টিউলিপের দেশের বৈমানিক ক্রিকেটার by সামীউর রহমান

নেদারল্যান্ডসে লোকে ফুটবল নিয়ে যতটা পাগল, বাংলাদেশে ক্রিকেট নিয়েও দেখছি তেমন উন্মাদনা', আমস্টারডাম থেকে আসা জোলেট হার্টেনহফের চোখে এভাবেই ধরা দিয়েছে বাংলাদেশ। কদিন আগেই শেষ হয়েছে প্রশিক্ষণপর্ব, দেশে ফিরেই যোগ দেবেন কোনো একটা বিমান সংস্থায়। এরপর পুরোদস্তুর বৈমানিক, ক্রিকেট চলে যাবে ব্যাকফুটে।


কিন্তু বাংলাদেশ? মানুষের আন্তরিকতা ও মজার সব স্মৃতির কারণে ভৌগোলিকভাবে অনেক দূরের দেশটাও জোলেটের কাছে হয়ে গেছে খুব কাছের, তাই সুযোগ হলে বিমানে চড়ে নয় বরং বিমান চালিয়েই আসতে চান বাংলাদেশে।
টানা দুই দিন খেলার পর সূচিতে শনিবারটা ছিল 'বিশ্রাম দিবস'। বিকেলে একদফা কেনাকাটা করতে বের হন বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা মহিলা ক্রিকেটাররা। লবিতে বসে সতীর্থদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আইরিশ অধিনায়ক ইসোবেল জয়েস। ক্রিকেটের কল্যাণে আয়ারল্যান্ডের 'জয়েস' নামটা হয়তো কিছুটা পরিচিত, কিন্তু 'আয়ারল্যান্ড' এবং 'জয়েস'_এই দুটি শব্দ একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় জেমস জয়েসের বেলায়। আইরিশ এই লেখককে ধরা হয় বিংশ শতকের শুরুর দিককার সবচেয়ে প্রভাবশালী কথাশিল্পী, আধুনিকতার অগ্রপথিক। এ কারণে বহু দেশেই ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষাপর্বে তাঁর লেখা অবশ্যপাঠ্য। ইসোবেলের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক উপাধির মিল থাকলেও কোনো আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলতে পারলেন না। যদিও মিল খানিকটা আছে, ইসোবেলও লেখালেখি করেন। আইরিশ একটি দৈনিকের রবিবাসরীয় সংস্করণে খেলার পাতার সহসম্পাদক তিনি। আয়ারল্যান্ডে কোনো বিদেশি দল খেলতে গেলে তাঁকে যে কাজটা করতে হয়, বাংলাদেশে এসে নিজেকে তিনি আবিষ্কার করেছেন ঠিক তার বিপরীত বিন্দুতে। প্রশ্ন ছিল, 'ক্রিকেট, হকির কোচিং এত কিছুর পরও সাংবাদিকতার জন্য সময় পান?' উত্তরে শোনা গেল, 'আমার বস খুব ভালো, তাই হয়ে যায়!'
খেলাধুলার পাশাপাশি ক্রীড়া-সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, এমন উদাহারণ অনেক। কিন্তু ক্রিকেটার এবং বৈমানিক_এমন যুগলবন্দি তো বিরল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার অনেক ক্রিকেটারই যোগ দিয়েছিলেন রাজকীয় বিমানবাহিনীতে। তবে জোলেট যুদ্ধবিমান নয়, বেসামরিক বিমান চালানোরই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। থাকেন আমস্টারডামে, যে শহরের ক্লাব আয়াঙ্ ভুবনবিখ্যাত। কিন্তু ফুটবল যেন টানে না তাঁকে, 'নেদারল্যান্ডসের খেলা থাকলে দেখি। ক্লাব নিয়ে খুব একটা মাতামাতি নেই। আয়াঙ্রে খেলা অবশ্য দেখতে বারদুয়েক গিয়েছি।' আকাশে ওড়া আর ক্রিকেটের বাইরে যা তাঁকে টানে, তা হচ্ছে ফুল। নেদারল্যান্ডসের টিউলিপের খ্যাতি তো দুনিয়াজোড়া। টিউলিপের প্রসঙ্গ উঠতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জোলেটের, 'ওহ টিউলিপ! আমাদের টিউলিপ তো গোটা বিশ্বে যাচ্ছে। তুমি দেখেছ এখানে?' ইসোবেল ও জোলেট ছাড়াও বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশে আসা আরো অনেক মহিলা ক্রিকেটারই আছেন, মাঠের বাইরে যাঁরা জড়িয়ে আছেন নানা পেশায়। শ্রীলঙ্কা দলের বেশির ভাগ সদস্যই যেমন নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীতে আছেন। নেদারল্যান্ডস দলে ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, জৈবপ্রযুক্তিবিদ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকসহ বিচিত্র সব পেশাজীবীদের সমারোহ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে আছেন ভাষাতত্ত্ববিদ ও ফুটবলের রেফারি। সংগীতশিল্পীও কম নয়! আইরিশ দলের তিনজন ক্রিকেটার আছেন একটি ব্যান্ডে, জাপানের মিহো কান্নো একটি ব্যান্ড দলে ট্রাম্পেট বাজান।
নেদারল্যান্ডসের টিউলিপের সুবাস যেমন গোটা বিশ্বে ছড়াচ্ছে, জেমস জয়েসের লেখা যেমন ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ্যসূচিতে স্থান করে নিয়েছে, তেমনি গর্ব করার মতো ব্যাপার বাংলাদেশেরও আছে। তা হলো বাঙালি রসনা ও পোশাক। বিশেষ করে পোশাকের ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহটা যে স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হয় না! শাড়ির ব্যাপারে বৈমানিক কী সাংবাদিক দুজনেরই সমান আগ্রহ। ইসোবেল জানতে চাইছিলেন শাড়ির দাম কেমন। অন্যদিকে জোলেটের বেশি পছন্দ হয়েছে স্কার্ফ, 'এখানকার মেয়েরা গলায় যে স্কার্ফ পেঁচিয়ে রাখে, ওগুলো বেশ পছন্দ হয়েছে আমার। কয়েকটা কিনেছিও।' কিন্তু বাঙালি রসনা পরিতৃপ্ত করতে পারেনি তাঁদের কাউকেই, 'খাবারগুলো কেমন যেন শুকনো। মুরগি, ভাত, কিছুতেই কোনো সস নেই', যে কারণে কন্টিনেন্টাল খাবারেই পেট ভরাচ্ছেন ইসোবেল। জোলেট আবার একদম নিরামিষভোজী, তাই পদ্মার ইলিশে স্বাদ চেখে দেখতে না পারার আক্ষেপ তাঁর গলায়, 'অনেকেই স্মোকড ইলিশটা খেয়েছে বুফেতে। কিন্তু আমি তো নিরামিষভোজী, সবজি আর ডাল ছাড়া অন্য কোনো কিছু খাই না।'

No comments

Powered by Blogger.