অভিজাত গুলশানের গ্রাম কড়াইল বস্তি- পর্ব ১ by মনোয়ারুল ইসলাম
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের উক্তি ‘ঈশ্বর থাকেন ঐখানে, ওই ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ লিখেছিলেন পদ্মাতীরবর্তী গ্রামের জেলে ও মাঝিদের নিয়ে। কিন্ত খোদ রাজধানীতেও একথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। পার্থক্য একটাই--এটি খোদ রাজধানীর মধ্যে। খেটে খাওয়া এই মানুষগুলো গুলশান লেকে নৌকা চালিয়ে জীবন চালায়, আর থাকে কড়াইল বস্তিতে।
এখানকার মাঝিদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের জীবনের নানা কথা। বর্তমানে প্রায় ৯০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত এই বস্তি। পিডব্লিউডি, বিটিসিএল ও বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বস্তির জমির মালিক। প্রায় ৫০ হাজারের মতো মানুষের এই বসতী সংকীর্ণ আর ভাঙাচোড়া রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয়। চিপা গলি দিয়ে বস্তিতে ঢুকে দেখা যাবে ঘিঞ্জি পরিবেশ। টিনের আর কাঠের ঘর। এর মধ্যে একতলা ও দোতলা বাড়ি। খুপড়ির মতো ছোট ছোট ঘরে আট-দশজনের মতো মানুষ থাকে। এখানে ঘুমানোর জায়গা ছাড়া কোন অংশ ফাঁকা থাকে না। দিনের বেলা বিছানা গোটানো থাকে। ঘরের আকারভেদে ভাড়া ১২ শ থেকে ২ হাজার টাকা। স্বাস্থ্যকর পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। এনজিওদের স্কুল আর স্বাস্থকেন্দ্রই একমাত্র নাগরিক সুবিধা।
গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার খুব কাছেই বাস করেও বিষন্ন বিবর্ণ দারিদ্রক্লিষ্ট তাদের জীবন। অথচ এখান থেকে লেক পার হলেই রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান। সেখানে উপচে পড়ছে বিত্তবানদের ভোগের পেয়ালা, অন্যদিকে বন্যা খরা জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে গ্রামে পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে করাইল বস্তিতে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলো অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতেও তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না মোটেই। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকার।
রাজধানীতে এখনও বেশ কিছু এলাকায় নৌকায় পারাপার চলে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে নৌকাকেন্দ্রিক একাধিক পেশা। কড়াইল বস্তি যেন রাজধানীর মধ্যে এক চিলতে নদীতীরের গ্রাম। গুলশান-বনানী আর মহাখালী এলাকার মাঝখানে গড়ে ওঠা কড়াইল বস্তিতে গেলে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। রাজধানীর দরিদ্র মানুষ, ড্রাইভার, গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রিকশাওয়ালাসহ কায়িক শ্রমজীবীদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এ বস্তিটি।
বৃহস্পতিবার কড়াইল বস্তির কাছে গিয়ে দেখা যায় গুলশান লেকের ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। নিচে কুচকুচে কালো পচা পানি। পানির দুর্গন্ধে বিষিয়ে ওঠা বাতাস। অগত্যা নাক চেপেই নৌকায় উঠছেন মানুষজন। মহাখালী মোড় থেকে গুলশান এক নম্বরে যাওয়ার পথে রাস্তার বাঁয়েই এই কড়াইল খেয়াঘাট। আবার মহাখালী টিঅ্যান্ডটি কলোনি হয়ে রিকশা, সিএনজি বা মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যায়। তবে রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় বড় গাড়ি সেখানে যায় না। আগুন যদি আগুন লাগে তাহলে এই সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে যে দমকলের গাড়ি যাবে সে আশা গুড়েবালি। চোখের সামনে পুড়ে গোটা বস্তি পুড়ে ছাই হবে--এটাই নিয়তি।
গুলশান-বনানী লেক তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে এই কড়াইল বস্তিকে। টিঅ্যান্ডটি কলোনি পার হয়ে বস্তির মধ্য দিয়ে বেলতলা গলি ধরে পশ্চিম দিকে ঘুরে মূল সড়কে উঠতে সময় লাগে আধা ঘণ্টারও বেশি। অথচ নৌকায় মাত্র ৫ মিনিটেই পৌঁছানো যায় গুলশান সড়কে। বস্তিবাসী নৌকায় চলাচল করেন। শুধু বস্তির নিম্নবিত্ত মানুষই নন, মধ্যবিত্ত মানুষজনও নৌকায় চড়েন সময় ও যাতায়াত খরচ বাঁচাতে। শখ করে নৌকা নিয়ে গুলশান লেকে ঘুরে বেড়ানো মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
মাঝিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে শতাধিক মাঝি আছেন পারাপারের কাজে। মাঝিদের সহকারি আছেন ২০-৩০ জন। সহকারিরা বেশিরভাগই অল্প বয়সী। যাদের এখন স্কুল যাবার কথা। কিন্ত টানাটানির সংসারে অভাবের তাড়নায় এই শিশুদের এখানে কাজ করতে হয়। ঘাটে সকালে ও সন্ধ্যায় যাত্রীদের ভীড় লেগে থাকে। তবে দিনের অন্য সময়ে তেমন একটা ভিড় থাকে না। পারাপার চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।
এখানে বর্তমানে নৌকা রয়েছে ১০ টিরও কম। তবে এই মাঝিরা এসব নৌকার মালিক নন। দিন-চুক্তিতে ভাড়ায় চালাতে হয় । গড়ে প্রতিদিন ঘাট দিয়ে পারাপার হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার যাত্রী। তবে পুরো দিনের জন্য নৌকা জোটে না এদের কপালে। ফিরতি বেলায় নৌকা পেতে কাউকে কাউকে অলস বসে কাটাতে হয় পুরো এক বা দেড় দিন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল - মনু, রহমান , আকবর, পনির, মিলন, আমিনুল, হরিদাস, শ্য্মালমাঝি রয়েছেন ঘাটে। দু একটি নৌকা ভাড়া পেলেও তাদেরে অলস সময় কাটছে । কারণ দুপুরে যাত্রীদের ভীড় থাকে না। অন্যদিকে নৌকা জোটে মাত্র একবেলা। আরেক বেলা ডাঙ্গায়। জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ২টাকা। নৌকার ভাড়া মিটিয়ে মাত্র দেড়শ -দু’শ টাকায় সংসার চলে না। নৌকা ও সিজনভেদে ভাড়াও বিভিন্ন রকম। সর্বসাকুল্যে আয় হয় ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। নৌকার মালিককে দিতে হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বাকি যে টাকা থাকে তা দিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার যেন আর চলতে চায় না।
শুধুমাত্র নিজের ও পরিবারের পেটের ভাত জোটাতেই নৌকা চালানোর এই পেশা আঁকড়ে আছেন তারা। তবে কেউ কেউ গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসে কোনো কাজ না পেয়ে মাঝি হয়েছেন গুলশান খেয়াঘাটে। এখানে অনেকেই জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন। অনেক শিক্ষিত মানুষ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের দিন বদলের কথা বলেছেন কিন্তু দিন বদলের ছোঁয়া তাদের জীবনে একদমই লাগেনি।
ভোলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চন্দ্রপ্রসাদ গ্রামে বাল্যকাল থেকে নৌকা চালাতেন আলিম উদ্দিন। ঢাকায় এসও একই পেশায় আছেন।
তার মতে, ’ভোটের সময় নেতারা যখন আসেন তখন তাদের গালভরা কথায় বুক ভরে যায়। ভোট শেষে আর কেউই আর বস্তির পথ মাড়ায় না।’
কুড়িগ্রামের জেলার উলিপুরের ফকিরপাড়া গ্রামের নয়ন ১০ বছর আগে ঢাকা এসেছিলেন কাজের খোঁজে। অন্য কাজ না পেয়ে তার আগে ঢাকায় আসা তার বড়ভাইয়ের পেশা নৌকা চালানোর কাজে লেগে যান। সেই থেকে চলছে জীবনের সঙ্গে ওৎপ্রোত হয়ে গেছে নৌকা চালানোর কঠিন পেশা। তিনি বলেন, ‘অনেক বছরইতো দেখলাম। আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। সরকার আমাদের জন্য কোন কিছু করার কথাও চিন্তা করে না। অল্প কামাই দিয়া তো ছাওয়াপোয়ার ( ছেলেমেয়ের) লেখাপড়া করানোর ক্ষমতা নাই। বস্তিতে ভাড়ায় থাকি। একটাকাও জমা হয় না। মেয়ে বড় হইলি বিয়া দেব কিভাবে সেই চিন্তায় দিন যায়।’
কড়াইল বস্তির স্থায়ী প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২৪-২৫ বছর আগে যখন জঙ্গল পরিষ্কার করে বস্তি গড়ে ওঠে তখন থেকেই গুলশান লেক পারাপারের জন্য শুরু হয় নৌকার ব্যবহার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বস্তির মানুষ বেড়েছে, পারাপারের যাত্রী বেড়েছে, বেড়েছে নৌকা। দেশে চোখের সামনে কত পরিবর্তনই না হয়েছে কিন্ত তাদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয়নি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আ. ফ. ম. আবদুল আলিম নকী বাংলানিউজকে বলেন, ’আমি কড়াইল বস্তিবাসীর সুখে-দুখে পাশে থাকি। কড়াইল বস্তি ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের বাস করে। এদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত। অতি গরিব কিছু মানুষ ঘাটে নৌকা পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই নৌকা ঘাটে কোনো টোল নেওয়া হয় না।’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার সাধ্যের মধ্যে করার চেষ্টা করি। এত অভাবের মধ্যেও এখানকার ছেলেমেয়েরা এনজিওদের স্কুলে পড়ছে। তারাও শিক্ষার কিছুটা আলো পাচ্ছে। বস্তিবাসীদের লেখাপড়ার কিছুটা আলো পাওয়া সন্তানরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। এদের সহযোগিতার জন্য বিত্তশালীদের এগিয়ে আসা উচিত।’
No comments