মধুর মানুষ

সুন্দরবনে শুরু হয়েছে মধু সংগ্রহের মৌসুম। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে মৌয়ালেরা যেভাবে মধু সংগ্রহ করেন, সেই গল্প শুনিয়েছেন খসরু চৌধুরী বৈশাখের তীব্র গরমে প্রাণ যায় যায়। শুধু কি গরম? ঘন বুনটের জঙ্গল, মাটিতে বর্শার ফলার মতো ছড়ানো শ্বাসমূল, কাঁটায় ভরা হেঁতালের ঝাড়, হাঁটু-অবধি জোয়ারের জল—সর্বোপরি ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করে বাঘের দাঁতের ভীতি; এই নিয়ে হেঁটে চলেন তাঁরা। তাঁরা মৌয়াল।


মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় পুরে পথ চলে মৌয়ালরা আমাদের কাছে পৌঁছে দেন মধু। কেমন সেই মধু সংগ্রহের জীবন?
মাঝবসন্তে সুন্দরবনে ফুল ফোটা শুরু হয়। এই ফুলের মধুর টানে সুদূর হিমালয়ের পর্বতকন্দর থেকে উড়ে আসে কোটি কোটি মৌমাছি। এদের স্থানীয় নাম সূর্যমুখী বা আগুনে মাছি, ইংরেজি নাম ‘রক-বি’। আকারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মৌমাছি, মেজাজে একেবারে চণ্ডাল।
সুন্দরবনের, স্থানীয় ভাষায় ‘বাঁদা’র ফুল পূর্ণ প্রস্ফুটিত হলে এই ‘আগুনে মাছি’ (apis dorsata) বনে এসে একটু থিতু হয়। এই সময়ে মানে এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে দুই সপ্তাহের জন্য একেকটি দলকে মৌ-কাটার পাস দেয় বন বিভাগ। পাস নিতে হয় রাজস্বের বিনিময়ে। মেয়াদ শেষ হলে মৌয়ালেরা আবার নতুন করে পাস নিয়ে যান। উত্তীর্ণ হলে মেয়াদগরি হয়—ফাইন দিতে হয়।
আমাদের সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের মধ্যে নলিয়ান রেঞ্জে সামান্য মধু পাওয়া গেলেও অধিকাংশ মহুল ফুলের গাছ জন্মে বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে। সে জন্য সুদূর কয়রা থেকে শুরু করে কৈখালী এলাকার মৌয়ালেরা পাস নিতে বুড়িগোয়ালিনী আসেন। অবশ্য কোবাদাক, কৈখালী অফিস থেকেও পাস দেওয়া হয়। তবে বুড়িগোয়ালিনীর আশপাশে, ডুমুরিয়া, গাবুরা এলাকাতেই বেশির ভাগ মৌয়াল বাস করেন। ফলে মৌ-কাটা শুরুর অনুষ্ঠানটি হয় বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট ঘাট থেকে।
মৌয়ালেরা অধিকাংশই প্রান্তিক চাষি, নয়তো দিনমজুর। মৌয়াল দলের সর্দার হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ মৌয়ালকে নির্বাচিত করা হয়। তাঁকে ডাকা হয় ‘সাজুনি’ নামে। সাজুনির আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী একটি বা দুটি পালোয়ার নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। নৌকাপ্রতি সাত থেকে নয়জন মৌয়াল থাকেন। দলের সদস্যরা দু-একজন ছাড়া সবাই আত্মীয় সম্পর্কের। বাঘ, সাপ, আমাশয়, ডায়রিয়া, ঝড়-বাতাসের অনিশ্চিত বনভূমিতে আত্মীয়তার বন্ধন অনেক আশ্বাস বয়ে আনে।
