বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-নবাগত এমপিরা আবার সংবাদ শিরোনাম! by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
নবাগত সংসদ সদস্যরা আবারও নেতিবাচক অর্থে সংবাদ শিরোনাম হলেন। ক্ষমতার জোরে তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি এখন আর রাখঢাকের মধ্যে নেই। ক্ষমতাবানরা ভুলে যান_ক্ষমতা, ক্ষমতার শত্রু-মিত্র, দুই-ই হতে পারে। এ কথাটি নতুন নয় বটে, কিন্তু ক্ষমতাবান রাজনীতিক কিংবা রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা এ সত্যটি আমলে নিতে চাননি, এখনো চান না। তবে এর মূল্য দলকে দিতে হয়।
ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতাবহির্ভূত ক্ষমতাবানদেরও দিতে হয়_এমন নজির আমাদের সামনেই আছে বিস্তর। ইতিহাস থেকে এ দেশে শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে যে অনাগ্রহ, উদাসীনতা কিংবা উপেক্ষা পরিলক্ষিত হয়, এর বিরূপ প্রভাব পড়ে জনজীবনে। কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় নবাগত সংসদ সদস্যদের অনেকেই (বিশেষ করে ক্ষমতাসীন মহলের সংসদ সদস্যরা) নেতিবাচক অর্থে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন। ১৩ নভেম্বর ২০১১ কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় 'প্রথমবার এমপি হয়েই ধরাকে সরা জ্ঞান' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পুনর্বার যে তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, এই নবাগতরা (তবে এর ব্যতিক্রমও আছেন, যদিও তাঁরা সংখ্যায় নগণ্য) সরকার, দল ও মহাজোটের ললাটে শুধু কলঙ্কতিলকই এঁকে দিচ্ছেন না, তাঁরা ক্রমেই দলের বোঝা এবং অবহনযোগ্যও হয়ে উঠছেন। এমন চিত্র গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও দেখা গিয়েছিল। আমরা যাঁরা মফস্বলে বড় হয়েছি কিংবা সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে খানিকটা হলেও জ্ঞাত, তাঁরা ভালো করেই জানি, মফস্বলে যাঁরা সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের হাত-পা অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবানদের রশিতে বাঁধা। এই বন্ধন ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার সাধ্য বা সাহস অনেকেরই নেই। অবশ্য সাধ্য বা সাহসের প্রশ্ন তুলে ওই সাংবাদিকদের খাটো করে দেখার অবকাশও খুব একটা নেই। কারণ কোনো কোনো ক্ষমতাবানের ক্ষমতার দাপটে ইতিমধ্যে অনেকেই আক্রান্ত হয়ে বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়েছেন, তাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার, দল কিংবা মহাজোট_এসব বিষয় তাদের নিজ নিজ ফোরামে তুলে ধরে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? ক্ষমতাবহির্ভূত অবৈধ বিপুল ক্ষমতার প্রশ্রয়ই বা দেওয়া হচ্ছে কেন? ওই প্রতিবেদনে স্বেচ্ছাচারী, ক্ষমতাবান নবাগত সংসদ সদস্যদের একটি তালিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এই তালিকার বাইরেও আরো অনেকেই আছেন, যাঁরা সব কিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নানা রকম দুষ্কর্ম করছেন। তাঁরা অনেকটা মুখোশধারী বলা যায়। মানুষ এসবই আমলে নিচ্ছে। কারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন, তাদের অচেতন করে রাখার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। ক্ষমতাবান, স্বেচ্ছাচারীদের বিরুদ্ধে মানুষ মুখও খুলতে শুরু করেছে। দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের চরম ক্ষোভ প্রকাশের চিত্রও চোখে পড়ছে। সাধারণ মানুষ কিংবা ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ। ক্ষমতাবানদের ওপর সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান এই ক্ষোভ অমূলক নয়। দলের নীতিনির্ধারকরা এই দেয়াললিখন পড়তে পারছেন না।
আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা কেন ভুলে যান, নীরব ভোটার বলে এক অপরিমেয় শক্তি রয়েছে এবং তাদের রায়ের ওপর এই ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের রাজনীতিক হিসেবে বাঁচা-মরার অনেক কিছুই নির্ভর করে। প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এবার যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ধরাকে যে সরা জ্ঞান করছেন, এমন দৃষ্টান্ত অস্পষ্ট নয়। ওই প্রতিবেদনেই জানা গেল, দলের আমিত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। দলের বোঝা এমন সংসদ সদস্য প্রতিটি বিভাগেই কমবেশি আছেন। তাঁরা কী-ই বা না করছেন। দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি, আত্মীয়করণ, নিজস্ব অনুসারীদের দিয়ে সুবিধা ভোগ, জায়গাজমি দখল, নানা ক্ষেত্র থেকে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন এবং হত্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনায়ও কেউ কেউ যুক্ত হচ্ছেন! এর ফলে শীর্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে দলের নেতা-কর্মীরা এখন ত্যক্ত-বিরক্ত এবং সংগতই ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত। এই ক্ষমতাবানদের দাপটে স্থানীয় প্রশাসন সব সময় থাকে তটস্থ এবং অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের সেবাদাস হয়ে নিজেদেরও আখের গোছাচ্ছেন ভীতিমুক্তভাবে। কারণ ক্ষমতার এমন খুঁটি যাঁদের আছে, তাঁরা আর তোয়াক্কা করবেন কাকে। কিন্তু এমন চিত্র বা পরিস্থিতি অন্তত এবার উদ্ভব হবে না_সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাটা ছিল সে রকমই। কারণ গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, মূল্য দিয়ে, ওলটপালট হওয়ার পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এরপর ক্ষমতাসীনরা মানুষের কাছে নতুন করে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন, তাতে মানুষ সংগতই খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই আশার অপমৃত্যু ঘটছে এবং একই সঙ্গে অবহনযোগ্য ক্ষমতাবানদের তালিকাটাও ক্রমদীর্ঘ হচ্ছে।
কিছুসংখ্যক ক্ষমতাবান সংসদ সদস্য, যাঁদের বেশির ভাগই নবাগত এবং ক্ষমতাসীন মহলের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা আইন প্রণেতা হিসেবে দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে তাঁদের প্রকৃত কাজটা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ওই কাজ বাদ দিয়ে তাঁরা নীতি নিয়েছেন, 'নাগালেরটাও খাবেন, নাগালের বাইরেও হাত বাড়াবেন।' দেশে বিশেষ করে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা প্রয়োগসহ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অপকর্মগুলো চলছে ক্ষমতাবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে_এ সত্য এড়ানো দুরূহ। এমনও অভিযোগ আসছে, মন্দির, মসজিদ, গির্জার জন্য ত্রাণ বা অনুদান হিসেবে যেসব গম, চাল ও অর্থ আসে, কোথাও কোথাও এর অর্ধেক দিয়ে দিতে হয় ওই ক্ষমতাবান সংসদ সদস্যদের নির্দিষ্ট লোকদের! আবার কোথাও কোথাও তার পুরোটাই গায়েব হয়ে যায়! অনেকেই মনে করেন, এর প্রধান কারণ নীতিহীন সংসদ সদস্যদের অতিরিক্ত লোভজনিত সেই বিশেষ নীতি অর্থাৎ 'নাগালেরটাও খাবেন, নাগালের বাইরেও হাত বাড়াবেন।' কেউ কেউ আবার অন্যের কিংবা সরকারি জায়গাজমি দখলেও মত্ত হয়ে উঠেছেন_এমন খবরও পত্রপত্রিকায় আসছে। এ অবস্থা যেখানে বিদ্যমান, সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকছে তাও খুব সহজেই অনুমেয়।
একজন নিষ্ঠাবান প্রধানমন্ত্রী, কয়েকজন মন্ত্রী (অনেক মন্ত্রীর দক্ষতা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে) কিংবা সংসদ সদস্য এই রসাতলগামী দেশটাকে উদ্ধার করার যতই চেষ্টা করুন না কেন, তা যে মোটেই সহজ নয়, বিদ্যমান বাস্তবতা এরই সাক্ষ্যবহ। সরকারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কিংবা নানা স্তরের সহযোগিতা, অঙ্গীকার, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ভিন্ন এমন কঠিন কাজ সম্পন্ন করা দুঃসাধ্য। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন এবং মহাজোটভুক্ত সব দলের কিছুসংখ্যক নেতার ঐকান্তিক চেষ্টায় এই সরকারের অর্জন ইতিমধ্যে কম ছিল না বটে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্জনগুলো ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একেই বলে 'অর্জনের বিসর্জন'। জেলা-উপজেলায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ কিংবা অন্যান্য লীগের মধ্যে যে অন্তঃকলহ, সংঘাত, হানাহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটছে, এর অন্যতম কারণ নীতিহীন সংসদ সদস্যদের অতিরিক্ত লালসা_এমন মন্তব্য মোটেই অমূলক নয়। সম্প্রতি নরসিংদীতে লোকমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ মহাবিপাকে পড়েছে। এ রকম সজ্জন লোকমানের সংখ্যা