প্রবাসী আয় যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে-* বাড়ছে জমির দাম * দেশে ফিরে বেকার প্রবাসীরা by রাজীব আহমেদ ও শেখ শাফায়াত হোসেন

রিশালের উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা কুয়েত প্রবাসী নজরুল ইসলামের পরিবারে আগে গরু ছিল। সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষ করতেন। কেরোসিন তেল, ভোজ্য তেল, লবণসহ আরো কয়েকটি পণ্য শুধু সাপ্তাহিক হাটের দিন কেনা হতো। মাছ অথবা মাংস কেনা হতো কালেভদ্রে। বাকি সব কিছুই প্রায় নিজেদের জমিতে উৎপাদিত হতো। অথবা বাড়ির অন্যদের কাছে পণ্য বিনিময় করে সংগ্রহ করা হতো সংসারের প্রয়োজনীয় উপকরণ।


কিন্তু এখন ওই পরিবারের কোনো গরু নেই। জমি বর্গা দেওয়া। সবজি, মাছসহ প্রায় সব কিছুই এখন কেনা হয় বাজার থেকে। বাড়িতে দুটো টেলিভিশন। একটি ফ্রিজ। তবে দুয়েকটি হাঁস-মুরগি এখনো আছে। সেগুলো থেকে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ডিম পাওয়া যায়। গত প্রায় সাত বছরে নজরুল দেশে যে টাকা পাঠিয়েছেন, সংসারের খরচ বাদে বাকি টাকা ব্যয় হয়েছে জমি কেনার পেছনে। তিনি গ্রামে থেকেও বরিশাল শহরে জমি কিনেছেন। বাড়ির পাশেও কিছু জমি কিনেছেন। নজরুল ইসলামের মতো প্রবাসীদের জমি কেনার কারণে ওই এলাকায় জমির দাম কয়েক বছরেই দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় প্রবাসীদের পাঠানো টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে স্থায়ী সম্পত্তিতে। আর এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আছে জমি। প্রবাসীদের 'কাঁচা' টাকার কারণে গ্রামে জমির দাম কয়েক বছরেই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অর্থের প্রবাহ বেশি থাকায় এসব পরিবারের চাহিদার তুলনায় পণ্যের উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে গ্রামে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। পাশাপাশি দেশে কোনো বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় দেশে ফিরে প্রবাসীরা কোনো কাজ করতে পারছেন না। ফলে দীর্ঘদিন বিদেশে কাটানোর পরে কেউ ইচ্ছে থাকলেও দেশে এসে স্থায়ী হতে পারছেন না। কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে আয়বর্ধক কাজে যুক্ত হচ্ছেন। তবে তা উৎপাদনে নয়, ব্যবসায়। তাদের বেশির ভাগ দোকান কেনা বা অন্য কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছেন।
দেশে ফেরা প্রবাসীদের টাকা উৎপাদনশীল খাতে নিতে সরকারেরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। যে ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের টাকা দেশে এনে পরিবারের সদস্যদের হাতে পেঁৗছে দিচ্ছে, তাদেরও কোনো পরামর্শ সেবা নেই। ফলে প্রবাসী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা যে যেখানে ভালো মনে করছেন, সেখানেই বিনিয়োগ করছেন।
জমি ও বাড়ির পেছনেই বেশি ব্যয় : বরিশালের উজিরপুর থানার কালিহাতা গ্রামের জমির বড় ক্রেতা প্রবাসীরা। কেউ বিক্রি করতে চাইলে জমির ক্রেতার অভাব হয় না। ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে দামও হয় লাগামছাড়া। সাত-আট বছর আগেও ওই গ্রামে যেসব জমির বিঘাপ্রতি দাম ছিল এক-দেড় লাখ টাকা, এখন সেটা তিন-সাড়ে তিন লাখ টাকা।
সম্প্রতি ওই গ্রামের একটি ছোট বাজারে মাছের দোকানে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল ইলিশ মাছ। গ্রামে এত দামে মাছ কে কিনবে, জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, 'বাজারে এখন ইতালিয়ান টাকা। কেনার লোকের অভাব নেই।'
