সম্পাদকের কলাম-নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি by ইমদাদুল হক মিলন

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। স্বল্পভাষী, নম্র, বিনয়ী, একেবারেই সাদামাটা জীবন যাপন করা মানুষটি কঠোর পরিশ্রমী। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকখানি বদলে দিয়েছেন তিনি। শিক্ষাক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে এই মানুষটির জন্য।


এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের যে হার আমরা দেখেছি এবং গত কয়েক বছরে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মানের যে উন্নতি লক্ষ করেছি, তার একক কৃতিত্ব বলতে গেলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের।
গত বছর চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যায় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার 'সুরের ধারা'র অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর পাশাপাশি বসেছিলাম। ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। অতিবিনয়ী মানুষটি শুধু বলছিলেন, 'আমি চেষ্টা করছি। শিক্ষাক্ষেত্রের চারদিকে এত এত সমস্যা, ভালো মানুষের এত অভাব, তার পরও আমি চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই অবস্থার উন্নতি হবে।'
আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, শিক্ষাব্যবস্থার অনেকখানি উন্নতি সত্যি সত্যি হয়েছে।
আর নাহিদ সাহেবের সঙ্গে আছেন শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। তিনি আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমরা তাঁকে চিনি কামাল চৌধুরী নামে। বাংলা ভাষার একজন মেধাবী কবি। বাংলা কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য এ বছর তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। কামাল চৌধুরী যেমন মেধাবী, তেমন কর্মঠ। নাহিদ সাহেবের মতো তিনিও অতিসৎ ও নির্লোভ মানুষ। এসব মানুষের কল্যাণেই দেশ এগোয়। আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রের অগ্রসরতা এসব মেধাবী মানুষের কল্যাণেই হয়েছে।
মেধাবী মানুষ আমাদের চারপাশে অনেক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা যথাযথভাবে তাঁদের কাজে লাগাতে পারি না। এই মুহূর্তে আরেকজন অতি উচ্চমানের মেধাবী মানুষের কথা আমার মনে পড়ছে। তাঁর নাম হাফিজ জি এ সিদ্দিকী। বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি সবচেয়ে বেশি নাম করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন তৈরি হয়, নর্থ সাউথ হচ্ছে সেই ইউনিভার্সিটি। হাফিজ জি এ সিদ্দিকী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর। তাঁর হাত ধরে, তাঁর নিরলস চেষ্টায়, মেধা ও মননে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। এই ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা গৌরব করে বলে, 'আমি নর্থ সাউথের স্টুডেন্ট।' যে অভিভাবকের ছেলে বা মেয়ে নর্থ সাউথে পড়ে, অভিভাবকরা গৌরব করে বলেন, 'আমার ছেলে, আমার মেয়ে নর্থ সাউথে পড়ছে।' বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এই সুনাম এনে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। হাফিজ জি এ সিদ্দিকীর অবদান এ ক্ষেত্রে অনেকখানি। বহু ভালো শিক্ষকের আলোয় এই প্রতিষ্ঠানটি আলোকিত। আরো কয়েকজন শিক্ষকের নাম আমার মনে পড়ছে, যেমন, বিবিএ'র ডিন আবদুল হান্নান চৌধুরী, এমবিএ'র ডিন মীর ওবায়দুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, বাংলা ভাষার বিখ্যাত লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অনুজপ্রতিম খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, যিনি নিজে একজন অসাধারণ অনুবাদক। পৃথিবীবিখ্যাত বেশ কিছু বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। খসরু মিয়া ছাত্রছাত্রীদের অতিপ্রিয় একজন শিক্ষক। একটি বড় প্রতিষ্ঠান, নামকরা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষের চেষ্টায় ও কর্মে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তৈরি হয়েছে এভাবে। গত ১৫-১৬ বছরে এই প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেঁৗছেছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোনো ছাত্রছাত্রীদের লুফে নেয় দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের মেধা, স্মার্টনেস, কর্মক্ষমতা জৌলুস বাড়িয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোর।
বেশ কয়েক বছর আগে আরটিভিতে প্রতি সপ্তাহে আমি একটা অনুষ্ঠান করতাম। অনুষ্ঠানের নাম 'প্রিয়মুখ'। ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে হাফিজ জি এ সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য, দেশ, শিক্ষা ও ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি কী কারণে মাত্র কয়েক বছরে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে পরিণত হয়েছে।
এই মহান শিক্ষককে নিয়ে মাঝখানে শুরু হয়েছিল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের একধরনের অশুভ তৎপরতা। তাঁকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হলো, চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান সাহেবকে নিয়ে নানা রকম কথা আমাদের কানে এলো, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলো দুর্নীতি-অনিয়ম, দু-একজন শিক্ষিকার সঙ্গে তাঁর অশোভন আচরণ ইত্যাদির কথা। এসব শুনে আমরা যেমন দুঃখিত হয়েছি, তেমনি বিস্মিত হয়েছি। এ রকম আন্তর্জাতিক মানের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এসব করেছেন!
