জাবি উপাচার্য আনোয়ার হোসেন-এ নিয়োগ দুঃখজনক : শিক্ষক সমিতি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। গতকাল সন্ধ্যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।


উল্লেখ্য, ড. শরীফ এনামুল কবীর মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ মাস আগেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করলেন।
শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জানান, অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর গতকাল বিকেলে পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই নিয়োগের আদেশ জারির কাজ চলছে। উল্লেখ্য, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনাই হবে প্রথম চ্যালেঞ্জ। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলে তিনি জানান। অন্যদিকে পদত্যাগকারী উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর কোনো মন্তব্য করতে সম্মত হননি।
এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগের খবরে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, আন্দোলনটি একপর্যায়ে উপাচার্য পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ভীষণভাবে বিঘি্নত হচ্ছিল। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হওয়ার পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছিল শিক্ষার পরিবেশ। এ অবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গভবনে যান। পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি বেরিয়ে আসেন। নিয়োগে অনিয়ম এবং এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হওয়ার জন্য শরীফ এনামুল কবিরকে দায়ী করে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে এবং এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়। এর আগে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে কার্যত অচল থাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৩ মে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপাচার্য শরীফ এনামুল কবীরের সঙ্গেও কথা বলেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাবির উপাচার্য পদে নিয়োগ পান শরীফ এনামুল কবির। উপাচার্য হিসেবে প্রায় তিন বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, ছাত্রলীগের 'একটি অঞ্চলভিত্তিক' অংশকে মদদ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণ, ক্যাম্পাসে সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে গাছ কাটা নিয়েও সমালোচনায় পড়েন তিনি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে গত ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগের একটি অংশের কর্মী ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ নিহত হলে। অভিযোগ রয়েছে, এ ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতারা তাঁরই মদদপুষ্ট।
জুবায়ের খুন হওয়ার পর থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। ওই সময় হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাত শিক্ষার্থীকে স্থায়ী এবং ছয় শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণাসহ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চার দফা মেনে নিলে গত ৩০ জানুয়ারি আন্দোলন স্থগিত করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এর পর ঘটনার ইন্ধনদাতাদের নাম প্রকাশ, বিচার বিভাগীয় তদন্ত, প্রক্টরিয়াল বডির অপসারণ, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। তাঁদের এই আন্দোলন ক্রমেই উপাচার্য পদত্যাগের আন্দোলনে পরিণত করে। এ সময় শিক্ষক সমাজের দাবিকে অযৌক্তিক দাবি করে পাল্টা আন্দোলনে নামেন উপাচার্যের পক্ষের শিক্ষকরা।
ধাপে ধাপে আন্দোলন চালানোর পর আন্দোলনরত শিক্ষকদের ফোরাম শিক্ষক সমাজ গত ১৮ এপ্রিল উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে কর্মসূচি শুরু করে। শিক্ষকদের আন্দোলনের একপর্যায়ে সাংস্কৃতিক জোট নেতাদের ওপর উপাচার্যপন্থী ছাত্রলীগ হামলা চালালে শিক্ষার্থীরাও শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে। পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনশনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নেন।
নতুন উপাচার্যের নিয়োগ মেনে নেয়নি শিক্ষক সমিতি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এ মামুন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। বাইরে থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এটিকে কিভাবে নেবে শিক্ষক সমিতির পরবর্তী সভায় আলোচনার মাধ্যমে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক থাকার পরও বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া দুঃখজনক।

No comments

Powered by Blogger.