ঐক্যই এগিয়ে চলার পাথেয় by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব এক জটিল সময় পার করছে। মুসলিম বিশ্বের নেতাদের পরস্পরে অনৈক্য আর লেজুড়বৃত্তি এ ক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী। এ ছাড়া ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অনীহা ও ইসলামকে পাশ কাটিয়ে চলার মানসিকতাও অন্যতম কারণ। কিন্তু কেন এই অনৈক্য_ তার গভীরে কেউ যেতে চান না।


মুসলমানরা বিভিন্নভাবে আগ্রাসনের শিকার। আগ্রাসনের এই বেড়াজাল থেকে মুসলিম বিশ্ব বের হতে পারছে না। এর সবচেয়ে বড় কারণ মুসলমানরা বিভিন্নভাবে ও কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তাদের মধ্যে ঐক্য নেই। মুসলমানদের ঐক্য না থাকার সুযোগটা নিচ্ছে ইসলামবিরোধীরা। মুসলমানদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থাসহ সব ক্ষেত্রে এক এক করে তারা মুসলমানদের পরাজিত করার সুযোগ পাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আলেমদের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা থাকা দরকার। কারণ, জনগণের ওপর আলেমদের বিশেষ প্র্রভাব রয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, মুসলমানদের ঐক্যের আগে দরকার আলেমদের ঐক্য। এ ক্ষেত্রে বিরুদ্ধবাদীরা সুকৌশলে আলেমদেরই অনৈক্যের জালে আটকে দিয়েছে। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
অনেকেই মনে করেন, মুসলমানদের মাঝে ভেদাভেদের বেড়াজাল সাম্রাজ্যবাদীদের অপকৌশল। তারা ছলে-বলে-কৌশলে মুসলিম বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চায়। তাই তারা বিভেদ সৃষ্টি করে স্বার্থ হাসিলের ধান্ধায় লিপ্ত। এ কথাগুলো সাধারণ মুসলমানদের বুঝিয়ে বললে তাদের পরস্পরের বিচ্ছিন্নতা, বিক্ষিপ্ততা ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে ইনশাআল্লাহ।
আসলে মুসলমানদের ইসলামের মূল বাণী ও শিক্ষার দিকে ফিরে আসতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে দল-উপদল ও শ্রেণী-গোত্রের বিভাজন ভুলে যেতে হবে। মূলত বিভিন্ন মত আর স্বার্থান্বেষী চিন্তা মুসলমানদের বিভক্ত করে রেখেছে। মুসলমানদের মনে রাখতে হবে, এগুলো মুসলমানদের মূল পরিচয় নয়। মুসলমানদের পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন, 'তোমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে দাখিল হও।' দীন ইসলামকে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের জন্য একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাই অনৈক্য ভুলে ইসলামকে আঁকড়ে ধরতে হবে।
সবকিছুর ঊধর্ে্ব মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আলেম সমাজের মধ্যে চিন্তাগত পরিশুদ্ধি প্রয়োজন। চিন্তাগত পরিশুদ্ধি ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীদের মোড়লিপনা শুরু হয়েছে; এর একটা প্রভাবও আলেমদের মধ্যে পড়েছে। তাই তো দেখা যায়, ইসলামকে কেন্দ্র করে যারা রাজনীতি করেন, তারা ইসলামের মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে ইসলামের শাখা-প্রশাখা নিয়ে বেশি ভাবেন। আলেমরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে ইসলামকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন।
কেউ সুফিজমের দিকে, কেউ মাদ্রাসার দিকে, কেউবা আন্দোলনের পথে, একদল লেখালেখির দিকে, আবার কেউবা তাবলিগের দিকে ঝুঁকেছেন। এভাবে তারা ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে করতে এক পর্যায়ে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছেন এবং অন্যের কাজকে ধীরে ধীরে অস্বীকার করতে শুরু করেছেন। প্রকৃত মুসলমানদের মনে রাখতে হবে, এসব কাজ পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নয়। এসব ইসলামের একটি অংশমাত্র। ইসলাম নিয়ে এই খণ্ডিত চিন্তা থেকে আলেমদের বের হয়ে এসে পরস্পরের কাজকে স্বীকৃতি দিতে হবে। পরস্পরকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও চেতনাকে গ্রহণ করতে হবে।
আলেম সমাজের ওপর পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এখনও আলেমরাই ইসলামের কথা বলেন ও প্রচার করেন। কিন্তু পরস্পরের সমন্বয়হীনতার কারণে তা ফলপ্রসূ হয় না। বিশ্বে ইসলামের জন্য কী পরিমাণ কাজ হচ্ছে, কারা কোথায় কীভাবে কাজ করছেন, সেসব বিষয়ে আলেমদের পরস্পরে উদারভাবে জানার চেষ্টা ও পদক্ষেপ নেওয়া হলে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হবে। আলেমদের পরস্পরের অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব ইসলামের জন্য মঙ্গলজনক নয়। মুসলমানরা তো পরস্পরে ভাই ভাই। আর আলেমরা তাদের শ্রদ্ধাভাজন নেতা। এটা মাথায় রাখলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা দ্রুত সম্ভব।
বিশ্ব মুসলিমকে একত্র করার জন্য এর বাইরে আলাদা কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। মুসলমানরা যদি ঐক্যের আওয়াজ নিজেদের মধ্যে জাগ্রত করতে পারে, তবে সেটিই হবে মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।
সত্যি কথা বলতে কি, মুসলমানদের মৌলিক বিশ্বাস এক ও অভিন্ন। সবাই এক আল্লাহ, এক রাসূল, এক কেবলা ও এক কিতাবে বিশ্বাসী। সবাই ইমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ মৌলিক ইবাদতের বিষয়েও এক বিশ্বাস পোষণ করেন। সুতরাং অনৈক্য যে ঠুনকো বিষয় নিয়ে তা বাহুল্য। এমতাবস্থায় শত্রুদের ষড়যন্ত্র যদি আলেমরা ছিন্ন করতে পারেন, তাহলে মুসলমানদের মধ্যে হৃদ্যতা ও ঐক্য খুব সহজেই তৈরি হতে বাধ্য।
আরেকটি কথা, আলেমদের অনেককেই দেখা যায় যে, তারা ভিন্ন মতের ব্যক্তি এমনকি আলেমকেও নাস্তিক, বামপন্থি, দরবারি, ধর্মচ্যুত ইত্যাদি ফতোয়া দিয়ে থাকেন। এতে কিন্তু সামগ্রিকভাবে মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবশ্য ফতোয়াসর্বস্ব ওই শ্রেণীর গলাবাজ আলেমদের প্রবীণ ও পরহেজগার আলেমরা পছন্দও করেন না। তারা মনে করেন, তারা অন্যের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে।
গুটি কয়েক আলেমের এই মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা মোটেও ঠিক নয়। আলেমদের এই মনোভাব থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে মুসলমানদের সত্যিকারের মুক্তি আসবে না। এখন প্রশ্ন হলো, আলেমরা এই বিষয়টি অনুধাবন করেন কি-না?
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.