বহরের নেতৃত্ব সাজুনির হলেও টাকার উৎস বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মহাজনেরা। সাজুনি কোনো এক মহাজনের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ দিনের খাবারদাবার, ধামা, মটকি (মাটির বড় পাত্র), রাজস্বের টাকার জন্য ধার নেন। মহাজনের শর্ত থাকে—মধু, মোম যতটুকু পাওয়া যাবে সেটা মহাজন-নির্ধারিত দরে তাঁর কাছে বিক্রি করতে হবে। বিক্রির টাকা থেকে মহাজন সুদসহ আসল কেটে নেবেন।
মহালের দিনে মৌয়ালেরা চাল, ডাল, রান্নার মসলা, কাঁচা তরকারি নৌকায় তুলে নেন। দুটো বড় মটকি নৌকার পেছন দিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে শক্ত করে বসিয়ে নেন; নৌকার সামনে থাকে আরেকটি মটকি। পেছনের দুটো মটকিতে পান ও রান্নার জল রাখা হয়, সামনেরটি খালি থাকে মধু রাখার জন্য। রওনা হওয়ার সময় তাঁদের নৌকায় ছই থাকে না। নৌকায় আত্মীয়স্বজনসহ মিলাদ পড়ানো হয়। সাজুনি রাজস্বের পাস ও নোয়াপাড়ার পীর সাহেবের পড়া লাল রুমাল একটা বাঁশের চোঙায় যত্ন করে রাখেন।
গোছগাছ শেষ হলে বনের ঘাটে একজন বোটম্যান রাইফেলের গুলি ফুটিয়ে মহালের শুরু ঘোষণা করেন। মৌয়ালেরা দ্রুত বাইচ দিয়ে দক্ষিণমুখী হন। একবার দক্ষিণমুখী হলে কোনো কারণেই নৌকা ঘোরানোর নিয়ম নেই।
লোকালয়ের আশপাশের জঙ্গলের মৌচাক চোর-মৌয়ালেরা আগেই কেটে নেয়। মাইল দশেক জঙ্গলের ভেতরে না গেলে অক্ষত মৌচাক পাওয়া যায় না। প্রথম দিন জঙ্গলে উঠে মৌয়ালেরা চাক ততটা খোঁজেন না, যতটা খোঁজেন গোলপাতা। এই এলাকায় গোলপাতা খুঁজে পেতে কষ্ট করতে হয়। গোলপাতা পেলে গরানের বল্লি (ছোট গাছ কেটে বানানো লাঠি) নুইয়ে নৌকায় ছাউনি দেওয়া হয়।
মৌয়ালদের নৌকায় দুটি দাঁড় ও একটি হাল থাকে। একজনের কাজ থাকে হাল বাওয়া, রান্না করা, মৌয়ালেরা মালে (জঙ্গলে) উঠলে হাল বেয়ে নৌকা দলের কাছাকাছি রাখা এবং মোষের শিঙা ফুঁকিয়ে নিজের অবস্থান নৌকা থেকে জানান দেওয়া। তাঁকে বলা হয় দারোগা।
নির্দিষ্ট জঙ্গলে পৌঁছে মৌয়ালেরা নৌকার খোলা জায়গায় বসে বাতাসের গতি, মাছির ওড়াউড়ি লক্ষ করে পছন্দনীয় জায়গায় সারি বেঁধে নেমে পড়েন। জঙ্গলে ওঠার সময় সবার হাতে থাকে দা আর গরানের লাঠি। এ ছাড়া ধামুড়ে ধামা নিয়ে, কাটুনি কাটারি হাতে জঙ্গলে ওঠেন। জঙ্গলে উঠে একেকজন ২০-৩০ ফুট দূর থেকে গাছের ফুল লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকে। এ সময় তাঁরা মৌমাছির গতিবিধি লক্ষ করে মৌচাকের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেন। একে বলে ছাঁটা দেওয়া।
ফুলে মৌমাছি বসার পর যদি দেখা যায় মাছি আট-দশ ফুট ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে, তাহলে বোঝা যায় চাক কাছেই আছে। আর যদি মাছি অনেকটা ওপর দিয়ে উড়ে যায়, তবে বুঝতে হবে চাক অনেক দূরে। এবার শুরু হয় চাক খুঁজে বের করা।
