বিশেষজ্ঞ অভিমত-প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই by আনোয়ার ইব্রাহীম

রকারি পর্যায় থেকে শেয়ারবাজার সংকট নিরসনে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ; বিশেষত ব্যাংক, বীমা ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরাও বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগশূন্যতাই বাজারের প্রধান সংকট। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া এ মুহূর্তে অন্য কোনো পদক্ষেপই কাজ করবে না। প্রয়োজনে কিছু সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরানোর পরামর্শ দিয়েছেন


তারা। এদিকে শুক্রবারের বৈঠক শেষে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে একগুচ্ছ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই সব প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী যখন সময় দেবেন, তখনই আবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এসইসির সদস্য হেলাল উদ্দিন নিজামী সমকালকে জানিয়েছেন, শুক্রবার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সব প্রস্তাবের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। গতকাল শনিবার অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি
বলেন, 'এখন প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই বৈঠক হবে।' অন্য এক সূত্রে জানা গেছে, সংকট উত্তরণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে কর হ্রাস ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রস্তাব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো
পর্যালোচনা করতে আজ রোববারও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশ কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করার কথা ছিল রোববার। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, এ ঘোষণা আজ না-ও হতে পারে। তবে এ সপ্তাহের যে কোনো দিন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা জানানো হতে পারে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, সরকার সমস্যাটি সমাধানে আন্তরিক। তাই কিছুটা সময় বেশি লাগলেও তা মেনে নেওয়া উচিত। কোনো প্রকার গুজব বা আতঙ্কে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ডিএসইর পরিচালক আহমেদ রশীদ লালি বলেন, আমরা আশাবাদী। সরকার বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নেবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, গত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানতে গিয়ে ব্যাংকগুলো যে বিপুল বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে, তা-ই ছিল বাজার পতনের প্রধান কারণ। বাজারকে ঊর্ধ্বমুখী করতে হলে, ব্যাংকগুলোকে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে ফিরিয়ে আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক সিইও সালাউদ্দিন আহমেদ খান জানান, গত তিন বছর বাজারে প্রধান বিনিয়োগ গোষ্ঠী ছিল ব্যাংকিং খাত। এককভাবে এই গোষ্ঠীর নিজস্ব পোর্টফোলিও থেকে অংশগ্রহণ ছিল দৈনিক গড় লেনদেনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে সহযোগী বা অপর মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর লেনদেন ছিল আরও অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অস্বাভাবিক দরপতন শুরু হলে এক পর্যায়ে ব্যাংকগুলো, পাশাপাশি অন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরাও ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, 'পুনরায় তাদের বিনিয়োগে ফেরানো না গেলে অপর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজারে ফিরে আসবে না। তেমনটি হলে বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কষ্টকর হবে।' দরপতন ঠেকাতে ইতিপূর্বের উদ্যোগ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, ওইসব পদক্ষেপের ফলে বাজার সাময়িক ঊর্ধ্বমুখীও হলেও শেষ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না হওয়ায় বাজার কখনও স্থিতিশীল ভিত্তি পায়নি।
তবে ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সংকট থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে ফিরতে পারবে কি-না তা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো দাবি করছে, সিআরআর ও এসএলআর রেট অন্তত ১ শতাংশ কমালে তারা বিনিয়োগে ফিরতে পারবে। ১ শতাংশ এসএলআর রেট কমালেই ব্যাংকগুলোকে ৪ হাজার কোটি টাকা কম অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে। যার বৃহৎ অংশই তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ দাবি মেনে নেবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগ বাজার দরের ভিত্তিতে (মার্ক-টু-মার্কেট) হিসাব না করে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে (নেট অব বেসিস) বা ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে (কস্ট প্রাইস বেসিস) হিসাব করারও দাবি জানিয়ে আসছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি ও দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে মাহমুদ সাত্তার বলেন, 'বাজার দরের ভিত্তিতে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব করায় আর্থিক হিসাবে প্রকৃত চিত্র প্রতিফলন হয় না।' এ মতকে সমর্থন করে অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, দরপতন ঠেকানো না গেলে কিছু ব্যাংকের মুনাফা প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হবে। যদিও তাদের প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবসা থেকে মুনাফা বাড়ছে। এতে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি ও অস্থিরতা বাড়বে।
সিআরআর ও এসএলআর রেট কমানোর বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, 'এটা ঠিক, ব্যাংকগুলোকে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে ফেরাতে না পারলে বাজারে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ফেরানো কঠিন হবে।' ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরাতে হলে কিছু সুবিধা দিতে হবে_ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'সিআরআর ও এসএলআর রেট কমানো হলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। বরং এতে ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের সংকট কমবে।'
মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া একক ঋণগ্রহীতা হিসেবে ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসে ঋণ সীমা (সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট) বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা একমত হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি উন্নয়নে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছেন_ এমন খবরেই গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দেশের শেয়ারবাজারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়। টানা দরপতনের পর চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। সর্বশেষ দুই দিনে সূচক বেড়েছে ৫১৮ পয়েন্ট বা ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ পর্যায়ে আজ রোববার বাজারে আবারও লেনদেন শুরু হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.