকভাবে সহজেই ঋণ দিয়ে থাকে।
স্ত্রীর নামে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিয়ে পণ্যসামগ্রী কিনে পসরা সাজায় ছগির। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে অযাচিতভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা দোকানটি। রোজগারের টাকায় উদ্বৃত্ত অংশ নগণ্য হলেও রোজকার খোরাকি জুটে যাচ্ছিল বেশ সচ্ছলভাবেই।
আহা, নিত্যদিনের মতো কাল রাতেও বেচাকেনা শেষে বাড়ি ফেরার আগে মালগুলো পলিথিন, চট ও মোটা রশি দিয়ে ভালো করে ঢেকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল, যা এত দিন ছিল নিশ্চিত নিরাপত্তায়, তা আজ ভেঙেচুরে একাকার।
কিছু ফল অগোচরে রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছিল। উৎসুক দর্শক, টোকাই এমনকি পথচলতি পথচারী সেগুলো হুড়োহুড়ি করে মহা-উৎসাহে কুড়িয়ে নিতে থাকে। ভাঙা তক্তা, বালি, ধ্বংসস্তূপের ভেতর লুটিয়ে পড়া ফল ছগির হামা দিয়ে খুঁজে খুঁজে তুলে নেয়। ধুলো ঝেড়ে সেগুলো টুকরিতে তোলে। মাত্র অর্ধেক ঝুড়ি ফল সে অক্ষত অবস্থায় কোনোরকমে রক্ষা করতে পারে।
এরপর শুরু হয় সংগ্রাম। ঝড়ে বিধ্বস্ত জীবনসংসার মাঝির নৌকাটিতে স্রোতের বিপরীতে গুণ টেনে চলার অবিরাম চেষ্টা..., গলির মোড়ের সরু বাঁকে অবশিষ্ট ফলগুলো নিয়ে ক্রেতার প্রতীক্ষায় থাকা...অবশেষে পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া।
ধীরে ধীরে ফলগুলো চোখের সামনে পচে যায়, নষ্ট হয়ে যায় এনজিও থেকে পাওয়া পুঁজিটুকু। বেকার জীবনের নিরন্ন হা-শূন্যতা অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এনজিও থেকে পাওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা, শেষ সম্বল স্ত্রীর নাকের সোনার বালিটিও শেষ পর্যন্ত এনজিওর গর্ভে তলিয়ে যায় অবলীলায়।
ছগিরের ওপর কিস্তি পরিশোধের উপর্যুপরি চাপ এখন পাল্টা প্রতিধ্বনি হয়ে নুরবানুর বুকে আঘাত হানে। ছগিরের কণ্ঠে সাপের হিসহিসানি।
—তর নামের দেনা, তুই শোধ করগা।
—আমি ক্যামনে শোধ করমু? আমার ট্যাকা আছেনি?
—ক্যা, বাপ-ভাইগো থন আইন্যা দেগা।
পরোক্ষ যৌতুকের এই দাবিটুকু নুরবানু মেনে নিতে পারে না, সে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে।
দেখতে দেখতে বর্ষা চলে আসে। ছগিরের ঘরের টিনের চালে এখন শিমলতার বদলে ঝিঙেলতা দোল খায়।
ছোট্ট শহরতলিতে রিকশা চলে না। তাই সে এখন ভ্যান চালায়। দিনশেষে আয়ের টাকায় ভ্যানভাড়া শোধ দিয়ে সামান্য যা হাতে থাকে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তা দিয়ে চার-চারটি পেটের খোরাকি মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ আর হয়ে ওঠে না। চক্রবৃদ্ধির হারে সেই ঋণের বোঝা স্ফীত হতে থাকে। উনুনে দুবেলা হাঁড়ি চড়ে না।
শ্রাবণের মাঝামাঝি এমনি এক দিনে সকাল থেকেই আকাশের পুব কোণে মেঘ জমেছিল। সুরমাধূসর গাঢ় মেঘের আস্তরণ ক্রমশ সমস্ত আকাশকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। ছগির উদ্দিনের ছোট্ট উঠানে ছোটখাটো একটা জটলা, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আঙিনার সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল।
