আওয়ামী লীগ : বগুড়া-২, শিবগঞ্জ-যেন দুই সতিনের ঘর by লিমন বাসার
মূল দ্বন্দ্বটি আসলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে। তাঁরা দুজনই ব্যস্ত নিজেদের প্রভাব বিস্তারে। আর এতেই অচলাবস্থা পুরো দলের। সাধারণ নেতা-কর্মীরাও ভুগছেন ঠিক এই একটি কারণেই। দলে নেই কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা। সব মিলিয়ে এক 'হ-য-র-ব-ল' অবস্থা জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এতেই শেষ নয়, গত সাড়ে সাত বছর ধরে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দিয়েই চলছে উপজেলা কমিটি।
দুইজনের দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম ঘোষণা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ নেতা-কর্মীরা। আর দলের পক্ষ থেকে এখন দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডও পালন করা হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসের জাতীয় কর্মসূচিও শিবগঞ্জে পালন করা হয়নি।
২০০৪ সালের ৯ জুলাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি পদে সৈয়দ মির্জারুল আলম চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক পদে আজিজুল হক নির্বাচিত হন। তখন থেকেই মূলত এই দুজনের দ্বন্দ্ব শুরু। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই দুই নেতার টানাপড়েন আরো বেড়ে যায়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয় যে, এই দুই নেতার মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁদের দ্বন্দ্ব থামাতে স্থানীয় প্রশাসনকে ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি করতে হয়েছে। একপক্ষের লোকজন হামলা করছে অন্যপক্ষের ওপর। আবার প্রতিবাদ সভা-মিছিল করছে পরস্পরবিরোধী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, এভাবে একটি সংগঠন চলতে পারে না। দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের কারণে দলের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নেতা-কর্মীরা হয়ে পড়ছেন অসহায়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মী আরেফিন হক আফতাব জানান, দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ। কমিটি হলে সভাপতি-সম্পাদকের চাঁদাবাজির ভাগ কমে যাবে, তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের জবাবদিহিতা করতে হবে, তাই তারা চান না, পূর্ণাঙ্গ কমিটি হোক। তাই জেলার দুজন শীর্ষ নেতার মদদে তাঁরা একলা চলার নীতিতে লুটপাট ও চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। দলের ব্যাপারে তাদের কোনো মনোযোগ নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, গত ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। জাতীয় এই দিবসে শিবগঞ্জে দলীয় কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। সভাপতি ও সম্পাদককে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তাঁরা জানান, দিবসটির কথা তাঁদের মনে নেই।
শিবগঞ্জের সৈয়দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফিজার রহমান বলেন, 'আমরা যাঁরা ইউনিয়নের নেতা, তাঁরা পড়েছি মহাঝামেলায়। সভাপতি ও সম্পাদক_দুজন দুই ধারার মানুষ। তাঁদের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে মাঠে সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের জবাবদিহিতা করতে হয়। লজ্জায় আমরা মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না।' তিনি আরো বলেন, '১৯৬৯ সালের গণঅন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করছি। আর এখন আমরা দলের জন্য বোঝা। এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে দল ডুবতে বসেছে।' গত সংসদ নির্বাচনে শিবগঞ্জের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'শুধু সভাপতি-সম্পাদকের কারণে আমরা কাঙ্ক্ষিত ভোট পাইনি। এবার তো ভোটের জন্য মানুষের কাছে যাওয়াই যাবে না। ভোটের বদলে তারা হাতে মুলা ঝুলিয়ে দেবে।'
উপজেলার বুড়িগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুল ইসলাম জানান, অবিলম্বে নতুন কমিটি করে এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো দরকার। নতুন কমিটি ছাড়া কোনোভাবেই বর্তমান সঙ্কট মিটবে না। তিনি আরো জানান, নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিতে এখন সংকোচবোধ হয়। মানুষ এখন নানা কথা বলে টিপ্পনী কাটতে শুরু করেছে। সংকট রোধ করতে তাঁরা সভাপতি ও সম্পাদককে এক কাতারে আনার জন্য বহুবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থার ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক জানান, যোগ্য নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। জেলা কমিটি থেকে তাগাদাও দেওয়া হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার জন্য। কিন্তু উপজেলা সভাপতি এ ব্যাপারে অনীহা প্রকাশের কারণেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে। সভাপতি-সম্পাদকের বিরোধের কারণে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না? জানতে চাইলে আজিজুল হক জানান, যেকোনো দলের জন্যই এটা ক্ষতিকর। এসব কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে তিনি এককভাবে দায়ী নন। তিনি এখনো রাজি আছেন দ্বন্দ্ব নিরসনের। সম্ভব হচ্ছে না শুধু সভাপতির কারণে। তবে নিজের বিরুদ্ধে সভাপতির করা বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, সভাপতিই একাধিক অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত; তিনি নন।
সভাপতি সৈয়দ মির্জারুল আলম চৌধুরী জানান, কোনোদিন আওয়ামী লীগ করেনি এমন লোকদের সাধারণ সম্পাদক পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে জেলা কমিটির কাছে উপজেলা কমিটির তালিকা দেওয়ায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হচ্ছে না। তিনি অভিযোগ করেন, সাধারণ সম্পাদক তাঁর অনুগত লোকদের নিয়ে এলাকায় ফেনসিডিল ও চোরাচালান ব্যবসা পরিচালিত করছেন। এসব ব্যাপারে বাধা দিতে গেলেই তাঁর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। সাধারণ সম্পাদকের মতোই তিনিও জানান, দ্বন্দ্ব নিরসনে তিনি রাজি আছেন। কিন্তু কেন যেন তা সম্ভব হচ্ছে না।
শিবগঞ্জের মূল দল আওয়ামী লীগের মতোই বেহাল অবস্থা সহযোগী সংগঠনগুলোর। ছয় বছর আগে কৃষক লীগ, সাত বছর আগে ছাত্রলীগ, ৯ বছর আগে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক কমিটি হয়। কিন্তু আজও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। আর মহিলা আওয়ামী লীগের এক যুগ আগে কমিটি হয়েছিল। বর্তমানে সবাই নিষ্ক্রিয়। শ্রমিক লীগের কোনো কমিটিই নেই। এসব দলের নেতা-কর্মীরা যে যাঁর মতো চলছেন। দলীয় কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আর তাই সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও চরম হতাশা বিরাজ করছে।
No comments