বার্ষিক উৎপাদন প্রায় দুই কোটি পিস # অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার লেনদেন, দেশীয় লুঙ্গি হচ্ছে ব্র্যান্ড, যাচ্ছে বিদেশেও by শুভংকর কর্মকার
যুগ যুগ ধরে অধিকাংশ বাঙালি পুরুষের নিত্যদিনের অন্যতম পোশাক লুঙ্গি। সম্পূর্ণ দেশীয় উপকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে লুঙ্গির চাহিদার প্রায় পুরোটাই এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। দেশের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরামদায়ক এ পোশাকের বাজার প্রতিবছরই বাড়ছে। লুঙ্গি উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বর্তমানে লুঙ্গির দেশীয় চাহিদা বার্ষিক প্রায় দুই কোটি পিস।
তবে রমজান মাসে ঈদের আগে শুধু জাকাতের জন্যই এর চাহিদা অন্য মাসগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একসময় অল্পবিস্তর ও পরোক্ষভাবে লুঙ্গি রপ্তানি হলেও কয়েক বছর ধরে তা সরাসরি রপ্তানি করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। লুঙ্গি উৎপাদন ও ব্যবসার ওপর সুনির্দিষ্ট তথ্য-পরিসংখ্যান নেই বলে জানান ব্যবসায়ী ও উৎপাদকেরা। তবে তাঁদের প্রাক্কলন হলো, লুঙ্গি ব্যবসায় বছরে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা হাত বদল হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর একসময় কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর, দোহার, নবাবগঞ্জ ও শ্রীনগরের হস্তচালিত তাঁতের (হ্যান্ডলুম) তৈরি লুঙ্গি প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালিত তাঁতে (পাওয়ারলুম) লুঙ্গি তৈরি শুরু হয়। এতে উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বর্তমানে পাবনা, সিরাগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যন্ত্রচালিত তাঁতেই চাহিদার অধিকাংশ লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে।
সুতির চেক ও প্রিন্টের লুঙ্গির পাশাপাশি কারুকাজ করা জ্যাকেট লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে দেশে। এসব লুঙ্গি উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু স্থানীয়ভাবে, অর্থাৎ অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকে। তবে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাঁত মালিকদের কাছে কার্যাদেশ দিয়ে লুঙ্গি তৈরি করিয়ে আনে। তারপর এতে নিজেদের প্রতীক লাগিয়ে বাজারজাত করে।
লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বসে সিরাগঞ্জের শাহজাদপুর, নরসিংদীর বাবুরহাট ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। এখান থেকেই সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুুঙ্গি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।
দেড় যুগ আগেও স্থানীয়ভাবে নামে-বেনামে বিক্রি হতো লুঙ্গি। এখন বেশ কিছু লুঙ্গি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটাকে তাদের ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। বলা যায়, কয়েকটি ব্র্যান্ড নাম হয়ে গেছে। এসব ব্র্যান্ডের লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড, এটিএম ও অনুসন্ধান লুঙ্গি অন্যতম।
একাধিক লুঙ্গি ব্যবসায়ী দাবি করেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের লুঙ্গি বাংলাদেশেই তৈরি হয়। পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাদা লুঙ্গি একসময় ভারত থেকে আমদানি করা হতো। তবে এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশেই এ লুঙ্গি তৈরি করছেন উৎপাদকেরা, এমনকি তা ভারতেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন দেশের সরকার লুঙ্গি রপ্তানিতে ভর্তুকি দেয়। বাংলাদেশেও গত বিএনপি সরকারের সময় লুঙ্গি রপ্তানিতে ১০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হতো। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বন্ধ করে দেয়। বর্তমান মহাজোট সরকারও সেটি বন্ধ রেখেছে। তাঁরা অবশ্য এ-ও জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা।
দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও ফিলিপাইন, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, সিঙ্গাপুর ও জর্দানের বহু মানুষের নিত্যদিনের পোশাক লুঙ্গি। তবে সেসব দেশের লুঙ্গি গুণগত মান, ধরন ও নকশা বাংলাদেশি লুঙ্গির চেয়ে ভিন্ন। তার পরও ভিনদেশি লুঙ্গি তৈরি ও রপ্তানি করে সাফল্য দেখাচ্ছে একাধিক প্রতিষ্ঠান।
উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা বলেন, গত কয়েক বছরে সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম বেড়েছে। এতে লুঙ্গির উৎপাদন খরচ প্রকারভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
লুঙ্গির ব্র্যান্ড: ১৯৮৩ সাল থেকে হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স আমানত শাহ লুঙ্গি তৈরি করছে। তবে ১৯৯৩ সালে থেকে ট্রেডমার্ক লাইসেন্স নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড লুঙ্গির ব্র্যান্ডিং শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করলেও ২০০১ সাল থেকে রপ্তানিতে নামে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তারা দুবাই, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওমানে লুঙ্গি রপ্তানি করছে। গত অর্থবছরে প্রায় দুই লাখ পিস লুঙ্গি রপ্তানি করে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটি স্বত্বাধিকারী মো. হেলাল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দেশ ও বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের আমানত শাহ লুঙ্গি তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, নরসিংদীর রায়পুরা, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে স্থানীয় তাঁত ব্যবসায়ীদের কাছে কার্যাদেশ দিয়ে লুঙ্গি উৎপাদন হয়। পরে নিজস্ব কারখানায় ছাপ্পর দিয়ে মোড়কজাত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে মাসে প্রায় এক লাখ পিস লুঙ্গি তৈরি করছে। আর এতে কাজ করছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমানত শাহ লুঙ্গির পিসপ্রতি মূল্য ৬০ থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত হয়।
হেলাল মিয়া আরও বলেন, গুণগত মান ও নকশার কারণে বিদেশে বাংলাদেশি লুঙ্গির চাহিদা আছে। সরকার যদি রপ্তানিতে ভর্তুকি ও উৎপাদনে ব্যবহূত কেমিক্যাল শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা দেয়, তবে আরও বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব।
লুঙ্গি ব্যবসার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁরা একটি সমীক্ষা পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান হেলাল মিয়া। এটি সম্পন্ন হলে এ পণ্যের বাজার সম্পর্কে কিছু সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশের লুঙ্গি ব্যবসায় আরেক ব্র্যান্ড এটিএম লুঙ্গি। মানসম্মত লুঙ্গি উৎপাদন ও বিপণন করে স্থানীয় বাজারের বিশাল একটি অংশ দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও আফ্রিকায় রপ্তানি হচ্ছে এটিএম লুঙ্গি। প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন সহস্রাধিক কর্মী।
প্রায় ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করছে অনুসন্ধান লুঙ্গি। এখন বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পিস লুঙ্গি তৈরি করছে এ প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধান লুঙ্গি পিসপ্রতি ২২৫ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
মূলত দেশীয় মানুষের চাহিদার মেটাতে তৈরি হলেও দেশের বাইরেও যাচ্ছে অনুসন্ধান লুঙ্গি। বহু ক্ষেত্রে সরাসরি না হলেও প্রবাসী বাংলাদেশি ও অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনুসন্ধান লুঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হয়।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. ফারুক বলেন, ‘আমরা মূলত স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী লুঙ্গি তৈরি করি। বিদেশের বাজার পুরোপুরি ধরতে পারিনি। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে লুঙ্গি রপ্তানিতে সাফল্য দেখাচ্ছে।’
সিরাজগঞ্জের তাঁত: সারা দেশের প্রায় অর্ধেক তাঁতই সিরাজগঞ্জে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ এবং যন্ত্রচালিত তাঁত আছে দেড় লাখ। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুর থানা এলাকাতেই তাঁতের সংখ্যা বেশি। স্থানীয় প্রায় ৫০ লাখ লোক শিল্পটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। এখান থেকেই ব্র্যান্ড ও ব্র্যান্ডবিহীন লুঙ্গি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুযায়ী কার্যাদেশ দিয়ে লুঙ্গি তৈরি করায়।