ছাঁটার ডানে থাকেন সাজুনি, সর্ববাঁয়ে দ্বিতীয় অভিজ্ঞ মৌয়াল। মৌয়ালেরা প্রত্যেকেই মাঝেমধ্যে আওয়াজ দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান। কখনো হইহই করে ওঠেন, ‘সামনে বোরা (শূকর)’ কিংবা ‘সামনে কিপটে সাপ (কেউটে) পড়িছে।’ আবার কখনো আওয়াজ ওঠে, ‘ছাঁটা ফেরাও’। কী বৃত্তান্ত! বাঘের তাজা পায়ের ছাপ (খোচ) পাওয়া গেছে।
মৌয়ালদের কেউ চাক দেখতে পেলে চিৎকার করে ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ বলে আওয়াজ তোলেন। আশপাশ থেকে ছাঁটা দেওয়া অন্য মৌয়ালেরা এসে জড়ো হন। এ সময় একটা লাঠিতে হুদো বা হেঁতালের কাঁচা-পাকা পাতা পেঁচিয়ে কারু তৈরি করেন মৌয়ালেরা। এটায় সামান্য কেরোসিন ঢেলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে ধরিয়ে দেন। এতে দম বন্ধ করা ধোঁয়া তৈরি হয়।
এই কারু দিয়ে মৌয়ালেরা চাকের তলায় ধোঁয়া দেন। ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ মৌমাছি চাক ছাড়ে। তাদের লাখ লাখ পাখার গুঞ্জন সমুদ্র-গর্জনের মতো শোনা যায়। বাকি মৌয়ালেরা এ সময় ঝোপের আড়ালে লুকান। মাছি চাক ছাড়লে কাটুনি কাটারি হাতে গাছে উঠে চাক কাটা শুরু করেন। তলায় ধামুড়ে ধামা উঁচিয়ে কাটা চাক গ্রহণ করা হয়। চাকের মধুর অংশটাই শুধু কাটা হয়। তবে অনেক মৌয়াল মোমের লোভে পুরো চাকই কেটে ফেলেন। চাক কাটার পর মধুর পরিমাণ বেশি হলে নৌকা ডেকে মধু নৌকায় রাখা হয়। মৌমাছি কিন্তু পিছু ছাড়ে না। কারু নিবে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৌয়ালদের ওপর। সেই আক্রমণ এড়িয়ে শুরু হয় আবার পথচলা।
মধু কম পেলে আবার নতুন চাকের সন্ধান করা হয়। চাক খোঁজার সময় মাটিতে গুটুলি খোঁজা হয়। গুটুলি হলো মৌমাছিদের মল। সাধারণত চাকের কাছেই গুটুলি পাওয়া যায়। চাক একেবারে পাওয়া না গেলে মৌয়ালেরা পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে গাছে ছিটিয়ে দেন। এতে অনেক সময় মাছি আকৃষ্ট হয়ে বসে, ফিরে যাওয়ার সময় চাকের অবস্থান দেখিয়ে দেয়।
চাক নৌকায় তোলার পর ধামা থেকে চিপে মোম পৃথক করে মধু মটকিতে রাখা হয়। মহালের প্রথম ১৫ দিন যে মধু পাওয়া যায়, তা মূলত খোলসের সঙ্গে হেঁতাল ফুলের মধু। একে পদ্মমধু বা ফুলপট্টি মধু বলা হয়। এ মধু ঘোলাটে সাদা এবং শ্রেষ্ঠ মধু হিসেবে বিবেচিত। মৌমাছি আসলে সরাসরি মধু সংগ্রহ করে না। ফুলের মিষ্টরস বা নেকটর সংগ্রহ করে। মৌমাছির পা, ডানায় ফুলরেণু জড়িয়ে যায়। এই নেকটর, ফুলরেণু ও মৌমাছি দেহের নানা রাসায়নিক পদার্থ মিলে মধু হয়।
মহালের পরবর্তী প্রায় দেড় মাস পাওয়া যায় গরান, গর্জন, পশুর ফুলের মিশ্রিত নেকটরের মধু। এই মধুও উত্কৃষ্ট, নাম বালিহার মধু বা লাল মধু। রং লালচে। শেষের দিকে পাওয়া যায় কেওড়া ও গেওয়ার মধু। এই মধু পাতলা, খেতেও কিছুটা তিতকুটে।
মিঠে হোক আর তিতে হোক, জিনিসটা মধু তো! কিন্তু বাঘ-সাপের ভয় অগ্রাহ্য করে যাঁরা এই মধু নিয়ে আসেন, তাঁদের জীবনটা তো মধুর না।

No comments

Powered by Blogger.