এখনো দলে অসংখ্য, কিন্তু তাঁরা স্বেচ্ছাচারী, আমিত্ববাদী ও দুষ্কর্মকারীদের দাপটে কোণঠাসা। দলের সদস্যদের মধ্যে যখন স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখনই শুরু হয় রক্তারক্তি। যাঁরা আদর্শের জন্য দল করেন, যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চান, যাঁরা চান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার অতীতের জোট সরকারের বিপরীতে সাধারণ্যে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করুক, তাঁদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে শুরু হয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে ক্যাডার-সংস্কৃতি চালু থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যত কথাই বলুন না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। তাঁরা পুলিশকে বলছেন, অপরাধী যে দলেরই হোক, তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু মফস্বলের একজন ওসি ভালো করেই জানেন, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বৈরিতা করা যায় না। নীতিহীন সংসদ সদস্যদের বাহুবলস্বরূপ এই ক্যাডারদের শায়েস্তা করতে গেলে তিনি নিজেই শায়েস্তা হয়ে যাবেন। তাই এসব ক্ষমতাবানের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে নিজেও দুই পয়সা কামিয়ে নেওয়াটাকেই তাঁরা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করছেন এবং হচ্ছেও তা-ই।
আগেই বলেছি, সাধারণ মানুষ কিন্তু এখন আর আগের মতো এত অসচেতন কিংবা অন্ধ নয়। তারা সবই পর্যবেক্ষণ করছে। প্রকাশ্যে তেমনভাবে মুখে কিছু না বললেও ক্রমেই ফুঁসছে। এসবকে পুঁজি করে বিরোধী দল যখন মাঠ গরম করতে রাস্তায় নামবে, তখন অতীত ভুলে গিয়ে একসময় তারা প্রত্যাশা করবে_এ অবস্থার পরিবর্তন হোক। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের উচিত, প্রতিটি জেলার সাধারণ মানুষের গোপন মতামত নেওয়া এবং প্রয়োজনে তৃণমূল পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানো এবং সব কিছুর ঊধর্ে্ব থেকে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া। এর ফলে দল আমিত্ববাদীদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে। প্রতিটি জেলায় কোনো না কোনো সংসদ সদস্য এমন সব দুষ্কর্ম করছেন, যা কেন্দ্রে বসে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানেনই না। অথচ জনগণের খতিয়ানে সবই জমা হচ্ছে। আবার এও সত্য, প্রথমবার এমপি হয়েছেন এমনও অনেক যাঁরা এই দাপাদাপির মধ্যেও নিজেরা নিষ্ঠার সঙ্গে এখনো কাজের কাজ করে যাচ্ছেন। সন্দেহ নেই, এখনো মানুষ চরমভাবে ফুঁসে উঠছে না তাঁদের কারণে। কিন্তু তাঁরা সব দিকে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে আছেন, যাঁদের বলা যায় পোড়খাওয়া রাজনীতিক। তাঁদের কেউ কেউ বাস্তবতা উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সত্য উচ্চারণ করেও বিপাকে পড়ছেন, যা শুভ লক্ষণ নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যদি স্বাধীনতার সুফল সত্যিকার অর্থেই জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দিতে চায়, নির্বাচনী অঙ্গীকার নিয়ে যদি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করতে না চায়, সত্যিকার অর্থেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চায়, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করতে চায় এবং দেশকে এগিয়ে নিতে চায়_তাহলে এখনই কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সত্যাসত্য যাচাই করে কিংবা তৃণমূল পর্যায়ে গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মহাক্ষমতাধর নীতিহীন সংসদ সদস্যদের দিকে আর বিলম্ব না করে কঠোর দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
