কালের কণ্ঠকে ড. আকবর আলি খান-পরিস্থিতি ওয়ান-ইলেভেনের চেয়েও খারাপ হতে পারে-তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে গোপন সংলাপের তাগিদ by আশরাফুল হক রাজীব
আবারও ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা ঘটলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। দুই দলের রাজনৈতিক অনুসারীদের কারণে গৃহযুদ্ধও শুরু হতে পারে। তবে ভালো পরিস্থিতিরও সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর জন্য দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা। আশা ও আশঙ্কার এ কথাগুলো বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দুই দল গোপন
সংলাপে বসে দেখতে পারে। তাঁর মতে, প্রকাশ্যে সংলাপ হলে তাতে সাফল্য আসে না। তিনি আরো বলেছেন, পৃথিবীর যত বড় পণ্ডিতই আসুক না কেন, লাভ হবে না। সমস্যার সমাধান স্থানীয় রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে।
অসাংবিধানিক হলেও আরো দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পরামর্শ দেন সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি মনে করেন, টেকনোক্রেট কোটায় ১০ শতাংশ মন্ত্রী নিয়োগ, সংসদে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণসহ সংবিধানের অনেক বিষয়ই এর মূল চেতনার পরিপন্থী। দেশের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে কোনো আইনগত সমস্যা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার আকবর আলি খান নিজ বাসায় কালের কণ্ঠের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব এবং এই পরিস্থিতির সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। আলাপচারিতার মূল অংশ তুলে ধরা হলো।
কালের কণ্ঠ : সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে। বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাহলে কি দেশ অনিবার্য সংকটের দিকে যাচ্ছে?
আকবর আলি খান : উচ্চ আদালতের রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমরা এখনো পাইনি। রায়ের যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেটি হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেহেতু অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাই সেটা অগণতান্ত্রিক ও শাসনতন্ত্রসম্মত নয়। আদালতের এই সিদ্ধান্তের যথেষ্ট শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে মহামান্য আদালত দুটি বিষয় স্বীকার করেন। তার একটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। আদালত নির্বাচনগুলোকে বৈধ বলেই স্বীকার করে নিয়েছেন। আদালত যে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বলেছেন সেটা হচ্ছে, সংসদ চাইলে আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এখনই তুলে দিতে হবে_এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না। আদালতের রায়ের পর সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে দেয়। এর ফলে ১৯৯৬ সালে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি অকার্যকর হয়ে পড়ল। এ কথা সত্য যে তত্ত্বাবধয়ক সরকারব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু রাখতে গেলে সেগুলো সংশোধন করা দরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেওয়ার আগে সরকারের উচিত ছিল সব দলের সঙ্গে আলোচনা করা। তত্ত্বাবধায়কের বদলে যে ব্যবস্থা চালু হবে সেই ব্যবস্থা যেন সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তার চেষ্টাও সরকারের করা উচিত ছিল। কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর ফলে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল আমরা হয়তো সে ধরনের পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারি।
০ আপনি বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। তাহলে এর বিকল্প কী হতে পারে?
০০ সংবিধানে অনেক বিধান আছে, যেগুলো সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। সেই বিধানগুলোকে সাধারণত নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য করা হয়। যেমন মহিলাদের জন্য যে সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা পুরোপুরিভাবে সংবিধানসম্মত না। তাঁরা সরাসরি নির্বাচন করতে পারেন। আবার তাঁদের জন্য সংরক্ষিত আসনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। সংবিধানে যে কোটা পদ্ধতি রয়েছে সেটাও মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সব দেশেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে তা মানা হয় না। আমাদের দেশের সংবিধানে আরো একটি বিধান আছে যেটা অগণতান্ত্রিক। সেটা হলো শতকরা ১০ ভাগ পদে অনির্বাচিত মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার বিধান। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগণতান্ত্রিক হয় তাহলে ১০ শতাংশ মন্ত্রীর বিধানও অগণতান্ত্রিক। ভারতের সংবিধানে এ ধরনের বিধান নেই। এসব বিষয়ের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও চালু থাকতে পারে। এতে অলঙ্ঘনীয় কোনো আইনগত সমস্যা নেই।
০ পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে অনেকেই আরেকটি ওয়ান ইলেভেনের আশঙ্কা করছেন।
০০ আমরা আরেকটা ওয়ান ইলেভেনের দিকে যাচ্ছি_এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত না। আমরা ওয়ান ইলেভেনের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থার দিকে যেমন যেতে পারি, ভালো অবস্থার দিকেও যেতে পারি। ইতিহাসে কখনো হুবহু ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় না। কাজেই অবস্থা ওয়ান ইলেভেনের চেয়েও খারাপ হতে পারে। আমরা আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার মতো রাজনৈতিক শূন্যতার দিকে যেতে পারি। দেশে গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত হতে পারে। আবার ভালো অবস্থা যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমস্যা সম্পর্কে উপলব্ধি তৈরি হওয়া। তত্ত্বাবধায়কের কাঠামোর মধ্যে অথবা এর বাইরে গিয়েও সমস্যার সমাধান হতে পারে।
০ সমাধানটা কী হতে পারে?
