চারদিক-যেদিন ভাইকে হারালাম by মুহাম্মদ শামসুল হক

১৬ এপ্রিল পটিয়া সদরে আমার ভাই পাকিস্তানি বাহিনীর বোমায় আঘাত পান। আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে হূদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল। ওই দিন সকালে আমাদের চোখের সামনে আমার বড় ভাই আমিনুল হক (২৫) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


একাত্তরের ১৬ এপ্রিল শুক্রবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জঙ্গি বিমানবহর পটিয়া সদরে আকস্মিক বোমা হামলা ও মেশিনগানের এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে প্রায় ২০ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়।
সে সময়কার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ স্থানীয় অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কালুরঘাট সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ প্রতিরোধে নিয়োজিত বাঙালি সেনা ও স্থানীয় সহযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বিমান ও পদাতিক বাহিনী ১১ এপ্রিল সকালে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। এ সময় ক্যাপ্টেন হারুন অর রশিদ (সাবেক সেনাপ্রধান) ও লে. শমসের মবিনসহ কয়েকজন বাঙালি সৈনিক ও সহযোদ্ধা আহত হন। এ পর্যায়ে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সমরশক্তির দিক থেকে নিজেদের অবস্থান দুর্বল হওয়ায় কালুরঘাট এলাকায় অবস্থানরত বাঙালি সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তাঁদের অনেকেই কালুরঘাট এলাকা ছেড়ে চলে যান রামগড়ের দিকে। অল্প কয়েকজন চলে যান পটিয়ার দিকে। কালুরঘাট এলাকার পতনোন্মুখ অবস্থা দেখে পটিয়া সদর ও আশপাশে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানকারী ইপিআরের (পরবর্তী সময়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) সর্বশেষ সদস্যদের মধ্যেও অনিশ্চিত অবস্থা দেখা দেয় এবং তাঁরাও সরে যেতে থাকেন এলাকা থেকে।
১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনী কালুরঘাট থেকে পটিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। এই অবসরে পটিয়া থেকে বাঙালিদের সম্ভাব্য অবস্থান ও আক্রমণ নস্যাত্ করার লক্ষ্যে চালায় বিমান হামলা।
১৬ এপ্রিল শুক্রবার পটিয়া সদর ও আশপাশ এলাকায় দুই দফায় বোমা হামলা চালায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী। প্রথম দফা হামলা চলে বেলা প্রায় ১১টায়।
আমার বড় ভাই আমিনুল হক ছিলেন পটিয়া কলেজের পূর্ব গেটের বিপরীতে নিজের দোকানে। তাঁকে খুঁজতে ছোটেন আরেক বড় ভাই জাহিদুল হক, আমার এক ছোট বোনের স্বামীকে নিয়ে। সদরে গিয়ে দেখেন চারদিকে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। লোকজনের আহাজারিতে থানা মোড়, কলেজ রোড, পিটিআই রোড, স্টেশন রোড, আদালত রোড, তালতলা চৌকি, সবজরপাড়া, হাবিবুর পাড়াসহ আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
জাহিদ ভাই আমিন ভাইয়ের খোঁজ নিতে দোকানে গিয়ে তাঁকে পেলেন না। তিনি স্থানীয় লোকজনের কাছে জানতে পারেন, আমিন ভাই বোমার স্প্লিন্টারে আহত হয়ে পটিয়া কলেজের দক্ষিণ দিকের রাস্তা বেয়ে পশ্চিমে দিকে ছুটে গেছেন। সেদিকে গিয়ে কলেজ মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মসজিদের কাছে ‘ইদুরমল্লাপাড়ার’ এক বাড়ির সামনে তাঁকে পাওয়া গেল। তাঁর চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের খোঁজে বেরিয়ে দেখলেন, বোমা হামলার পর সব চিকিৎসক চেম্বার কিংবা ডিসপেনসারি বন্ধ করে চলে গেছেন। অবশেষে ভাইয়েরা ছুটলেন পটিয়ার খাস্তগীরপাড়ার চিকিৎসক জহুরুল হকের বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু ডা. জহুরের বাড়িতে যাওয়ার পথে স্থানীয় কালীবাড়ির কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী দ্বিতীয় দফা বোমা হামলা শুরু করে এ সময়।
দিশেহারা হয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। খেতের আড়াল থেকে বের হয়ে স্থানীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাহিদ ভাই জানতে পারলেন, যেহেতু আমিন ভাইয়ের পেটে স্প্লিন্টার ঢুকেছে, তাই সেটি অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ রকম কাজের ঝুঁকি নেওয়ার মতো চিকিৎসক ও সরঞ্জাম তখন পটিয়ায় ছিল না। ডা. নূরুল ইসলামের (জাতীয় অধ্যাপক) সাক্ষাত্ পাওয়া গেল কাঞ্চননগর এলাকায়। তিনি একটি ইনজেকশন লিখে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি দেওয়া গেলে রোগী বাঁচতে পারে।’ দুর্ভাগ্য, সেদিন কোথাও সেই ইনজেকশন পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, পরদিন সকালে ডাক্তার প্রিয়দর্শন চৌধুরীর (এমবি ডাক্তার নামে খ্যাত) গ্রামের বাড়ি বাঘখাইনে সেই ইনজেকশন পাওয়া যায়। সেটি নিয়ে ১৭ এপ্রিল সকাল ১০টার সময় কম্পাউন্ডার সুপ্রিয় চৌধুরী আমাদের বাড়ির কাছে আমান আলী চৌধুরী মসজিদের সামনে এসেছেন, এমন সময় আমাদের চোখের সামনে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন বোমাহত আমিন ভাই।
পটিয়ায় বোমা হামলা ও গুলিতে সেদিন থানা মোড়ে নিজের চেম্বারে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান অশীতিপর হোমিও চিকিৎসক সৈয়দ আহমদসহ অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় গৌবিন্দারখিলের বাচা মিয়ার ছেলে ফয়েজ আহমদ, আমির ভাণ্ডার গেটের উত্তর দিকের নজির আহমদের স্ত্রী নছুমা খাতুন (২৭), মনির আহমদের ছেলে ছৈয়দুল হক (৮), পটিয়ার হাবিবুরপাড়ার ঘোড়াগাড়ির চালক উম্মর আলী (৫৫), ইদুরমল্লপাড়ার আমীর আহমদ (৬০), অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনসহ প্রায় ২০ জন। আহত হন ৫০ জনের মতো।
১৭ এপ্রিলের মধ্যে দোহাজারী পর্যন্ত পাকিস্তানিদের করতলগত হয়। পরদিন খবর পাওয়া যায়, আসার পথে তারা মিলিটারি পুল, কালারপুল, শিকলবাহা প্রভৃতি এলাকায়ও চালায় ব্যাপক ধ্বংসলীলা। এই ধ্বংসযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের মধ্যেও দেখা দেয় ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। এলাকার অধিকাংশ তরুণ-যুবক শত্রুদের শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় কয়েক দিনের জন্য বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়।

No comments

Powered by Blogger.