দুর্মুখেরা বলেন, আওয়ামী লীগ পড়েছে কিছু আমিত্ববাদী ও স্বেচ্ছাচারীর কবলে। অনেকেই চান, তাদের এমন মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হোক। দেশটা প্রকৃত অর্থেই আমিত্ববাদী, স্বেচ্ছাচারীদের কবলমুক্ত হোক। সব দলের ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা কেন ভুলে যান, নীরব ভোটার বলে এক অপরিমেয় শক্তি রয়েছে এবং তাদের রায়ের ওপর এই ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের রাজনীতিক হিসেবে বাঁচা-মরার অনেক কিছুই নির্ভর করে। প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এবার যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ধরাকে যে সরা জ্ঞান করছেন, এমন দৃষ্টান্ত অস্পষ্ট নয়। ওই প্রতিবেদনেই জানা গেল, দলের আমিত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। দলের বোঝা এমন সংসদ সদস্য প্রতিটি বিভাগেই কমবেশি আছেন। তাঁরা কী-ই বা না করছেন। দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি, আত্মীয়করণ, নিজস্ব অনুসারীদের দিয়ে সুবিধা ভোগ, জায়গাজমি দখল, নানা ক্ষেত্র থেকে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন এবং হত্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনায়ও কেউ কেউ যুক্ত হচ্ছেন! এর ফলে শীর্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে দলের নেতা-কর্মীরা এখন ত্যক্ত-বিরক্ত এবং সংগতই ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত। এই ক্ষমতাবানদের দাপটে স্থানীয় প্রশাসন সব সময় থাকে তটস্থ এবং অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের সেবাদাস হয়ে নিজেদেরও আখের গোছাচ্ছেন ভীতিমুক্তভাবে। কারণ ক্ষমতার এমন খুঁটি যাঁদের আছে, তাঁরা আর তোয়াক্কা করবেন কাকে। কিন্তু এমন চিত্র বা পরিস্থিতি অন্তত এবার উদ্ভব হবে না_সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাটা ছিল সে রকমই। কারণ গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, মূল্য দিয়ে, ওলটপালট হওয়ার পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এরপর ক্ষমতাসীনরা মানুষের কাছে নতুন করে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন, তাতে মানুষ সংগতই খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই আশার অপমৃত্যু ঘটছে এবং একই সঙ্গে অবহনযোগ্য ক্ষমতাবানদের তালিকাটাও ক্রমদীর্ঘ হচ্ছে।
কিছুসংখ্যক ক্ষমতাবান সংসদ সদস্য, যাঁদের বেশির ভাগই নবাগত এবং ক্ষমতাসীন মহলের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা আইন প্রণেতা হিসেবে দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে তাঁদের প্রকৃত কাজটা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ওই কাজ বাদ দিয়ে তাঁরা নীতি নিয়েছেন, 'নাগালেরটাও খাবেন, নাগালের বাইরেও হাত বাড়াবেন।' দেশে বিশেষ করে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা প্রয়োগসহ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অপকর্মগুলো চলছে ক্ষমতাবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে_এ সত্য এড়ানো দুরূহ। এমনও অভিযোগ আসছে, মন্দির, মসজিদ, গির্জার জন্য ত্রাণ বা অনুদান হিসেবে যেসব গম, চাল ও অর্থ আসে, কোথাও কোথাও এর অর্ধেক দিয়ে দিতে হয় ওই ক্ষমতাবান সংসদ সদস্যদের নির্দিষ্ট লোকদের! আবার কোথাও কোথাও তার পুরোটাই গায়েব হয়ে যায়! অনেকেই মনে করেন, এর প্রধান কারণ নীতিহীন সংসদ সদস্যদের অতিরিক্ত লোভজনিত সেই বিশেষ নীতি অর্থাৎ 'নাগালেরটাও খাবেন, নাগালের বাইরেও হাত বাড়াবেন।' কেউ কেউ আবার অন্যের কিংবা সরকারি জায়গাজমি দখলেও মত্ত হয়ে উঠেছেন_এমন খবরও পত্রপত্রিকায় আসছে। এ অবস্থা যেখানে বিদ্যমান, সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকছে তাও খুব সহজেই অনুমেয়।
একজন নিষ্ঠাবান প্রধানমন্ত্রী, কয়েকজন মন্ত্রী (অনেক মন্ত্রীর দক্ষতা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে) কিংবা সংসদ সদস্য এই রসাতলগামী দেশটাকে উদ্ধার করার যতই চেষ্টা করুন না কেন, তা যে মোটেই সহজ নয়, বিদ্যমান বাস্তবতা এরই সাক্ষ্যবহ। সরকারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কিংবা নানা স্তরের সহযোগিতা, অঙ্গীকার, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ভিন্ন এমন কঠিন কাজ সম্পন্ন করা দুঃসাধ্য। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন এবং মহাজোটভুক্ত সব দলের কিছুসংখ্যক নেতার ঐকান্তিক চেষ্টায় এই সরকারের অর্জন ইতিমধ্যে কম ছিল না বটে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্জনগুলো ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একেই বলে 'অর্জনের বিসর্জন'। জেলা-উপজেলায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ কিংবা অন্যান্য লীগের মধ্যে যে অন্তঃকলহ, সংঘাত, হানাহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটছে, এর অন্যতম কারণ নীতিহীন সংসদ সদস্যদের অতিরিক্ত লালসা_এমন মন্তব্য মোটেই অমূলক নয়। সম্প্রতি নরসিংদীতে লোকমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ মহাবিপাকে পড়েছে। এ রকম সজ্জন লোকমানের সংখ্যা এখনো দলে অসংখ্য, কিন্তু তাঁরা স্বেচ্ছাচারী, আমিত্ববাদী ও দুষ্কর্মকারীদের দাপটে কোণঠাসা। দলের সদস্যদের মধ্যে যখন স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখনই শুরু হয় রক্তারক্তি। যাঁরা আদর্শের জন্য দল করেন, যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চান, যাঁরা চান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার অতীতের জোট সরকারের বিপরীতে সাধারণ্যে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করুক, তাঁদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে শুরু হয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে ক্যাডার-সংস্কৃতি চালু থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যত কথাই বলুন না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। তাঁরা পুলিশকে বলছেন, অপরাধী যে দলেরই হোক, তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু মফস্বলের একজন ওসি ভালো করেই জানেন, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বৈরিতা করা যায় না। নীতিহীন সংসদ সদস্যদের বাহুবলস্বরূপ এই ক্যাডারদের শায়েস্তা করতে গেলে তিনি নিজেই শায়েস্তা হয়ে যাবেন। তাই এসব ক্ষমতাবানের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে নিজেও দুই পয়সা কামিয়ে নেওয়াটাকেই তাঁরা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করছেন এবং হচ্ছেও তা-ই।
আগেই বলেছি, সাধারণ মানুষ কিন্তু এখন আর আগের মতো এত অসচেতন কিংবা অন্ধ নয়। তারা সবই পর্যবেক্ষণ করছে। প্রকাশ্যে তেমনভাবে মুখে কিছু না বললেও ক্রমেই ফুঁসছে। এসবকে পুঁজি করে বিরোধী দল যখন মাঠ গরম করতে রাস্তায় নামবে, তখন অতীত ভুলে গিয়ে একসময় তারা প্রত্যাশা করবে_এ অবস্থার পরিবর্তন হোক। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের উচিত, প্রতিটি জেলার সাধারণ মানুষের গোপন মতামত নেওয়া এবং প্রয়োজনে তৃণমূল পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানো এবং সব কিছুর ঊধর্ে্ব থেকে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া। এর ফলে দল আমিত্ববাদীদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে। প্রতিটি জেলায় কোনো না কোনো সংসদ সদস্য এমন সব দুষ্কর্ম করছেন, যা কেন্দ্রে বসে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানেনই না। অথচ জনগণের খতিয়ানে সবই জমা হচ্ছে। আবার এও সত্য, প্রথমবার এমপি হয়েছেন এমনও অনেক যাঁরা এই দাপাদাপির মধ্যেও নিজেরা নিষ্ঠার সঙ্গে এখনো কাজের কাজ করে যাচ্ছেন। সন্দেহ নেই, এখনো মানুষ চরমভাবে ফুঁসে উঠছে না তাঁদের কারণে। কিন্তু তাঁরা সব দিকে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে আছেন, যাঁদের বলা যায় পোড়খাওয়া রাজনীতিক। তাঁদের কেউ কেউ বাস্তবতা উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সত্য উচ্চারণ করেও বিপাকে পড়ছেন, যা শুভ লক্ষণ নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যদি স্বাধীনতার সুফল সত্যিকার অর্থেই জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দিতে চায়, নির্বাচনী অঙ্গীকার নিয়ে যদি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করতে না চায়, সত্যিকার অর্থেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চায়, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করতে চায় এবং দেশকে এগিয়ে নিতে চায়_তাহলে এখনই কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সত্যাসত্য যাচাই করে কিংবা তৃণমূল পর্যায়ে গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মহাক্ষমতাধর নীতিহীন সংসদ সদস্যদের দিকে আর বিলম্ব না করে কঠোর দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
দুর্মুখেরা বলেন, আওয়ামী লীগ পড়েছে কিছু আমিত্ববাদী ও স্বেচ্ছাচারীর কবলে। অনেকেই চান, তাদের এমন মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হোক। দেশটা প্রকৃত অর্থেই আমিত্ববাদী, স্বেচ্ছাচারীদের কবলমুক্ত হোক। সব দলের ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments