চিরকুট-খোকা-খুকু আর কাঠবিড়ালী by শাহাদুজ্জামান

কাঠবিড়ালী পেয়ারা খায় কি না, আমাদের খোকা-খুকুদের এ খবর জানার আর কোনো উপায় নেই। কাঠবিড়ালীকে যে জিজ্ঞেস করবে, সে সুযোগও নেই। আমরা সব কাঠবিড়ালীকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছি তেপান্তরে। শহর ছেড়ে দূরে কোনো ঝোপঝাড়ে পলায়নপর কোনো কাঠবিড়ালীর উঁচিয়ে থাকা লেজ দেখবে, সে সময়ই বা কোথায়?


কে সেই শেষ নিষ্পাপ খুকু যে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করেছে, ‘কাঠবিড়ালী, কাঠবিড়ালী, পেয়ারা তুমি খাও...বাতাবি লেবু, লাউ?’ এ শহরে কে সেই শেষ দুরন্ত খোকা যে গাছের মগডালে উঠে বিস্ময়ভরা চোখে দেখেছে পাখির বাসায় অদ্ভুত দুটি সবুজ ডিম?
এসব পাখি, প্রজাপতি, ভ্রমর নিয়ে ছেলেমানুষি বিস্ময়ের দিন ফুরিয়েছে তাদের। খোকা-খুকুরা মোটেও আর ছেলেমানুষ থাকতে রাজি নয়। ভ্রমরকে তারা এখন চেনে অন্যভাবে। গানের খুদে রাজা হওয়ার প্রতিযোগিতায় বছর আটের এক খুকু দেখি গাইছে, ‘ভ্রমর যখন ফুলের সাথে করে আলিঙ্গন, চাইয়া থাকি তখন আমার কেমন করে মন’। তারই বয়সী আরেক খোকা গাইছে, ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন, কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে, ফুটবে যখন ফুল বকুল শাখে, ভ্রমর যে এসেছিল জানবে লোকে’। বিজ্ঞ বিচারকেরা শিশুগায়কদের এই কামস্পর্শমাখা গানের মূর্ছনায় তন্ময় হয়ে থাকেন। সেই যে কবে নজরুল রেখে গিয়েছিলেন ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’, তারপর শিশুতোষ বিস্ময়কে গানে তুলে আনার সময় আমাদের আর হলো না। শিশুর বিস্ময় বরং এখন আমদের বাণিজ্যের বাহন। টেলিভিশন-বিজ্ঞাপনে দেখি স্কুলফেরত খোকা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে দোকানে সাজিয়ে রাখা সারি সারি মুঠোফোনসেটের দিকে। তারপর কোনো প্রজাপতির পেছনে নয়, বরং ওই খোকা বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক নকল মুঠোফোনসেট কানে লাগিয়ে, কোনো এক দিন পূর্ণাঙ্গ একজন মুঠোফোন-গ্রাহক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। অনেক খোকা-খুকুর স্বপ্ন অবশ্য এখনই সফল করেছেন তাদের অভিভাবকেরা। তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন মুঠোফোন। তারা আর এখন কিছু ভাবে না, স্বপ্ন দেখে না, দিনরাত কেবলই কথা বলে। মুঠোফোনে কথা চালাচালি করে, ছবি চালাচালি করে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গবেষণা করছেন আমার পরিচিত একজন গবেষক। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, গবেষণায় দেখা গেছে, আজকাল বহুসংখ্যক কিশোর-কিশোরীর যৌনসংক্রান্ত প্রাথমিক অভিজ্ঞতা হয় মুঠোফোনের মাধ্যমে। মুঠোফোনের মাধ্যমে যৌন বার্তা, যৌন ছবি চালাচালি করে তারা। নতুন প্রযুক্তিতে অতি সহজে ও বাণিজ্যিকভাবে মুঠোফোনে পর্নো ছবি ভরে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে সারা দেশে। একাধিক ঘটনা জানি, যেখানে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীর খোকাদের স্কুলব্যাগের বইয়ের ফাঁকে পাওয়া গেছে সচিত্র পর্নোপত্রিকা। শিশু-যৌনায়নের পাশাপাশি তাদের বিনোদনের অংশ এখন সহিংসতাও। সেদিন বছর বারোর দুই খোকার আলাপ শুনছিলাম। একজন বলছে, ‘তুই যে আমাকে গুলি করলি, সেটা কি ঘরের ভেতরে, না বাইরে?’ অন্যজন, ‘না না, তোর মনে নাই। আমি তো তোকে সিঁড়ির নিচে খুন করলাম।’ আমি কান পেতে তাদের আলাপের মর্ম উদ্ধার করতে গিয়ে বুঝলাম, খোকারা কথা বলছে কিছুক্ষণ আগে তারা যে ভিডিও গেমটি খেলেছে সেটি নিয়ে। দেখতে পাচ্ছি, আমাদের অলক্ষ্যে শিশু-কিশোরদের আনন্দের প্রধানতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে যৌনতা আর সহিংসতা।
মোট কথা, খোকা-খুকুদের কাঠবিড়ালীর দিন ফুরিয়েছে। বেশ আগে নৃবিজ্ঞানী তেরেস ব্লশে বাংলাদেশের শিশু-অধিকারসংক্রান্ত একটি বই লিখেছিলেন লস্ট ইনোসেন্স নামে। তাঁর বিবেচ্য ছিল নিম্নবিত্ত শিশু। কিন্তু এই শিরোনামটি এখন নাগরিক মধ্যবিত্ত শিশুদের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য বলা চলে। গভীর সাগরে হারিয়ে যাওয়া কোনো দ্বীপের মতো বুঝি বা হারিয়ে গেছে এসব শিশুর নির্মল শৈশব। আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তাদের দ্রুত ঠেলে দিয়েছি প্রাপ্তবয়স্কদের জগতে; যে জগতে আছে স্খলন, লোভ, রিপু আর রূঢ় প্রতিযোগিতা। শিশুদের স্কুলে প্রথম পা রাখার রোমাঞ্চকে আমরা পরিণত করেছি এক ভয়াবহ মহাযুদ্ধের রণাঙ্গনে। স্কুলের পড়াশোনাকে আমরা পরিণত করেছি নম্বর, পরীক্ষা, কোচিং ইত্যাদির এক আনন্দহীন ঘোর পাকচক্রে। শিশুদের সব খেলার মাঠকে ইট-কাঠে ভরিয়ে দিয়ে আমরা তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি চার দেয়ালের ভেতর, কম্পিউটার পর্দার সামনে। এমনকি দল বেঁধে স্কুলে যাওয়ার ছোট্ট আনন্দকেও করে তুলেছি অসম্ভব, কারণ থাবা বসানোর জন্য পথে পথে এখন ওত পেতে থাকে ভয়ংকর বাঘ।
মানুষের সারা জীবনকে যদি এক পাল্লায় আর শৈশবকে আরেক পাল্লায় রাখা হয়, তাহলে শৈশবের পাল্লাই ভারী হয়। শৈশবকে একদিন হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে যদিও আমাদের প্রবেশ করতে হয় প্রাপ্তবয়স্কদের বিখ্যাত জগতে, তবু বহুদিন আগে দেখা একটি মিষ্টি স্বপ্নের মতো শৈশব চলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। মহান জার্মান লেখক গ্যাটে একবার লিখেছিলেন, ‘চেরি আর স্ট্রবেরির সত্যিকার স্বাদ কেমন, সেটা শুধু জানে পাখি আর শিশুরা।’ আমাদের প্রাপ্তবয়স্কদের জিভে কালে কালে জমে অনেক কপটতা, কলুষ আর ভুলের প্রলেপ, ওতে আর সত্যিকার চেরির স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এ দেশের শিশুদের আমরা যে পৃথিবীর মুখোমুখি করেছি, তাতে তাদের জিব বুঝি এখনই বিস্বাদ হয়ে গেছে। এই গুমোট শৈশব কি একটা স্বপ্নের মতো তাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসবে? সন্দেহ করি। মনে হয় বাংলাদেশের নাগরিক শিশুদের পিঠভরা ব্যাগে গাদা গাদা বই আছে, হাতে মুঠোফোন আছে, ঘরে ভিডিও গেম, কম্পিউটার আছে, কিন্তু তাদের শৈশব নেই।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.