জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয়ে কমছে উৎপাদনশীলতা by মাসুদ রুমী
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতিসহ নানা অজুহাতে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। তবে বাড়িভাড়া ও পরিবহন খরচ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। সে অনুপাতে মানুষের আয় বাড়েনি। আর আয়-ব্যয়ের এই বৈষম্যের মধ্যে টিকে থাকার জন্য মানুষ নিজের শেষ সঞ্চয়টুকুও ভাঙছে।
যাদের কোনো সঞ্চয় নেই তাদের ধার-কর্জ করে চলতে হচ্ছে। এই আর্থসামাজিক চাপে মধ্যবিত্তদের অবস্থা নাস্তানাবুদ। পারিবারিক সঞ্চয় না থাকায় তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে।
সন্তানকে স্কুলে দেওয়া, বাজার করতে যাওয়াসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে মধ্যবিত্তের অন্যতম বাহন রিকশা। সেই রিকশা ভাড়াও বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে যেখানে একটি পরিবার দিনে ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে সাংসারিক অনেক কাজ সারতে পারত, এখন সেখানে দিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। আর সিএনজিচালিত স্কুটার ও বাস ভাড়া তো লাগামহীনভাবে বাড়ছে।
ঘর ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানি, ছেলেমেয়ের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় নির্ধারিত আয়ের মানুষের। বাজারের ফর্দ কাটছাঁট করে কম খেতে খেতে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে নির্ধারিত আয়ের মানুষ। এই চাপ পড়ছে তাদের মেধা ও উৎপাদন ক্ষমতায়। এতে জাতীয়ভাবে আমাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক। তাঁর মতে, এর নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়ছে প্রবৃদ্ধির ওপর।
কাজী ফারুক বলেন, 'দ্রব্যমূল্য অনেক আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এ পরিস্থিতিতে যেখানে সরকারের দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার কথা, সেখানে বাজার ব্যবস্থায় চলছে লাগামহীন অবস্থা। যে যার মতো করে পণ্যমূল্য বাড়িয়েই চলেছে। একবার কোনো অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে নিতে পারলে তা আর কমে না। পুরো বাজার ব্যবস্থা দেখে মনে হয় কারোর যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।'
বাজারে মোবাইল কোর্ট চলছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের শক্তি বাড়ানোর কথাও অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিশৃঙ্খল বাজারে এসব ছিটেফোঁটা উদ্যোগের কোনো প্রভাবই পড়ছে না বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমকে আরো জোরদারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'যারা পণ্য উৎপাদনকারী তাদেরও এর আওতায় আনতে হবে। কম্পানির অনিয়ম, ভেজালের শাস্তি শুধু অর্থদণ্ডে না দিয়ে জেলের বিধানও প্রয়োগ করা উচিত।' আর মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের পণ্যমূল্য বাড়ানোর লাগাম টানতে দ্রুত 'প্রাইস কমিশন' গঠন করা দরকার বলে জানান কাজী ফারুক।
বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে বরাবরই মানুষের আয় বাড়ানোর কথা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে ক্যাব সভাপতি বলেন, 'নির্ধারিত আয়ের মানুষের বেতন যৌক্তিক করার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। আর পণ্যমূল্য যাতে অযৌক্তিকভাবে না বাড়ে এর জন্য আইনি কাঠামো নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করতে হবে।'
'এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন ভোক্তাদের সচেতনতা। আমরা ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করি, তাই বলে আমাদের ওপর নানা ধরনের হুমকি থাকে। ভোক্তাদের নিয়ে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, যাতে ভোক্তা অধিকারের পাল্লা একসময় ভারী হয়ে যায়', বললেন কাজী ফারুক।
লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ, মিনারেল ওয়াটার, পারফিউমের মতো নানা ধরনের বিলাস পণ্যের বাজার গ্রামাঞ্চলে সম্প্রসারিত না হলেও শহুরে জীবনে ভোক্তাদের এসব পণ্যের প্রতি প্রলুব্ধ করার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। কাজী ফারুকের মতে, ব্যবসায়ীরা এ দেশের ভোক্তাদের ব্রিটিশদের চা খাওয়ানোর ফর্মুলা অবলম্বন করে নানা ধরনের কম প্রয়োজনীয় বিলাস পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তুলছে। এতে পদে পদে মানুষের ব্যয়ের উৎস বাড়ছে। সেইসঙ্গে নিঃশেষ হচ্ছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সঞ্চয়, যা দুর্দিনে তাকে দিতে পারত আর্থিক নিরাপত্তা।
যারা সৎভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে তাদের বাড়তি আয়ের জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। আর যারা এর বিপরীত পথ বেছে নিচ্ছে, তাদের মাধ্যমে সমাজে দুর্বৃত্তপনা বাড়ছে। মানুষের লোভ বাড়ছে, চাহিদা বাড়ছে, তেমনি দুর্নীতিও বাড়ছে। এই অসম পরিস্থিতিতে মানুষের মূল্যবোধ লোপ পাচ্ছে বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি। তিনি বলেন, 'চারদিকে ঠকবাজদের ভিড় বাড়ছে, মানুষকে ঠকিয়ে টাকা কামানোর নানা আয়োজন চলছে। মাত্রাতিরিক্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ। যার চূড়ান্ত প্রভাব আমরা দেশের আইনশৃঙ্খলার ওপর দেখতে পাচ্ছি।'
ব্যবসায় শেখানো হয় কনজ্যুমার ইজ 'কিং'। কিন্তু আমাদের দেশে তারা 'কিং'ও না, 'কুইন'ও না। তারা ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার হাতিয়ার। বাজার ব্যবস্থার কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হলেও আমরা নিজেকে গুটিয়ে সরে আছি। কোথাও কোনো প্রতিরোধ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোক্তার 'নীরব কণ্ঠস্বরকে' জাগ্রত করার মতো মানুষ এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠানও নেই। এক ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা মজুদদার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছি। রাজনীতিবিদদেরও ভোক্তা স্বার্থ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
No comments