কল্পকথার গল্প-দায় কার-দায়িত্ব কে নেবে? by আলী হাবিব
খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি। বদল দেখছি। সকাল বদলে গিয়ে দুপুর আসছে। দুপুরের পর বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। রাত নামলে যে যার মতো ঘরে ফিরছি। কোথাও আড্ডায় সময় পার। আজকাল আবার আড্ডার পরিবেশও বদলে যাচ্ছে। আমি বদলে যাচ্ছি, আমার নিকট-বন্ধু বদলে যাচ্ছে। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা বদলে যাচ্ছে।
আত্মীয়স্বজন বদলে যাচ্ছে। এককথায়, আমরা সবাই বদলে যাচ্ছি। আমাদের কথাবার্তা বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে পোশাক-আশাক। আমাদের বিনোদনের মাধ্যম বদলে যাচ্ছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনের জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে নতুন এক ধারণা_সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। সামাজিক বাণিজ্যের হাতছানি আমাদের চারদিকে। চাকচিক্যের প্রলোভন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। এত দ্রুত সবকিছু বদলে যাচ্ছে যে অনেক সময় এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতেও পারছি না। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অনেক সময় আমরা হোঁচট খাচ্ছি। পরিবর্তন তো এভাবেই হয়। জগৎটা শুরু থেকেই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনেরও একটা ছন্দ আছে, গতি আছে। সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবাই চলতে পারে না। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে স্বাভাবিক চলার পথ থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু তার পরও এগিয়ে যেতে হয়। এগিয়ে না গেলে পিছিয়ে পড়তে হয়। কাজেই আমরা সবাই সেই পথের যাত্রী। সামনের দিকে যাচ্ছি, পথ চলছি অনেকটাই অন্ধের মতো। কিন্তু তার পরও আমাদের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে ধরনও। আগের দিনের ধ্যান-ধারণা নিয়ে আজকের দিনে পথচলা যায় না। আগের দিনে আমরা ছিলাম গ্রামনির্ভর। আজ আমরা নগরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। নাগরিক জীবনে আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি বদলে গেছে। কিন্তু গ্রামের সঙ্গে শহরের বা নগরের দূরত্ব কমে গেছে এবং যাচ্ছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। যে গ্রামে আগে গরুর গাড়ি চলত, সেখানে আজ বড় বড় বাস চলছে। মোবাইল ফোন চলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। যোগাযোগটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। মোবাইল, ইন্টারনেট, ব্যবসা-বাণিজ্য_সবকিছুতেই শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে গ্রাম। পরিবর্তনের হাওয়া শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও গিয়ে লেগেছে। ফলে পরিবর্তনটা কেবল যে শহরকেন্দ্রিক তা-ই নয়, পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে গ্রামেও। সেখানেও সবকিছু বদলে যাচ্ছে। জীবনযাত্রার পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রার মান। বদলানোর আর শেষ নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে বলে আমরা হা-হুতাশ করি। কিন্তু ভেঙে না গিয়েই বা উপায় কী? আমাদের জীবনাচার যেখানে বদলে গেছে, অনেক বন্ধন টিকে নেই, সেখানে যৌথ পরিবার থাকে কেমন করে? খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, কোনো গ্রামে একটা বাইসাইকেল এলে সেটা দেখার জন্য মানুষের ভিড় জমে যেত। আজ আকাশে রকেট উড়ছে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কল্যাণে বিদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সবকিছুই তো বদলে যাচ্ছে আমাদের। প্রতিদিনের অভ্যাস বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে বন্ধু। সময় গড়াচ্ছে, নতুন বন্ধু এসে জুটছে। বদলে যাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজ পুরোপুরি বদলে না গেলেও বদলে যাচ্ছে সমাজের মানুষ। ভাঙাগড়া চলছে, ওঠানামা চলছে। একটি শ্রেণী উঠছে, একটি শ্রেণী নামছে। সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক_সবদিক দিয়েই পরিবর্তনটা লক্ষণীয়। এই পরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় আমাদের। সমাজে এবং পরিবারে_দুই জায়গায়ই খাপ খাইয়ে নিতে হয়। খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে সমাজ এবং সংসার_দুই জায়গায়ই অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। দেখা দিতে পারে সংকট। সেই সংকট থেকে মুক্তির সহজ পথও আবার জানা নেই আমাদের। ব্যক্তিগত জীবনে সংকট দেখা দিলে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে আমরা আজকাল বোধ হয় একটু বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। অনেক ক্ষেত্রেই এক অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেও আমরা পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাকে চিনি না। কারো সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের মানবিকতা-সামাজিকতা-আন্তরিকতা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। এগুলোই কি বদলে যাওয়ার পরিণাম? আগে যাকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে হতো, তাকেই এখন শত্রু মনে হয়। আমাদের ক্ষোভ-আনন্দ প্রকাশের ধারাও যেন বদলে যাচ্ছে।
আগে সারা দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবা দর্শকপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে ক্রিকেট। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলছে। বাংলাদেশেই বসেছে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর। আগে বিদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলার যে দৃশ্য দেখা যেত, এখন ঢাকার মাঠে সেটাই দেখা যাচ্ছে। দেখা যাবে চট্টগ্রামের মাঠেও। কত পরিবর্তন! বাংলাদেশের নিজেদের খেলা হা-ডু-ডু কোথায় হারিয়ে গেল! ক্রিকেট এখন সবকিছু দখল করে নিয়েছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকাকে সাজানো হয়েছে। রাতের ঢাকা দেখে আজ আর চেনার উপায় নেই পুরনো সেই ঢাকাকে। ক্রিকেট নিয়ে মেতে আছি আমরা। আয়ারল্যান্ড দলকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। রাতভর যেন উৎসবের নগরী হয়ে উঠল ঢাকা। শেষ উইকেটটি পড়ল, অমনি যেন ভেঙে পড়ল রাতের ঢাকা। ছোট-বড় মিছিল বেরিয়ে গেল রাজধানীর পাড়া-মহল্লায়। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে হেরে যাওয়ার পর এসব দর্শকেরই অন্য চেহারা। দর্শকদের রাগ, ক্ষোভ_সব গিয়ে পড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ওপর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলোয়াড়দের বাসে ঢিল ছোড়া হলো। পরদিনই আবার হোটেলের সামনে 'Sorry' লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা। কথায় আছে, 'ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না'। আগে থেকে ভাবলে দর্শকরা নিশ্চয়ই এ কাণ্ডটি ঘটাতে যেত না। আগে থেকে ভেবে কাজ করার একটা মজার গল্প আছে। তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছিল। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জনসন সিদ্ধান্ত নিলেন, যে দলটি ভিয়েতনামে যাচ্ছে, সেই দলকে তিনি নিজে বিদায় জানাবেন। একটি বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। প্রেসিডেন্ট সেখানে গেলেন। কিন্তু যে দলটি ভিয়েতনামে যাচ্ছিল, সেই দলের সবাই আকণ্ঠ মদ্যপান করে এমন অবস্থায় ছিল যে প্রেসিডেন্টের সামনে তাদের হাজির করার মতো অবস্থা ছিল না। কী করা যায়? কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, যে দলটি ভিয়েতনাম থেকে ফিরেছে, সেই দলটিকেই প্রেসিডেন্টের সামনে হাজির করা হবে। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। দলটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট এতই আপ্লুত হয়ে গেলেন যে তিনি ঘোষণা করলেন, এই দল প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত তিনি তাদের সঙ্গে থাকবেন। কর্মকর্তাদের যে মাথায় হাত! শেষে যে দলটি মাত্রই যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, সে দলটিকেই আবার উঠতে হলো বিমানে।
দায়িত্ব না নিলে অবস্থা এমনই হয়। দায়টা গিয়ে পড়ে অন্য কারো ঘাড়ে। বদল করে দিলেই হয় না। বদলের দায়টাও নিজেদের নিতে হবে। সেই দায়টা কে নেবে? দায়িত্ব কার? একটা পৌরাণিক গল্পে যাওয়া যাক। দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার গল্প। বাল্মীকির নাম তো আমরা সবাই জানি। রামায়ণের রচয়িতা তিনি। আদি কবি। রাজা দশরথের সমবয়সী এই মহর্ষীর আশ্রম ছিল তমসা নদীর তীরে। সেখানেই তিনি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। যৌবনে তিনি রত্নাকর নামে এক দুর্দান্ত দস্যু ছিলেন। পথিকদের বধ করে সর্বস্ব লুট করতেন। একদিন ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন নারদ। রত্নাকর তাঁকে থামালেন। নারদকে বধ করে তিনি তাঁর সর্বস্ব লুণ্ঠন করতে চাইলেন। নারদ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কেন এই মহাপাপ করছেন? রত্নাকর উত্তর দিলেন, তিনি তাঁর পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণের জন্য এ কাজ করছেন। নারদ এবার জানতে চাইলেন, রত্নাকরের পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান কি এই পাপের ভাগ গ্রহণ করবেন? রত্নাকর জবাব দিলেন, অবশ্যই করবেন। নারদ বললেন, তাঁরা কেউই এই পাপের ফল ভোগ করবেন না। রত্নাকর রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বসলেন নারদকে। নারদও রত্নাকরের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি রত্নাকরকে বললেন তাঁর বাড়িতে যেতে। সেখানে গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, তাঁরা এই পাপের ভাগ নিতে রাজি আছেন কি না। নারদ এটাও নিশ্চিত করলেন, রত্নাকর না ফেরা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করবেন। দস্যু রত্নাকর বাড়িতে গিয়ে সবাইকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কেউই পাপের ভাগ নিতে সম্মত হলেন না। হতাশ রত্নাকর ফিরে এলেন। নারদকে জানালেন, বাড়িতে কেউই তাঁর পাপের ভাগ নিতে রাজি নন। তিনি এই মহাপাপের প্রতিকার কী, জানতে চাইলেন। রাম তখন তাঁকে রামমন্ত্র জপ করতে বললেন। রত্নাকর জানালেন, তিনি তো কেবল 'মরা' শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেন; 'রাম' শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেন না। বাল্মীকি একাদিক্রমে ৬০ হাজার বছর তপস্যা করেন। এ সময় তাঁর সারা শরীর বল্মীকে বা উইয়ের ঢিবিতে আচ্ছন্ন হয়। এ জন্য তাঁর নাম হয় বাল্মীকি। এরপর কোনো একসময় নারদ তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে রামচন্দ্রের কাহিনী শুনিয়ে আসেন। বাল্মীকির মুখ থেকেই বেরিয়েছিল প্রথম শ্লোক। সেটা ভিন্ন গল্প। আমরা পরিবর্তন নিয়ে কথা বলি।
আমাদের সবকিছু বদলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজেরা কি নিজেদের বদলাতে পেরেছি? পারলেও কতটা পেরেছি? দিনবদলের পালায় গা ভাসিয়ে দেওয়াটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু গা ভাসিয়ে দিলেই তো আর সবটুকু বদলে দেওয়া হলো না। পরিবর্তনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক_দুটো দিকই আছে। পরিবর্তন করতে চাইলে দায়িত্ব নিতে হবে। নেতিবাচক পরিবর্তনের দায় যেন অন্য কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। পরিবর্তন করতে হবে দায়িত্ব নিয়ে। নিতে হবে দায়টাও। দায় নিতে না জানলে দায়িত্বশীল হওয়া যায় না। এটা বোধ হয় সবারই মনে রাখা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। এত দ্রুত সবকিছু বদলে যাচ্ছে যে অনেক সময় এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতেও পারছি না। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অনেক সময় আমরা হোঁচট খাচ্ছি। পরিবর্তন তো এভাবেই হয়। জগৎটা শুরু থেকেই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনেরও একটা ছন্দ আছে, গতি আছে। সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবাই চলতে পারে না। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে স্বাভাবিক চলার পথ থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু তার পরও এগিয়ে যেতে হয়। এগিয়ে না গেলে পিছিয়ে পড়তে হয়। কাজেই আমরা সবাই সেই পথের যাত্রী। সামনের দিকে যাচ্ছি, পথ চলছি অনেকটাই অন্ধের মতো। কিন্তু তার পরও আমাদের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে ধরনও। আগের দিনের ধ্যান-ধারণা নিয়ে আজকের দিনে পথচলা যায় না। আগের দিনে আমরা ছিলাম গ্রামনির্ভর। আজ আমরা নগরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। নাগরিক জীবনে আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি বদলে গেছে। কিন্তু গ্রামের সঙ্গে শহরের বা নগরের দূরত্ব কমে গেছে এবং যাচ্ছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। যে গ্রামে আগে গরুর গাড়ি চলত, সেখানে আজ বড় বড় বাস চলছে। মোবাইল ফোন চলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। যোগাযোগটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। মোবাইল, ইন্টারনেট, ব্যবসা-বাণিজ্য_সবকিছুতেই শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে গ্রাম। পরিবর্তনের হাওয়া শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও গিয়ে লেগেছে। ফলে পরিবর্তনটা কেবল যে শহরকেন্দ্রিক তা-ই নয়, পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে গ্রামেও। সেখানেও সবকিছু বদলে যাচ্ছে। জীবনযাত্রার পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রার মান। বদলানোর আর শেষ নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে বলে আমরা হা-হুতাশ করি। কিন্তু ভেঙে না গিয়েই বা উপায় কী? আমাদের জীবনাচার যেখানে বদলে গেছে, অনেক বন্ধন টিকে নেই, সেখানে যৌথ পরিবার থাকে কেমন করে? খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, কোনো গ্রামে একটা বাইসাইকেল এলে সেটা দেখার জন্য মানুষের ভিড় জমে যেত। আজ আকাশে রকেট উড়ছে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কল্যাণে বিদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সবকিছুই তো বদলে যাচ্ছে আমাদের। প্রতিদিনের অভ্যাস বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে বন্ধু। সময় গড়াচ্ছে, নতুন বন্ধু এসে জুটছে। বদলে যাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজ পুরোপুরি বদলে না গেলেও বদলে যাচ্ছে সমাজের মানুষ। ভাঙাগড়া চলছে, ওঠানামা চলছে। একটি শ্রেণী উঠছে, একটি শ্রেণী নামছে। সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক_সবদিক দিয়েই পরিবর্তনটা লক্ষণীয়। এই পরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় আমাদের। সমাজে এবং পরিবারে_দুই জায়গায়ই খাপ খাইয়ে নিতে হয়। খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে সমাজ এবং সংসার_দুই জায়গায়ই অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। দেখা দিতে পারে সংকট। সেই সংকট থেকে মুক্তির সহজ পথও আবার জানা নেই আমাদের। ব্যক্তিগত জীবনে সংকট দেখা দিলে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে আমরা আজকাল বোধ হয় একটু বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। অনেক ক্ষেত্রেই এক অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেও আমরা পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাকে চিনি না। কারো সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের মানবিকতা-সামাজিকতা-আন্তরিকতা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। এগুলোই কি বদলে যাওয়ার পরিণাম? আগে যাকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে হতো, তাকেই এখন শত্রু মনে হয়। আমাদের ক্ষোভ-আনন্দ প্রকাশের ধারাও যেন বদলে যাচ্ছে।
আগে সারা দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবা দর্শকপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে ক্রিকেট। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলছে। বাংলাদেশেই বসেছে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর। আগে বিদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলার যে দৃশ্য দেখা যেত, এখন ঢাকার মাঠে সেটাই দেখা যাচ্ছে। দেখা যাবে চট্টগ্রামের মাঠেও। কত পরিবর্তন! বাংলাদেশের নিজেদের খেলা হা-ডু-ডু কোথায় হারিয়ে গেল! ক্রিকেট এখন সবকিছু দখল করে নিয়েছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকাকে সাজানো হয়েছে। রাতের ঢাকা দেখে আজ আর চেনার উপায় নেই পুরনো সেই ঢাকাকে। ক্রিকেট নিয়ে মেতে আছি আমরা। আয়ারল্যান্ড দলকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। রাতভর যেন উৎসবের নগরী হয়ে উঠল ঢাকা। শেষ উইকেটটি পড়ল, অমনি যেন ভেঙে পড়ল রাতের ঢাকা। ছোট-বড় মিছিল বেরিয়ে গেল রাজধানীর পাড়া-মহল্লায়। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে হেরে যাওয়ার পর এসব দর্শকেরই অন্য চেহারা। দর্শকদের রাগ, ক্ষোভ_সব গিয়ে পড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ওপর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলোয়াড়দের বাসে ঢিল ছোড়া হলো। পরদিনই আবার হোটেলের সামনে 'Sorry' লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা। কথায় আছে, 'ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না'। আগে থেকে ভাবলে দর্শকরা নিশ্চয়ই এ কাণ্ডটি ঘটাতে যেত না। আগে থেকে ভেবে কাজ করার একটা মজার গল্প আছে। তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছিল। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জনসন সিদ্ধান্ত নিলেন, যে দলটি ভিয়েতনামে যাচ্ছে, সেই দলকে তিনি নিজে বিদায় জানাবেন। একটি বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। প্রেসিডেন্ট সেখানে গেলেন। কিন্তু যে দলটি ভিয়েতনামে যাচ্ছিল, সেই দলের সবাই আকণ্ঠ মদ্যপান করে এমন অবস্থায় ছিল যে প্রেসিডেন্টের সামনে তাদের হাজির করার মতো অবস্থা ছিল না। কী করা যায়? কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, যে দলটি ভিয়েতনাম থেকে ফিরেছে, সেই দলটিকেই প্রেসিডেন্টের সামনে হাজির করা হবে। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। দলটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট এতই আপ্লুত হয়ে গেলেন যে তিনি ঘোষণা করলেন, এই দল প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত তিনি তাদের সঙ্গে থাকবেন। কর্মকর্তাদের যে মাথায় হাত! শেষে যে দলটি মাত্রই যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, সে দলটিকেই আবার উঠতে হলো বিমানে।
দায়িত্ব না নিলে অবস্থা এমনই হয়। দায়টা গিয়ে পড়ে অন্য কারো ঘাড়ে। বদল করে দিলেই হয় না। বদলের দায়টাও নিজেদের নিতে হবে। সেই দায়টা কে নেবে? দায়িত্ব কার? একটা পৌরাণিক গল্পে যাওয়া যাক। দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার গল্প। বাল্মীকির নাম তো আমরা সবাই জানি। রামায়ণের রচয়িতা তিনি। আদি কবি। রাজা দশরথের সমবয়সী এই মহর্ষীর আশ্রম ছিল তমসা নদীর তীরে। সেখানেই তিনি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। যৌবনে তিনি রত্নাকর নামে এক দুর্দান্ত দস্যু ছিলেন। পথিকদের বধ করে সর্বস্ব লুট করতেন। একদিন ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন নারদ। রত্নাকর তাঁকে থামালেন। নারদকে বধ করে তিনি তাঁর সর্বস্ব লুণ্ঠন করতে চাইলেন। নারদ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কেন এই মহাপাপ করছেন? রত্নাকর উত্তর দিলেন, তিনি তাঁর পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণের জন্য এ কাজ করছেন। নারদ এবার জানতে চাইলেন, রত্নাকরের পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান কি এই পাপের ভাগ গ্রহণ করবেন? রত্নাকর জবাব দিলেন, অবশ্যই করবেন। নারদ বললেন, তাঁরা কেউই এই পাপের ফল ভোগ করবেন না। রত্নাকর রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বসলেন নারদকে। নারদও রত্নাকরের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি রত্নাকরকে বললেন তাঁর বাড়িতে যেতে। সেখানে গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, তাঁরা এই পাপের ভাগ নিতে রাজি আছেন কি না। নারদ এটাও নিশ্চিত করলেন, রত্নাকর না ফেরা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করবেন। দস্যু রত্নাকর বাড়িতে গিয়ে সবাইকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কেউই পাপের ভাগ নিতে সম্মত হলেন না। হতাশ রত্নাকর ফিরে এলেন। নারদকে জানালেন, বাড়িতে কেউই তাঁর পাপের ভাগ নিতে রাজি নন। তিনি এই মহাপাপের প্রতিকার কী, জানতে চাইলেন। রাম তখন তাঁকে রামমন্ত্র জপ করতে বললেন। রত্নাকর জানালেন, তিনি তো কেবল 'মরা' শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেন; 'রাম' শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেন না। বাল্মীকি একাদিক্রমে ৬০ হাজার বছর তপস্যা করেন। এ সময় তাঁর সারা শরীর বল্মীকে বা উইয়ের ঢিবিতে আচ্ছন্ন হয়। এ জন্য তাঁর নাম হয় বাল্মীকি। এরপর কোনো একসময় নারদ তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে রামচন্দ্রের কাহিনী শুনিয়ে আসেন। বাল্মীকির মুখ থেকেই বেরিয়েছিল প্রথম শ্লোক। সেটা ভিন্ন গল্প। আমরা পরিবর্তন নিয়ে কথা বলি।
আমাদের সবকিছু বদলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজেরা কি নিজেদের বদলাতে পেরেছি? পারলেও কতটা পেরেছি? দিনবদলের পালায় গা ভাসিয়ে দেওয়াটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু গা ভাসিয়ে দিলেই তো আর সবটুকু বদলে দেওয়া হলো না। পরিবর্তনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক_দুটো দিকই আছে। পরিবর্তন করতে চাইলে দায়িত্ব নিতে হবে। নেতিবাচক পরিবর্তনের দায় যেন অন্য কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। পরিবর্তন করতে হবে দায়িত্ব নিয়ে। নিতে হবে দায়টাও। দায় নিতে না জানলে দায়িত্বশীল হওয়া যায় না। এটা বোধ হয় সবারই মনে রাখা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments