রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ, কালোটাকা সাদা নয়

রাজনৈতিক সংঘাত ও হরতালের মধ্যেই বাজেটের আগে অনুষ্ঠিত হলো পরামর্শক কমিটির সভা। সভায় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে পদক্ষেপ নিতে অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ করে বলেছেন, রাজনীতিতে সংঘাত থাকলে কোনো বাজেট প্রণোদনাতেই কাজ হবে না।


সভায় ঢালাওভাবে বা মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা করেছে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। জ্বালানি-বিদ্যুতের সংকট ও সড়ক পরিবহনের দুরবস্থা থেকেও উত্তরণ চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা কথা বলেছেন শেয়ারবাজার নিয়েও। বলেছেন, কিছু রাঘববোয়াল পুঁজিবাজার ধ্বংস করেছে।
আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয় এই সভা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদের সভাপতিত্বে এতে দেশের শিল্প ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা ও প্রতিনিধিরা তাঁদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। তাঁদের বক্তব্য শোনার পর অর্থমন্ত্রী বক্তব্য দেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, সম্পদের সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রচেষ্টা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে। তাই ৭ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কোনো উচ্চাভিলাষী প্রক্ষেপণ নয়। তিনি আরও বলেন, বাজেটে সবার জন্য সবকিছু সমানভাবে দেওয়া (উইন-উইন) সম্ভব হবে না।
কালোটাকা থাকছে: এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘পত্রিকা মারফত জেনেছি, ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার। এটা করা হলে বৈধ করদাতারা কর দিতে নিরুৎসাহিত হবেন। ভবিষ্যতের জন্য তা ভালো হবে না। অপ্রদর্শিত আয়কে যদি বৈধ করার সুযোগ দিতেই হয়, তাহলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে এই সুযোগ দেওয়া উচিত।’
তবে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আকরাম হোসেন বলেন, কালোটাকা যদি অর্থনৈতিক খাতে ব্যবহার করা না যায়, তবে তা বিদেশে চলে যাবে। কালোটাকা তৈরি হলে তা যেন অর্থনৈতিক খাতে ব্যবহার করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘কালোটাকার পক্ষে-বিপক্ষে বহু মত রয়েছে। তাই কালোটাকা নিয়ে আমি কিছু বলব না। তবে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগে যেসব সুবিধা রয়েছে, তাতে হাত দেওয়া হবে না।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মাত্র এক বছর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাই খুব যে আমরা কালোটাকার ওপর নির্ভরশীল, তা ঠিক নয়। দেশে জরিমানা আরোপ করে কালোটাকা সাদা করার স্থায়ী ব্যবস্থাও আছে। আমরা সেটা কার্যকর করার চিন্তা করছি।’
বিদ্যুৎ-সংকট: এ কে আজাদ বলেন, কুইক রেন্টাল করতে গিয়ে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে। এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি কয়লাখনি আছে। সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করে কীভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতের অপচয় ও অনিয়ম কমেনি।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিকই ছিল, কিন্তু সবগুলো প্রকল্প ঠিকমতো হয়নি। সময়মতো রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো আসেনি। তা ছাড়া এটা সাময়িক সমাধান, খরচও বেশি। বড় প্রকল্পগুলোও আটকে গেছে, অর্থায়নের জন্য বিলম্ব হচ্ছে।’
মুহিত আরও বলেন, বাজেটে আগামী পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ-জ্বালানির বিভিন্ন উৎস নিয়ে একটা প্রক্ষেপণ দেওয়া হবে। তবে কয়লা প্রধান উৎস হবে না। কেননা, কয়লা উত্তোলন থেকে ব্যবহার পর্যায়ে আনতে সময় লাগবে। দেশে জমির স্বল্পতা রয়েছে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রচুর জমি লাগে।
সংঘাতময় রাজনীতি: এ কে আজাদ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এখন পর্যটনশিল্প বিকশিত হচ্ছে না। যেসব পর্যটক সাত দিনের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন, হরতালের কারণে তাঁরা দুই দিনেই বাংলাদেশ ছাড়ছেন। হরতালসহ সংঘাতময় রাজনৈতিক কর্মসূচি দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি করে। অর্থমন্ত্রীকে ‘সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাকে দেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরসনে প্রধানমন্ত্রীসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি সম্মানজনক সমাধানের পথ খুঁজে বের করার অনুরোধ করছি।’
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘রাজনীতিতে অস্থিরতা থাকলে কোনোভাবেই আমরা অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে পারব না।’
পরিবহনব্যবস্থা: পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সেভাবে দৃশ্যমান নয় উল্লেখ করে এ কে আজাদ বলেন, অপরিকল্পিত পরিবহনব্যবস্থা এবং যানজটে প্রচুর শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করা উচিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন রাস্তা প্রকল্প এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এফবিসিসিআইয়য়ের সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, রেল খাত অবহেলিত। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এই খাতকে উন্নত করতে হবে।
রেফ্রিজারেটর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ও চলচ্চিত্রশিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ২ শতাংশ খোয়া যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। তিনি দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কের উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দ রাখার দাবি জানান।
রেল ও নৌপথ অনেক দিন ধরে অবহেলিত স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটে এই দুটি খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং রেল খাতে বরাদ্দ বাড়বে। মুহিত আরও বলেন, বিদ্যমান ১০ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কগুলোকে সংরক্ষণ, মেরামত ও উন্নতকরণের দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে। নতুন করে ‘শর্টকাট’ রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। যুক্তি হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেন, একটু সময় নিয়ে ভালো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা গেলে দুর্ঘটনা কম হবে।
সুদের হার: এ কে আজাদ অভিযোগ করে বলেন, ব্যাংকঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ সাড়ে ১৫ শতাংশ রাখার সিদ্ধান্ত হলেও বিভিন্ন ব্যাংকঋণের বিপরীতে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে গেছে। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ায় হিমাগার টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। একদিকে সুদের হার বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষ আলু খাচ্ছে না। তাই হিমাগারশিল্পে অস্থিরতা চলছে।
তবে সুদের হার নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সুদের হার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ খুব কম। অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সম্পৃক্ত আছেন উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, তাঁরা যখন ওখানে (ব্যাংকে) বসে উচ্চহারে সুদ ঠিক করেন, তখন আর এটা মনে রাখেন না।
শেয়ারবাজার: পুঁজিবাজার সম্পর্কে এ কে আজাদ বলেন, ‘কিছু রাঘববোয়াল পুঁজিবাজার ধ্বংস করেছে। অনেকেই বাবার পেনশনের টাকা, জমি বন্ধক রেখে, বোনের কাছ থেকে টাকা ধার করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। আর কিছু লোক এটিকে ধ্বংস করেছেন। তাঁরা নিজেদের হিসাবকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক দেখিয়েছেন। তাঁরা যেসব শেয়ার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছেন, এখন সেসব শেয়ারের দাম ৫০ টাকা।’ এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি তাঁদের ওই শেয়ার আবার ৩০০ টাকা দিয়ে কেনার জন্য আইন করার প্রস্তাব করেন।
পরে অর্থমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শেয়ারবাজারে যে সুবিধা রয়েছে, তা বহাল থাকবে। এই বাজারকে এখন “ডিস্টার্ব” করব না। কেননা, সামনে শেয়ারবাজার নিয়ে অনেক কাজ আছে, ডিমিউচুয়ালইজেশন (ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসা পৃথক) করতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.