ছগিরের ঘর থেকে টিন খুলে নেওয়া হচ্ছে। অদূরে দাঁড়িয়ে এনজিও কর্মী নিশীথ পোদ্দার তদারক করছিলেন। বাঁধন খুলে নামানোর সময় মেঘের গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিনগুলো ঝমঝম শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে। ছগিরের হূৎপিণ্ডে তা ড্রাম পেটানোর মতো বাজতে থাকে।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পুরোনো দিনের টিন, বেশ শক্ত, এখনকার মতো পাতলা ফ্যারফ্যারে না।
টিনগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ছগিরের কষ্ট হয়। সে পোদ্দার সাহেবের সামনে হাতজোড় করে মিনতি জানায়।
—হুজুর, আমগো মা-বাপ, এইবারকার মতো খ্যামতি দ্যান, আর কডা মাস অন্তত সময় দিলে...।
ছগিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই পোদ্দার তেড়ে ওঠেন।
—আহ্। ফ্যাঁচফ্যাঁচ করো না। এত দিন ধরে তো বহুত হাত কচলিয়েছ। সংস্থাকে কাঁচকলা দেখিয়েছ। এখন সরে দাঁড়াও। আমাদের কাজ করতে দাও।
নুরবানু ঘরের খুঁটি ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছিল। নিশীথ পোদ্দারের কথায় তার কান্নাজড়িত কণ্ঠ আরও জোরালো রূপ নেয়।
—আপনের পাও ধরি হুজুর, দয়া করেন। হারাদিন খাইট্টা আধপেট খাইয়া না-খাইয়া দেনা শোধ করমু, আর এট্টু সময় দেন।
—দেখো, সংস্থার একটি নিয়ম আছে। দেনা শোধের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। আর তো সময় দেওয়া যায় না।
টিনগুলো অনায়াসে ভ্যানে তোলা হয়। ধীরে ধীরে কতগুলো অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিছু পুরোনো স্মৃতি, মাথা বাঁচানোর শেষ আচ্ছাদনটুকু গলির মোড়ের শেষ বাঁকে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায়।
ছগিরের ঝাপসা দৃষ্টি গলির শেষ সীমানা থেকে ঘুরে এসে শূন্যে আঙিনায় ধাক্কা খায়। টিন খুলে নেওয়ার পর ঘরটি এখন প্রায় দিগম্বর। চাল থেকে খসে পড়া ঝিঙেলতা মাটিতে লুটানো। ওপাড়ার ক্ষেন্তিবুড়ি ও ইন্দুর মা ঝিঙেগুলো নির্দ্বিধায় ছিঁড়ে কোচরে ভরতে থাকে।
আকাশে ঘন কালো মেঘের পসরা, জোরে হাওয়া ছাড়ে। বাটুলগাছের শুকনো পাতা বানাডুলীর ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খায়। আঙিনায় ভিড় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে।
ঘন ঘন বিজলি চমকায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে। কাঁথা, কাপড়, তৈজসপত্রে বিন্দু বিন্দু জলকণা। শিশুটি কেঁদে ওঠে। নুরবানু দ্রুত ঘরে ঢুকে সন্তানের দিকে হাত বাড়ায়।
দূরে কোথাও বাজ পড়ে। ছগিরের বুকের ভেতর টানাপোড়েনের তীব্র আন্দোলন, যেন বর্ষার জলমথিত সর্বগ্রাসী পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ ধাক্কা মারে। নুরবানুর দিকে তাকাতেই যে তরঙ্গ দ্বিগুণ বেগে ফুঁসে ওঠে। তার কণ্ঠে বজ্রপাতের হুংকার...।
—খবরদার, অরে ছুঁবি না। অরে তুই ছুঁইতে পারবি না। বাইর হ ঘর থেইক্যা।
নুরবানু মুহূর্তে থমকে দাঁড়ায়, বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীকে একবার দেখে নেয় এবং তারপরই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
—ক্যা? ছুঁমু না ক্যা? বাইর হমু ক্যা? আমি কী দোষ করছি?
