শেয়ারবাজার এগিয়ে-শিল্পে অর্থায়ন by আনোয়ার ইব্রাহীম

রকার ও জাতীয় নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে বরাবরই বলা হয়, জাতীয় অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের অবদান নগণ্য। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এ নেতিবাচক মানসিকতায় জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেয়ারবাজার কখনোই গুরুত্ব পায়নি। এমনকি দেশে শিল্প খাতের অর্থায়নে শেয়ারবাজারের যে বলিষ্ঠ অবদান রয়েছে, তাও স্বীকার করা হয় না; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা।


দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছর ধরে শিল্পে অর্থায়নে ব্যাংকিং খাতের থেকেও শেয়ারবাজারের অবদান লক্ষণীয় পরিমাণ বেশি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শিল্পে ২৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, সেখানে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সরবরাহ করা হয়েছে মোট ৬২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। উলি্লখিত অর্থবছরে শিল্পে অর্থায়নে ব্যাংকিং খাতের তুলনায় শেয়ারবাজারের অবদান প্রায় আড়াই গুণ বেশি। সর্বশেষ অর্থবছরে এ ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিচালন মূলধন হিসেবে সাধারণত ১ থেকে ১০ বছর মেয়াদি যে ঋণ প্রদান করা হয়, ব্যাংকিং পরিভাষায় তা মেয়াদি ঋণ হিসেবে পরিচিত। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে। অপরদিকে, শেয়ারবাজার থেকে সংগৃহীত মূলধনের অর্থ কখনোই ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন নেই। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ঋণ সব সময়েই শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য দায় হিসেবে এবং শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির তুলনায় আমাদের শেয়ারবাজারের আকার অত্যন্ত ছোট হলেও অর্থায়নে পরিমাণগত দিক থেকে শেয়ারবাজারের অবস্থান এখন প্রথম। ব্যাংকিং খাত থেকে গত কয়েক বছরে শিল্প খাতে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ মূলধন সরবরাহ করা হয়েছে শেয়ারবাজার থেকে। চাহিদার তুলনায় মূলধন সরবরাহে দেশের শেয়ারবাজার ক্ষমতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত_ এমন ধারণা দিয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, তারপরও বেশির ভাগ বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারের সুবিধা নিতে অনিচ্ছুক। এ জন্য সরকারি ও নীতি-নির্ধারণী মহলের ভ্রান্ত ধারণা ও শেয়ারবাজার বিমুখীতাকে দায়ী করেন অর্থনীতিবিদরা।
কোম্পানি নিবন্ধন সংস্থা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের কার্যালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, বর্তমানে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। এর মধ্যে অন্তত ৪ হাজার কোম্পানি সরাসরি শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী প্রায় ৪ হাজার ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। বিপরীতে শেয়ারবাজারে বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২৫০টিরও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সাত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে যেখানে ব্যাংকগুলো কয়েকশ' শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ বিতরণ করে, সেখানে শেয়ারবাজার থেকে মাত্র সোয়া দুইশ' কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করে ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে ব্যাংকগুলোর শিল্পে প্রদত্ত মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮ হাজার ৬৯০ কোটি, ৯ হাজার ৬৫০, ১২ হাজার ৪০০, ২০ হাজার ১৫০, ১৯ হাজার ৯৮০ এবং ২৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। বিপরীতে এ সময়ে শেয়ারবাজার থেকে আড়াইশ' কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করেছে যথাক্রমে ৬ হাজার ৭৬০ কোটি, ৮ হাজার ৭৪০ কোটি, ১৬ হাজার ৭৪০ কোটি, ২৯ হাজার ১৮০ কোটি, ৪৬ হাজার ৩৮০ কোটি এবং ৬২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। গত ৫ বছরে শিল্পে মেয়াদি ঋণ সরবরাহে প্রবৃদ্ধি যেখানে ১৬৮ শতাংশ, সেখানে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৩৪ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক সিইও সালাউদ্দিন আহমেদ খান এ তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিষয়ে বলেন, 'দেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের অবদান ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সরকারি ও নীতি-নির্ধারকরা শেয়ারবাজারের এ অবদান স্বীকার করছেন না।' তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'যারা নিজেদের নীতি-নির্ধারক বলে মনে করেন, সেসব ব্যক্তির অনেকেই অর্থনীতির পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন না।'
সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে অর্জন করতে প্রতি বছর অন্তত দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন_ এমন মন্তব্য করে সালাহউদ্দিন আহমেদ খান জানান, এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের মাত্র ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তারা জোগান দিতে সক্ষম। বাকি ৭০ শতাংশ বা ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার ওপর তারা ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, 'বাস্তবতা হলো- দেশের ব্যাংকিং খাত বছরে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ জোগানে সক্ষম। বাকি অর্থের জন্য শেয়ারবাজারের ওপরই নির্ভর করতে হবে। তবে তার জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন।' এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, এসইসির চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি শেয়ারবাজারকে অর্থনীতিতে অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান জেনে তিনি বলেন, 'এটা অত্যন্ত ভালো খবর যে, শেয়ারবাজারকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলাম, তেমন একটি রূপ পাচ্ছে।' তবে দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান যখন শেয়ারবাজারকে মূলধন সংগ্রহের প্রধান উৎস হিসেবে গ্রহণ করবে, তখনই শেয়ারবাজার তার পরিপূর্ণতা পাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, উন্নত দেশগুলো শিল্পায়নের জন্য শেয়ারবাজারের ওপরই নির্ভর করে। আমাদেরও সে পথে এগোতে হবে। শেয়ারবাজারকে অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংক থেকে শিল্পে সর্বোচ্চ ঋণ প্রদানের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। এতে ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি কমবে। পাশাপাশি শিল্পে উৎপাদন খরচ ও ব্যাংকের ওপর বিপুল ঋণ সরবরাহের চাপ কমবে।

No comments

Powered by Blogger.