দুই নেতার রশি টানাটানি

কজনের পরিচয় জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান। অপর জনের পরিচয় তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আস্থাভাজন। তাঁর নাম মীর শাহে আলম। এ কারণেই উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বহিষ্কারের পরও নির্বাচন শেষে ফের বিএনপিতে ফিরেছেন দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে। আর অন্যজন হলেন বগুড়া-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান। উপজেলা বিএনপির


সভাপতিসহ বিএনপির একটি বড় অংশ বর্তমান এমপির সঙ্গে থাকলেও রাজনীতির মাঠে তিনি শাহে আলমের বিরুদ্ধে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। আর এই দুই শীর্ষ নেতার প্রভাবের বলি হচ্ছেন সাধারণ নেতা-কর্মীরা। এক পক্ষের বিরুদ্ধে অন্য পক্ষের অভিযোগ, মামলা, হামলা, বহিষ্কার_এসব নিয়েই চলছে শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মকাণ্ড।
বিএনপির মাঠের রাজনীতি কিভাবে চলছে? একাধিক নেতা-কর্মী এভাবেই জানালেন তাঁদের প্রতিক্রিয়া, গত ১ জুলাই শিবগঞ্জে বিএনপিদলীয় এমপির নামে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া টেস্ট রিলিফ (টিআর) প্রকল্পের নগদ অর্থ ও বিলের সাড়ে ১২ লাখ টাকা যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী ছিনতাই করে নেন। এরই প্রতিবাদে মোকামতলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপিরই কয়েকজন নেতা-কর্মী। এই ছিল তাঁদের অপরাধ। এরপর ইউনিয়ন বিএনপির পাঁচ নেতাকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি (বহিষ্কার) দেওয়া হয়। অব্যাহতি প্রাপ্তরা হলেন শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য আবদুল ওহাব, রফিকুল ইসলাম, জাহেদুল ইসলাম, মোকামতলা ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য আবদুল লতিফ ও কিচক ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য নবাব আলী মণ্ডল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমানের একজন অনুসারী জানান, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মীর শাহে আলম এবং পৌর বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান মতিনের ইন্ধনে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কতিপয় নেতা-কর্মী এমপির বরাদ্দের সাড়ে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এই অভিযোগে ওই পাঁচ বিএনপি নেতা ও প্রকল্প সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলন করার অপরাধেই তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। শিবগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি এ বি এম কামাল সেলিম এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'আমার সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলেই তাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এটি দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। সব কিছুই এককভাবে করা হয়েছে।
সংসদ সদস্য হাফিজুর এবং মীর শাহে আলমের দ্বন্দ্ব কেন? মাঠের একাধিক নেতা এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে জানান, মূলত শিবগঞ্জ উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম হাফিজুর রহমান এবং উপজেলা চেয়ারম্যান মীর শাহে আলমের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। এই দুই নেতা এক অপরের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় বিএনপির একটি সূত্র জানায়, গত উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন মতিয়ার রহমান মতিন। কিন্তু বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মীর শাহে আলম জয়লাভ করেন। এরপর থেকেই দলে প্রভাববিস্তারকে কেন্দ্র করে সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিএনপির দুর্গখ্যাত এ উপজেলায় বিএনপির মনোনয়ন পেলে জয়লাভ সহজ হবে_এমন আশা নিয়ে মাঠ পর্যায়ের বিএনপি নেতারা মনোনয়ন লাভে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তাঁরা বিভক্ত বিএনপির যেকোনো এক পক্ষ থেকে সমর্থন নিয়ে নিজেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালান। এই পরিস্থিতির পর এখন পুরো দলের মধ্যেই বিভাজন আরো স্পষ্ট হয়েছে। উপজেলা ছাত্রদল ও যুবদলের একটি বড় অংশ মীর শাহে আলমের পক্ষে। এ কারণে স্থানীয়ভাবে প্রভাব তাঁরই বেশি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে থানা বিএনপির সম্মেলন হলেও দ্বন্দ্বের কারণে ১৪ মাসে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। এর পেছনে এলাকার দুই নেতার হাত রয়েছে এমন অভিযোগ উঠলেও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মীর শাহে আলম জানান, জেলা কমিটিই এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। জেলা কমিটি উপজেলা কমিটি পাস করবে। এ কারণেই দীর্ঘদিন ঝুলে আছে উপজেলা কমিটি। এমপি হাফিজুরের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এমপি সাহেব মনে করেন আগামীতে আমিই হব এমপি প্রার্থী। এ কারণে তিনি এখন আমাকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। আসলে এই সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই।' তিনি জানান, এলাকার টিআর, কাবিখা, জেলা পরিষদের বরাদ্দ নিয়ে তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেন না। তাঁর অনুগত লোক দিয়ে গোপনে কাজ করানোর চেষ্টা করেন। এটা জানতে পেরেই বিরোধিতা করেন সাধারণ নেতা-কর্মীরা।
সংসদ সদস্য এ কে এম হাফিজুর রহমান পবিত্র হজ পালনের জন্য দেশের বাইরে থাকায় এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। তবে তাঁর অনুগত উপজেলা বিএনপির সভাপতি এ বি এম কামাল সেলিম জানান, তাঁর সঙ্গে কারো কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব রয়েছে এমপি হাফিজুরের সঙ্গে পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান মতিন ও মীর শাহে আলমের। এর কারণ ভাগবাটোয়ারা। তিনি জানান, এমপি সাহেব তাঁর বরাদ্দ অংশ দিয়ে কিভাবে কাজ করবেন সেটা সবাইকে নিয়েই আলোচনা করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ সব কিছুই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এটা সম্ভব না হওয়ায়ই পক্ষ-বিপক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। নিজের ভূমিকা প্রসঙ্গে সেলিম জানান, বেগম খালেদা জিয়ার মনোনীত হয়ে যিনি এমপি হয়েছেন বিএনপির সভাপতি হিসেবে তিনি তাঁর পক্ষেই কাজ করছেন। এতে দোষের কিছু নেই।

No comments

Powered by Blogger.