আমার কিশোর বয়সের বন্ধু ড. নাশিদ কামাল। নাশিদ কামালের দাদা কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ, তাঁর বাবা জাস্টিস মোস্তফা কামাল, চাচা সংগীতশিল্পী মোস্তাফা জামান আব্বাসী, ফুফু বাংলা গানের আরেক কিংবদন্তি ফেরদৌসী রহমান। নাশিদ বহু গুণে গুণান্বিত। নজরুলসংগীত, লোকগীতির শিল্পী হিসেবে নাশিদের তুলনা নাশিদ নিজে। বিটিভিতে একসময় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বাংলা ও ইংরেজিতে উপন্যাস লিখেছে। সেসব উপন্যাস পড়ে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে বহুবার বিদেশে গিয়েছে। যেখানে গিয়েছে সেখানেই পেয়েছে অভূতপূর্ব সম্মান। পিএইচডি করেছে। ছাত্র হিসেবে ছিল অসাধারণ। নাশিদ আমার বন্ধু, এ নিয়ে আমি খুবই গৌরব বোধ করি।
নাশিদ কামাল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছিলেন। নর্থ সাউথের ছাত্রছাত্রীদের অনেকগুলো সংগঠন আছে। আমরা কালের কণ্ঠ'র পক্ষ থেকে তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিডিয়া পার্টনারের ভূমিকায় থাকি। বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের বহু অনুষ্ঠানের স্পনসরের দায়িত্ব নেয়। এ রকম এক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। অনুষ্ঠান শেষে ডাইনিং টেবিলে বসে নাশিদ আমাকে খুবই নিচু স্বরে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহজাহান সাহেব সম্পর্কে কিছু কথা বলল। টেবিলে শাহজাহান সাহেবও ছিলেন। নাশিদের কথা শুনে আমার গা শিউরে উঠল। এবং সেদিনই নাশিদ আমাকে বলল, 'চেয়ারম্যানের জন্য আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। আমার আগেও একজন শিক্ষিকা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, আমাকেও যেতে হবে।'
শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি চলে যেতে হলো নাশিদকে। নাশিদের মতো একজন উচ্চমানের মেধাবী শিক্ষককে হারাল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শুধু ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান সাহেবের জন্য। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
ট্রাস্টি বোর্ড, ট্রাস্ট- এই শব্দ দুটো শুনলে, শব্দের মাহাত্ম্য দুটো নিয়ে ভাবলে মানুষের মধ্যে একধরনের সমীহের ভাব জাগে। বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা- এসব শব্দ আমাদের মনে ভরসা তৈরি করে। কিন্তু এই বিশ্বস্ততা যখন নষ্ট হয়, বিশ্বাস ভঙ্গ করে একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন, অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারি ইত্যাদিতে জড়িত হন, তখন আমাদের দাঁড়ানোর জায়গাটা কেঁপে কেঁপে ওঠে।
তার পরও আশার কথা, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। মো. শাহজাহান সাহেবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। আগের ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে পাঁচ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কথা একটাই, নতুন কমিটিতে যেন কোনোভাবেই জায়গা করে নিতে না পারেন কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি।
আরেকটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কথা বলে এই লেখা শেষ করব। সেই ইউনিভার্সিটির নাম 'ইউআইটিএস'। ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস। কয়েক দিন আগে সামার সেমিস্টারের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী পিএইচপি গ্রুপের। ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে এসেছেন আমার অনুজপ্রতিম ড. মোহাম্মদ সামাদ। শিক্ষক হিসেবে আপন আলোয় যেমন উজ্জ্বল সামাদ, কবি হিসেবেও। বাংলা ভাষার বিশিষ্ট একজন কবি তিনি। ড. মোহাম্মদ সামাদের মতো শিক্ষক যে প্রতিষ্ঠানের ভাইস চ্যান্সেলর সেই প্রতিষ্ঠান অতিদ্রুতই সুনামে গৌরবে বড় হয়ে উঠবে, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন পিএইচপি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইউআইটিএস ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী। অসাধারণ একটি বক্তৃতা দিলেন তিনি। সেই বক্তৃতায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক এবং ট্রাস্টি বোর্ডের দায়িত্ব নিয়ে যেসব কথা তিনি বললেন, শুনে আমার মুগ্ধতা বহুগুণ বেড়ে গেল। দেশ, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের যে দায়িত্ব ও সততার কথা তিনি বললেন, এবং যে সততা, দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা ও ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি বিশ্বস্ততার কথা তিনি বললেন, যে ধরনের মানুষের কথা তিনি বললেন, আমরা চাই দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তেমন দায়িত্বশীল ও সৎ মানুষ জড়িত হোক। কোনো অসৎ, ভণ্ড, দুর্নীতিবাজ, লোভী মানুষের ছায়া যেন না পড়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। আর কোনো শাহজাহান সাহেবের কবলে যেন না পড়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.