প্রতি দুটি হস্তচালিত তাঁত চালাতে একজন লোক প্রয়োজন। আর প্রতিটি তাঁত দিয়ে সপ্তাহে প্রায় ৪০টি লুঙ্গি তৈরি করা সম্ভব। লুঙ্গিপ্রতি তাঁতিদের ২০ থেকে ২৫ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।
বেলকুচির তাঁত ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ আরও বলেন, ‘আগে ৪৫ হাজার টাকায় পাওয়ারলুম কিনেছি। গত কয়েক বছরে মেশিনের দাম প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁতের সংখ্যা বাড়াতে পারছেন না।’
আবদুল মজিদ জানান, মাত্র ২০ ভাগ ব্যবসায়ী ব্যাংকঋণ পান। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ-প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন। এটা করা হলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।
জেলার তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি হায়দার আলী জানান, তাঁত মালিকেরা সরকারি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। পাঁচ বছর আগে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র তাঁতিদের জন্য ঋণের সুবিধা থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ।
হায়দার আলী আরও বলেন, মৌসুমে তাঁতিদের ব্যবসা কিছুটা চললেও অন্য সময়ে ক্ষুদ্র তাঁত মালিকদের দাদনের শরণাপন্ন হতে হয়। জীবনের তাগিদে ব্যবসায়ীরা দাদন বাবদ টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে বাধ্য হন। এতে লাভ তো দূরের কথা, লোকসানের দিকেই যেতে হয়।
বেলকুচি উপজেলার একটি গ্রাম তামাই। এখানেই প্রায় ৪০০ ব্যবসায়ীর ১০ হাজার তাঁত আছে, যার ৯৫ শতাংশ তাঁতেই লুঙ্গি তৈরি করা হয়।
এসব তথ্য দিয়ে গ্রামটির অন্যতম ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান বলেন, তাঁত বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুনজর ও বড় উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে এই খাতটির প্রসার সম্ভব।
তাঁত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তুলা থেকে তৈরি সুতার সঙ্গে কৃত্রিম সুতা ব্যবহার করতে হবে। এর সঙ্গে পাটের সুতার ব্যবহার বাড়াতে হবে। শুধু তুলার সুতায় উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়। তাঁত মালিকেরাও লাভবান হতে পারেন না।
ডিসেন্ট লুঙ্গির স্বত্বাধিকারী আবদুর রহিম সাগর প্রথম আলোকে অভিযোগ করে বলেন, দেশের স্পিনিং মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো সুতার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে তাঁতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই সরকার যদি সুতার দাম নির্ধারণ করে দেয়, তবে অবস্থার উন্নতি হবে।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক এনামুল হক, সিরাজগঞ্জ)
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর একসময় কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর, দোহার, নবাবগঞ্জ ও শ্রীনগরের হস্তচালিত তাঁতের (হ্যান্ডলুম) তৈরি লুঙ্গি প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালিত তাঁতে (পাওয়ারলুম) লুঙ্গি তৈরি শুরু হয়। এতে উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বর্তমানে পাবনা, সিরাগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যন্ত্রচালিত তাঁতেই চাহিদার অধিকাংশ লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে।
সুতির চেক ও প্রিন্টের লুঙ্গির পাশাপাশি কারুকাজ করা জ্যাকেট লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে দেশে। এসব লুঙ্গি উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু স্থানীয়ভাবে, অর্থাৎ অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকে। তবে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাঁত মালিকদের কাছে কার্যাদেশ দিয়ে লুঙ্গি তৈরি করিয়ে আনে। তারপর এতে নিজেদের প্রতীক লাগিয়ে বাজারজাত করে।
লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বসে সিরাগঞ্জের শাহজাদপুর, নরসিংদীর বাবুরহাট ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। এখান থেকেই সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুুঙ্গি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।
