চারদিক-সোনারগাঁয়ের বউমেলা by মনিরুজ্জামান মনির

১৫ এপ্রিল সকাল নয়টা। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বিশাল বটগাছের নিচে সারিবদ্ধ মানুষ। ফলের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নববধূরা। রয়েছেন দু-তিন সন্তানের জননীরাও। সবাই সুবেশা। সবার দৃষ্টি পুরোনো সেই বটগাছের দিকে। এই বটবৃক্ষের নিচে এসে তারা মানত করবেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেন ঝগড়াঝাটি বা মনোমালিন্য না হয়,


থাকলেও তা যেন মিটে যায়। পরিবারের সবার মধ্যে যেন সদ্ভাব ফিরে আসে। সুখের হয় সংসার। আসে সচ্ছলতা।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের শতাব্দী-প্রাচীন এই মেলা পরিচিত বউমেলা হিসেবে। এ মেলাকে অনেকে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মেলাও বলে থাকেন। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বটবৃক্ষটিকে মনে করেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী। তিনি সবার মনোবাসনা পূর্ণ করেন। মূলত নারীদের নিয়েই মেলা, কিন্তু আসে সবাই। ধর্ম এখানে কোনো বাধা নয়। হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের সব বয়সী মানুষই এ মেলায় এসে আনন্দে যোগ দেয়।
প্রতিবছর পঞ্জিকা অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ এ মেলা বসে। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে তিন দিন চলে এ মেলা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ এলাকায় হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের খাদ্য ও সংস্কৃতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। তার পরও এ মেলা হারায়নি তার ঐতিহ্য। এখনো একই রকম বিশ্বাস ও ভালোবাসা নিয়ে মানুষ যোগ দিচ্ছে মেলায়।
মেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের মনের বাসনা পূরণের লক্ষ্যে বটমূলে পূজা-অর্চনাসহ বিভিন্ন ফলমূল ও পশুপাখি ভোগ দিয়ে থাকে। অনেকের বিশ্বাস, বটমূলের মাটি শরীরে মাখলে রোগবালাই সেরে যায়, প্রেমে সফল হওয়ার জন্য, দ্রুত বিয়ের কাজ সম্পন্ন করার জন্য এ স্থানের মাটি খুব উপকারী বলেও মনে করা হয়। এই দিন অনেকেই এখান থেকে পবিত্র মাটি নিয়ে যায়।
দেখা হলো ৭৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের সঙ্গে। বললেন, তাঁর নাম হরিদাস। পদবি জানালেন না। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দুর্গাপূজার মতোই আনন্দ করে পালন করে বউমেলা। প্রতিবছরই তিনি আসেন এখানে।
মেলায় এসেছিলেন কৃষ্ণদাস আর অমূল্য রায়। তাঁরা বললেন, এ মেলাটির জন্য তাঁরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। এ মেলায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
এবারের মেলায় মৃিশল্পীদের তৈরি নানা রঙের, নানা বর্ণের পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ময়না, টিয়া, বাঘ-ভালুক, হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে মিঠাই, মণ্ডা, অমৃতি, জিলাপির দোকান বসেছে। বসেছে বাউলগানের আসর। মেলায় গিয়ে দেখা গেল, দই-শিরনি, পায়েস, খৈ, উখড়ার ম-ম গন্ধে চারদিক সুরভিত হয়ে আছে। মেলায় দেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে পাঁঠা ও কবুতর।
মেলায় শিশুসহ সব শ্রেণীর মানুষকে মাতিয়ে রাখার জন্য রয়েছে বায়োস্কোপ। অবিরাম চরকি ঘুরছে শিশু-কিশোরদের নিয়ে। বউমেলায় এ দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। আগে এ মেলায় শুধু স্থানীয় লোকজনই আসত। এ বছর রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন বয়সের তরুণ-তরুণী-গৃহবধূরা এসে ভিড় জমান।
মেলা শেষ হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু মেলার আমেজ এখনো মিলিয়ে যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.