০০ রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে অনেক সমাধান হতে পারে। জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে একধরনের সমাধান হতে পারে। আমরা তত্ত্বাবধায়কের বিধান তুলে দিয়ে ভারতের মতো বিধান করতে পারি। ভারতের সংবিধানে যে ব্যবস্থা আছে সেটা হলো, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে অনির্বাচিত ব্যক্তিকেও প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন। ছয় মাসের মধ্যে যদি তাঁরা নির্বাচিত না হন তাহলে তাঁদের পদ চলে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের বিধান সংযোজন করা হলে রাষ্ট্রপতি যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে সরকার গঠন করতে পারবেন। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম না দিয়েও সরকার গঠন করা যাবে। তাদের মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যেতে পারে। আমি মনে করি না, কোনো আদালত ভারতের সংবিধানে যে বিধান আছে তাকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিতে পারে। এ ছাড়া দলগুলো নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে একমত হলেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। অনেকে মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমস্যাটা শাসনতান্ত্রিক, কিন্তু আমি মনে করি এটা রাজনৈতিক সমস্যা। তাই সমাধান প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতাদেরই করতে হবে।
০ ১৯৯৬ সালে এ ধরনের সংকটের সময় কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার নিনিয়ান এসেছিলেন। এখানে কি জাতিসংঘ বা অন্য কোনো পক্ষ মধ্যস্থতা করতে পারে?
০০ কারিগরি পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান আসবে না। পৃথিবীর যত বড় পণ্ডিতই নিয়ে আসেন না কেন, তাঁরা সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো সমস্যার সমাধান করতে চাইলেই তা সম্ভব। এ জন্য তাদের মধ্যে বিহাইন্ড দ্য সিন (নেপথ্যে) আলাপ-আলোচনা শুরু করা দরকার। কারণ, প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করলে দলগুলো একটা বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের পক্ষে কোনো আপস করা সম্ভব হয় না। নেপথ্যে করতে হবে আরো একটি করণে, সেটা হচ্ছে, বড় দুটি রাজনৈতিক দলের বিশাল কর্মী বাহিনী রয়েছে। তাদের সামনে কোনো স্ট্যান্ড নিলে সরে আসা যায় না। আবদুল জলিল ও মান্নান ভূঁইয়ার এভাবে সংলাপে বসা ঠিক হয়নি।
০ নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করে কি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব?
০০ বিতর্কিত ব্যক্তিদের দ্বারা কমিশন করে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার আগে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন করতে হবে। কমিশনার হিসেবে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যারা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ভারতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়নি। কমিশনই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে এবং নির্বাচন সুুষ্ঠু করেছে। সমস্যটা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা নয়। সমস্যা হলো গ্রহণযোগ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা।
০ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপের বিষয়ে আলোচনার সময় বিএনপি সংসদে যায়নি। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
০০ শুধু সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে নয়, বিএনপি ক্রমাগতভাবে সংসদ বর্জন করে চলছে। এটা আসলে গণতন্ত্রের রীতিনীতি বিরুদ্ধ। তাদের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব সংসদে যাওয়া ও নিজ বক্তব্য তুলে ধরা। সংসদ বর্জন করা বিএনপির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
০ আপনাকে ধন্যবাদ।
০০ কালের কণ্ঠ ও তার পাঠকদেরও ধন্যবাদ।
No comments