দেড় যুগ আগেও স্থানীয়ভাবে নামে-বেনামে বিক্রি হতো লুঙ্গি। এখন বেশ কিছু লুঙ্গি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটাকে তাদের ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। বলা যায়, কয়েকটি ব্র্যান্ড নাম হয়ে গেছে। এসব ব্র্যান্ডের লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড, এটিএম ও অনুসন্ধান লুঙ্গি অন্যতম।
একাধিক লুঙ্গি ব্যবসায়ী দাবি করেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের লুঙ্গি বাংলাদেশেই তৈরি হয়। পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাদা লুঙ্গি একসময় ভারত থেকে আমদানি করা হতো। তবে এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশেই এ লুঙ্গি তৈরি করছেন উৎপাদকেরা, এমনকি তা ভারতেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন দেশের সরকার লুঙ্গি রপ্তানিতে ভর্তুকি দেয়। বাংলাদেশেও গত বিএনপি সরকারের সময় লুঙ্গি রপ্তানিতে ১০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হতো। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বন্ধ করে দেয়। বর্তমান মহাজোট সরকারও সেটি বন্ধ রেখেছে। তাঁরা অবশ্য এ-ও জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা।
দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও ফিলিপাইন, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, সিঙ্গাপুর ও জর্দানের বহু মানুষের নিত্যদিনের পোশাক লুঙ্গি। তবে সেসব দেশের লুঙ্গি গুণগত মান, ধরন ও নকশা বাংলাদেশি লুঙ্গির চেয়ে ভিন্ন। তার পরও ভিনদেশি লুঙ্গি তৈরি ও রপ্তানি করে সাফল্য দেখাচ্ছে একাধিক প্রতিষ্ঠান।
উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা বলেন, গত কয়েক বছরে সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম বেড়েছে। এতে লুঙ্গির উৎপাদন খরচ প্রকারভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
লুঙ্গির ব্র্যান্ড: ১৯৮৩ সাল থেকে হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স আমানত শাহ লুঙ্গি তৈরি করছে। তবে ১৯৯৩ সালে থেকে ট্রেডমার্ক লাইসেন্স নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড লুঙ্গির ব্র্যান্ডিং শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করলেও ২০০১ সাল থেকে রপ্তানিতে নামে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তারা দুবাই, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওমানে লুঙ্গি রপ্তানি করছে। গত অর্থবছরে প্রায় দুই লাখ পিস লুঙ্গি রপ্তানি করে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটি স্বত্বাধিকারী মো. হেলাল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দেশ ও বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের আমানত শাহ লুঙ্গি তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, নরসিংদীর রায়পুরা, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে স্থানীয় তাঁত ব্যবসায়ীদের কাছে কার্যাদেশ দিয়ে লুঙ্গি উৎপাদন হয়। পরে নিজস্ব কারখানায় ছাপ্পর দিয়ে মোড়কজাত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে মাসে প্রায় এক লাখ পিস লুঙ্গি তৈরি করছে। আর এতে কাজ করছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমানত শাহ লুঙ্গির পিসপ্রতি মূল্য ৬০ থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত হয়।
হেলাল মিয়া আরও বলেন, গুণগত মান ও নকশার কারণে বিদেশে বাংলাদেশি লুঙ্গির চাহিদা আছে। সরকার যদি রপ্তানিতে ভর্তুকি ও উৎপাদনে ব্যবহূত কেমিক্যাল শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা দেয়, তবে আরও বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব।
লুঙ্গি ব্যবসার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁরা একটি সমীক্ষা পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান হেলাল মিয়া। এটি সম্পন্ন হলে এ পণ্যের বাজার সম্পর্কে কিছু সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশের লুঙ্গি ব্যবসায় আরেক ব্র্যান্ড এটিএম লুঙ্গি। মানসম্মত লুঙ্গি উৎপাদন ও বিপণন করে স্থানীয় বাজারের বিশাল একটি অংশ দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও আফ্রিকায় রপ্তানি হচ্ছে এটিএম লুঙ্গি। প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন সহস্রাধিক কর্মী।
প্রায় ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করছে অনুসন্ধান লুঙ্গি। এখন বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পিস লুঙ্গি তৈরি করছে এ প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধান লুঙ্গি পিসপ্রতি ২২৫ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
মূলত দেশীয় মানুষের চাহিদার মেটাতে তৈরি হলেও দেশের বাইরেও যাচ্ছে অনুসন্ধান লুঙ্গি। বহু ক্ষেত্রে সরাসরি না হলেও প্রবাসী বাংলাদেশি ও অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনুসন্ধান লুঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হয়।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. ফারুক বলেন, ‘আমরা মূলত স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী লুঙ্গি তৈরি করি। বিদেশের বাজার পুরোপুরি ধরতে পারিনি। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে লুঙ্গি রপ্তানিতে সাফল্য দেখাচ্ছে।’
সিরাজগঞ্জের তাঁত: সারা দেশের প্রায় অর্ধেক তাঁতই সিরাজগঞ্জে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ এবং যন্ত্রচালিত তাঁত আছে দেড় লাখ। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুর থানা এলাকাতেই তাঁতের সংখ্যা বেশি। স্থানীয় প্রায় ৫০ লাখ লোক শিল্পটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। এখান থেকেই ব্র্যান্ড ও ব্র্যান্ডবিহীন লুঙ্গি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুযায়ী কার্যাদেশ দিয়ে লুঙ্গি তৈরি করায়।
প্রতি দুটি হস্তচালিত তাঁত চালাতে একজন লোক প্রয়োজন। আর প্রতিটি তাঁত দিয়ে সপ্তাহে প্রায় ৪০টি লুঙ্গি তৈরি করা সম্ভব। লুঙ্গিপ্রতি তাঁতিদের ২০ থেকে ২৫ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।
বেলকুচির তাঁত ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ আরও বলেন, ‘আগে ৪৫ হাজার টাকায় পাওয়ারলুম কিনেছি। গত কয়েক বছরে মেশিনের দাম প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁতের সংখ্যা বাড়াতে পারছেন না।’
আবদুল মজিদ জানান, মাত্র ২০ ভাগ ব্যবসায়ী ব্যাংকঋণ পান। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ-প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন। এটা করা হলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।
জেলার তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি হায়দার আলী জানান, তাঁত মালিকেরা সরকারি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। পাঁচ বছর আগে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র তাঁতিদের জন্য ঋণের সুবিধা থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ।
হায়দার আলী আরও বলেন, মৌসুমে তাঁতিদের ব্যবসা কিছুটা চললেও অন্য সময়ে ক্ষুদ্র তাঁত মালিকদের দাদনের শরণাপন্ন হতে হয়। জীবনের তাগিদে ব্যবসায়ীরা দাদন বাবদ টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে বাধ্য হন। এতে লাভ তো দূরের কথা, লোকসানের দিকেই যেতে হয়।
বেলকুচি উপজেলার একটি গ্রাম তামাই। এখানেই প্রায় ৪০০ ব্যবসায়ীর ১০ হাজার তাঁত আছে, যার ৯৫ শতাংশ তাঁতেই লুঙ্গি তৈরি করা হয়।
এসব তথ্য দিয়ে গ্রামটির অন্যতম ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান বলেন, তাঁত বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুনজর ও বড় উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে এই খাতটির প্রসার সম্ভব।
তাঁত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তুলা থেকে তৈরি সুতার সঙ্গে কৃত্রিম সুতা ব্যবহার করতে হবে। এর সঙ্গে পাটের সুতার ব্যবহার বাড়াতে হবে। শুধু তুলার সুতায় উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়। তাঁত মালিকেরাও লাভবান হতে পারেন না।
ডিসেন্ট লুঙ্গির স্বত্বাধিকারী আবদুর রহিম সাগর প্রথম আলোকে অভিযোগ করে বলেন, দেশের স্পিনিং মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো সুতার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে তাঁতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই সরকার যদি সুতার দাম নির্ধারণ করে দেয়, তবে অবস্থার উন্নতি হবে।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক এনামুল হক, সিরাজগঞ্জ)
No comments