স্মরণ-বিপ্লবী গল্পকার সোমেন চন্দ by মাহমুদুল বাসার

৮ মার্চ, বিপ্লবী গল্পকার সোমেন চন্দের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৪২ সালের এই দিনে তিনি শহীদ হন। জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদ সমর্থকদের প্ররোচিত নৃশংস গুণ্ডা হামলায় ঢাকায় প্রকাশ্য রাজপথে দানবীয় উল্লাসে সোমেন চন্দকে হত্যা করা হয়। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটটাও ছিল খুব জটিল।


যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তার পরও তারা এক হয়ে মিত্রবাহিনী গঠন করেছিল শুধু হিটলার ও তার ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার জন্য। হিটলার ১৯৪১ সালের জুন মাসে পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে আগ্রাসন চালায়। এর বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের শান্তিকামী ও ফ্যাসিবাদবিরোধী কবি, সাহিত্যিক এবং শিল্পীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। আমাদের বাংলাদেশে তখন 'প্রগতি লেখক সংঘ' তো ছিলই, তার সঙ্গে 'সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি' নামেও একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪২ সালের এই তারিখে প্রগতি লেখক সংঘ ও সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি ঢাকার সূত্রাপুরের সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে এক ফ্যাসিবাদবিরোধী কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করে। এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে যোগদান করেন জ্যোতি বসু, বঙ্কিম মুখার্জি ও স্নেহাংশু আচার্য। এ সম্মেলনটি বানচাল করতে জাতীয়তাবাদী সমর্থকরা প্রচেষ্টা চালায়। সেদিন দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা রেলওয়ে কলোনি থেকে শ্রমিকদের একটা বিরাট মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সোমেন চন্দ স্লোগান দিতে দিতে সম্মেলনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। মিছিলটি লক্ষ্মীবাজার-হৃষিকেশ দাশ রোডের মোড়ে পেঁৗছায় বেলা ৩টার দিকে। তখন সঙ্গে সঙ্গে গুণ্ডারা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপর্যুপরি আঘাত করে তারা সোমেনকে মাটিতে ফেলে দেয়। চোখ উপড়ে ফেলে। জিহ্বা টেনে বের করে কেটে ফেলে। পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে পড়ে। তাঁর আহত দেহের ওপর উগ্র পিশাচরা নৃত্য শুরু করে। সোমেন মুমূর্ষু দশায়ও পতাকা হাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন। পতাকা হাতেই বিপ্লবী বীর ধীরে ধীরে মৃত্যুর নীরবতায় ঢলে পড়েন।
সোমেন চন্দ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালের ২৪ মে নরসিংদী জেলার মনোহরদী গ্রামে। তাঁর পুরো নাম ছিল সোমেন্দ্র কুমার চন্দ। তাঁর বাবার নাম নরেন্দ্র কুমার চন্দ্র, মায়ের নাম হিরণ বালা। শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামাঞ্চল ও শহরে। ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের সনি্নকটে মেডিক্যাল কলেজে। শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে এগোতে দেয়নি পড়ার দিকে। কৈশোরের খোলস ছেড়ে সদ্য যৌবনে পা রাখা সোমেনের জীবনে শুরু হয় রাজনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য। সোমেন চন্দ কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী জীবন শুরু করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তিনি ছিলেন তরুণ সদস্য। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে উদ্যোগী হন ঢাকার রেলওয়ে শ্রমিকদের নিয়ে। বিপ্লবী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। এর মধ্যে একটি উপন্যাসও লিখে ফেলেছিলেন। নাম 'বন্যা'। 'ঢাকায় সোমেন তাঁর কয়েক বন্ধুকে নিয়ে প্রগতি লেখক সংঘ জেলা শাখার উদ্বোধন করেছিলেন ১৯৩৯ সালেই। রণেশ দাশগুপ্তকে সংগঠনের সহসম্পাদক ঘোষণা করা হয়।'
সোমেন চন্দের দুটি গল্পগ্রন্থের নাম 'সংকেত ও অন্যান্য গল্প' এবং 'বনস্পতি ও অন্যান্য গল্প' প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৪৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর। তাঁর গল্পগ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন গোপাল হালদার, লীলা রায় ও অধ্যাপক হীরেণ মুখোপাধ্যায় সোমেনের খুবই বিখ্যাত 'ইঁদুর' ও 'বনস্পতি' গল্প ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করন। সোমেন চন্দ আমাদের বাংলা ভাষার অসামান্য কথাশিল্পী। স্বল্পসংখ্যক গল্পের স্রষ্টা হয়েও শিল্পোত্তীর্ণ কথাসাহিত্য রচনায় বলিষ্ঠ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডে সারা ভারতের প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের বুকে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু 'প্রতিবাদ' নামে দীর্ঘতম একটি কবিতা লেখেন। কবিতা লেখেন সমর সেন। তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি গভীর প্রণতি জানাই।
মাহমুদুল বাসার

No comments

Powered by Blogger.