জমি ও পণ্য কেনার এ প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, গ্রামে মূল্যস্ফীতি কেন শহরের সঙ্গে প্রায় সমান তালে বাড়ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, অক্টোবর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১.৪২ শতাংশে। শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতির হার ১২.৪৭ শতাংশ, যেখানে গ্রামে এই হার হয়েছে ১১.৮৫ শতাংশ। শহরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১৪.৮৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই উপখাতে মূল্যস্ফীতির হার ১১.৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিও একই রকম। অক্টোবর মাসে শহরে ৯.১৭ শতাংশ আর গ্রামে ৯.০৫ শতাংশ।
২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)র জেনেভা সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত ড. তাসনীম সিদ্দিকীর এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রবাসীরা তাঁদের পাঠানো টাকার ২৬.২৬ শতাংশ ব্যয় করেন জমি কেনা ও বাড়ি নির্মাণের পেছনে। অন্যদিকে মাত্র ৪.৭৬ শতাংশ ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়। এরপর তাঁদের হাতে সঞ্চয় থাকে ৩.০৭ শতাংশ। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর তাঁর আরেকটি গবেষণায়ও দেখা যায়, জমি কেনা ও বাড়ি করার পেছনেই শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেন।
কালিহাতা গ্রামের সচ্ছল কৃষক মোশারফ হোসেন বলেন, 'এখন মানুষের হাতে প্রচুর টাকা। আমাদের গ্রামের জমিতে ফসল খুব বেশি ভালো হয় না। কৃষিকাজ করে খুব বেশি লাভবান হওয়ারও সুযোগ নেই। তার পরও জমির দাম বেড়েই চলছে। কারণ সবাই জমি কিনতে চায়।'
জমি কেনা ছাড়াও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে প্রচুর ব্যয় করেন প্রবাসীরা। খাদ্য ও পোশাক কিনতেও তাঁদের অনেক ব্যয় করতে দেখা যায়। ড. তাসনীম সিদ্দিকীর গবেষণা অনুযায়ী, খাদ্য ও পোশাক কিনতে প্রবাসীদের পরিবারগুলো ২০.৪৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করে। আর সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যয় হয় প্রায় ৯ শতাংশ অর্থ।
খুলনা জেলার দৌলতপুর থানার দেয়ানা গ্রামে বাস করছেন আবু বক্কর সিদ্দিক। চার সন্তানের জনক আবু বক্কর ইতিমধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ধার-দেনা করে দুই ছেলেকে পাঠিয়েছেন সিঙ্গাপুর। বড় ছেলে রবিউল ইসলাম এক বছর ধরে কাজ করছেন সেখানকার একটি আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠানে। ছোট ছেলে রকিবুল ইসলাম কাজ করছেন একটি ইমারত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে দুই ছেলের প্রবাসী আয় দিয়েই তাঁর সংসার চলছে।
বছরদুয়েক আগে নিজ বাড়িতে গাভি পালন করতেন আবু বক্কর। গাভির দুধ বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটাতেন তিনি। এখন আর গাভি পালন করছেন না। ছেলেদের পাঠানো টাকা দিয়েই ধার-দেনা শোধ করেছেন। বাড়িঘর ঠিক করিয়েছেন। সংসার খরচের পর বাড়তি টাকা জমিয়ে রাখছেন ব্যাংকে। ভাবছেন, বাজারে একটি বড় দোকান কিনে ব্যবসা শুরু করবেন। ছেলেরা দেশে ফিরে সেই ব্যবসা দেখাশোনা করবে। ছেলেদের বাকি জীবন এতেই চলে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।
দেশে ফিরে করার থাকে না কিছুই : নজরুল ইসলামের সংসার এখন ভালোই চলছে। অভাব ঘুচিয়ে তিনি এখন সচ্ছল। কিন্তু দুশ্চিন্তা তাঁর পিছু ছাড়ছে না। তিন মাসের জন্য দেশে এসে কিছুদিন আগে তিনি আবার কুয়েত গিয়েছেন। এবার তিন বছরের জন্য মা, সন্তান, অনাগত আরেকটি সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে বিদেশে যেতে তাঁর মন চাইছিল না। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, দেশে থেকে তিনি কি করবেন?