—দোষ করছ নাই মানে? তুই যত নষ্টের গোড়া। কত্ত কইরা কইলাম, ট্যাকাডা আইন্যা দে। কানেই হান্দাইলি না?
নুরবানু মুখ ভেংচায়, হাত নেড়ে বলে
—ই! আইন্যা দে। আমি কী কইনথন ট্যাকা আইন্যা দিমু। ক্যামুন মরদ তুমি? নিজের মুরোদ নাইকা, বউরে...।
ছগিরের আর সহ্য হয় না। কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই গর্জন করে স্ত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
—কী, এত্ত বড় চোপা, হারামজাদি, বাইর হ। অহনই বাইর হ, আমার ঘর থেইক্যা।
চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে বের করে আনে নুরবানুকে। তার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য রক্তিম মুখে অমানিশার প্রেতছায়া নাচে। কণ্ঠে সিডরের সর্বনাশা কাঁপন। নদীভাঙন, দোকানভাঙনের তাণ্ডবনৃত্যে এত দিনের পুষে রাখা সুপ্ত কষ্টগুলো আজকের এই চাল খুলে নেওয়া ঘর ভাঙনের আঘাতে তীব্র রূপ ধারণ করে এবং এ আঘাতের রেশ রুদ্ররূপে প্রচণ্ড আস্ফাালন ও আক্রোশে নুরবানুর ওপর আছড়ে পড়ে।
ছগিরের বুকের ভেতর এখন শুধু ভাঙনের খেলা। সংসার ভাঙনের তীব্র নেশায় তাকে পেয়ে বসে। দাঁতে দাঁত চেপে সে কেটে কেটে উচ্চারণ করে...
এক তালাক...দুই তালাক...তিন তালাক...
মাত্র তিনটি শব্দ অপ্রত্যাশিতভাবে ছুরির তীক্ষ ফলার মতো নুরবানুর হূৎপিণ্ডকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। দুহাতে কান চেপে সে আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ে।
আকস্মিক এ ঘটনায় বিস্মিত ক্ষেন্তিবুড়ি ও ইন্দুর মায়ের ক্ষিপ্র হাত দুটো ঝিঙেগাছের ওপর সহসা থমকে যায়। খানিকক্ষণ আগের ফিকে হয়ে যাওয়া জটলাটি আবার বাড়তে শুরু করে। তাদের আফসোস ও করুণামিশেল সান্ত্বনাবাক্য নুরবানুর চোখে আরও জ্বালা ধরিয়ে দেয়। পাঁচ বছরের ছেলে রতন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যা উতরে যায়। পড়শিরা সব একে একে চলে যেতে থাকে। শিশুটি আবার কেঁদে ওঠে। ছগির ঘরে ঢোকে। আর শূন্য আঙিনায় নুরবানু বাটুলগাছতলায় উটপাখির মতো হাঁটুতে মাথা রেখে অসহায়ভাবে ঠায় বসে থাকে। চারদিক থেকে মশা বিনবিন করে জেঁকে ধরে। দূরে ডোবা থেকে ব্যাঙ ডাকার শব্দ ভেসে আসে। রতন মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। একসময় ঘরে তক্তপোশের ওপর রতন ঘুমিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে নুরবানু উঠে দাঁড়ায়। ঘরের পাশ দিয়ে জীর্ণ ছোট্ট সদর দরজা। সে এগিয়ে যায়। চাল সরানোর পর ঝিঙেগাছটি তখনো মাটিতে পড়ে আছে। তার নেতিয়ে পড়া শাখায় নুরবানুর নিজস্ব বিম্ব দোল খায়। আলো-আঁধারিতে বেখেয়ালে মাড়াতে গিয়েও পা সরিয়ে নেয় নুরবানু। উবু হয়ে সযত্নে লতাটি সরিয়ে দেয়। গলির বাঁকে বিদ্যুৎ নেই, চাঁদ নেই, আলোহীন অন্ধকার পৃথিবী। নুরবানুর বুকের ভেতর উথালপাতাল ভাঙনের শব্দ, নদীর কূলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতোই অশান্ত সে শব্দ বাজতে থাকে। এ ভাঙনের খেলায় বাঁধা পড়ে থাকে তার সারাটা জীবন।
No comments