একই গ্রামের মোবারক হোসেন প্রায় ১২ বছর আগে দেশে ফিরেছেন। এরপর আর বিদেশে যাননি। বিদেশ থেকে নিয়ে আসা টাকায় শহর ও গ্রাম মিলিয়ে তিনি দুটি বাড়ি ও প্রচুর জমি কিনেছিলেন। গত কয়েক বছরে সেই জমি ও বাড়ির বেশির ভাগ বিক্রি করে দিয়েছেন। দেশে এসে তিনি আয়বর্ধক কিছু করবেন অথবা কোন জায়গায় নিজের টাকা বিনিয়োগ করবেন_এমন সুযোগ করতে পারেননি।
রবিউল ও রকিবুল নামের প্রবাসী দুই সন্তানের বাবা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'ছেলেরা দেশের তুলনায় বিদেশে ভালোই আছে। ছেলেরা দেশে থেকে করবে কি? দেশে কাজ নেই, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ নেই। বাজে সঙ্গে পড়ে বেকার ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে ছেলেরা কাজ করছে, টাকা রোজগার করছে, এই তো ভালো।'
রবিউল ও রকিবুলের মতো এই গ্রামের অনেক তরুণ ও যুবক কাজ করতে গেছেন বিদেশে। গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি দুই-চার পরিবারের মধ্যে এক পরিবারের এক বা একাধিক কর্মক্ষম পুরুষ বিদেশে রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। এমনই এক যুবক শেখ আবদুল্লাহ। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। ভিসার মেয়াদ শেষে ফিরে এসেছেন দেশে। দেশে করার কিছু না পেয়ে আবারও ভিসার জন্য চেষ্টা করছেন তিনি।
আবদুল্লাহ জানান, এ গ্রামের অনেক যুবক বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছেন। কেউ কেউ ১০ থেকে ১২ বছর বিদেশে থেকে ফিরে এসেছেন দেশে। জমানো টাকা দিয়ে অনেকেই বাড়ি তৈরি করেছেন, ফ্রিজ-টেলিভিশন, মোটরসাইকেল কিনেছেন। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। কেউ বাজারে দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন, কেউ ছোটখাটো কৃষি বা পোলট্রি খামার করার চেষ্টা করছেন। তবে বড় কোনো উদ্যোগ গ্রহণের দক্ষতা নেই তাঁদের।
বিনিয়োগে পরামর্শ বা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেই : প্রবাস থেকে ফেরা বাংলাদেশিদের বেশির ভাগের হাতে নগদ টাকা থাকে। মাসের পর মাস তাঁরা ওই টাকা ভেঙে ভেঙে খান। একসময় টাকা শেষ হয়ে যায়। হতাশা নেমে আসে তাঁদের মনে। তখন আবারও তাঁরা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালনসহ নানা উৎপাদনশীল কাজে বিদেশফেরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব। কারণ, তাঁদের পরিশ্রমের মানসিকতা থাকে, পাশাপাশি তাঁদের হাতে মূলধন হিসাবে নগদ টাকাও থাকে। কিন্তু দেশেফেরত প্রবাসীদের চিহ্নিত করে তাঁদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ বর্তমানে নেই বলে জানা গেছে।
তবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি প্রকল্প ছিল ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের। 'রেমিট্যান্স পেমেন্ট চ্যালেঞ্জ ফান্ড'র আওতায় পরিচালিত 'এলাকাভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোগ উন্নয়ন ও রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহারের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন' শীর্ষক ওই প্রকল্পে বিদেশফেরতদের বিভিন্ন উৎপাদনশীল কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। কিন্তু ডিএফআইডির অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার পর ওই প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গেছে।
২০০৬-০৯ সাল পর্যন্ত ওই প্রকল্পের আওতায় মোট ছয় হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ভালুকায় দুই হাজার ৪৬০ জন, ত্রিশালে ৬০০ জন, ফুলবাড়িয়ার এক হাজার ২০ জন, সখীপুরের ৩৯০ জন, ময়মনসিংহ সদরের ৬২০ জন, ভূঁয়াপুরের ৬৫০ জন ও শেরপুরের ২৬০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ডিএফআইডির অর্থায়ন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সরকার আর প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে চালু রাখেনি।

No comments

Powered by Blogger.