সংসদে অনাগ্রহী মন্ত্রীরা by সজল জাহিদ
জাতীয় সংসদে মন্ত্রীদের উপস্থিতি চোখেই পড়ছে না। প্রথম দিকে উপস্থিতির হিসাব সমৃদ্ধ থাকলেও দিন দিন মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি বাড়ছে। গত অধিবেশন চলাকালে সাংসদদের কথা শোনার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে কারণে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র সাংসদরাও এ বিষয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি সংসদে উপস্থিতি নিশ্চিত করার দায়িত্ব চিফ হুইপ এবং হুইপদের ওপর থাকলেও তাদের অনুপস্থিতিও চোখে পড়ছে। এক হুইপ তো মোট কার্যদিবসের এক-চতুর্থাংশ দিনও অধিবেশনে আসেননি।
অন্যদিকে মন্ত্রী-হুইপ-প্রতিমন্ত্রীদের অনুপস্থিতির হিসাব যাতে সাংবাদিকদের হাতে না যায় সে বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। স্পিকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকেও কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দল দিনকয়েক আগে এমন তালিকা চাইলে প্রথমে ডেপুটি স্পিকার জানান, স্পিকারের অনুমোদন ছাড়া এটি দেওয়া অসম্ভব। গতকাল স্পিকার ফাইলে লিখেছেন, পরে এটি সরবরাহ করা হবে। এ প্রেক্ষাপটে টানা ২৩ দিন মুলতবির পর আজ রোববার বিকেল সোয়া ৪টায় একাদশ অধিবেশনের বৈঠক বসছে। আগের সমালোচনার কারণে আজ মন্ত্রী এবং অন্যান্য সাংসদের উপস্থিতি বেশি থাকবে বলেই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৭ অক্টোবর সংসদ অধিবেশনে মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি বিষয়ে সরকারি দলের সিনিয়র সাংসদরা সমালোচনা করেন। তোফায়েল আহমেদ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আরও কয়েকজন বলেন, কেবল প্রধানমন্ত্রী সংসদে থাকলেই মন্ত্রীরা সংসদে থাকেন। এ সময় স্পিকারের আসনে থাকা সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুও কঠোর
সমালোচনা করেন। ওই দিন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি তার পক্ষে প্রশ্নোত্তর দেওয়ার দুই বিকল্প মন্ত্রীও অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে ওই মন্ত্রণালয়ের সব প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়। অথচ অন্যান্য প্রশ্নোত্তর তখনও চলছিল। সংসদ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদের চার দশকের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। মন্ত্রীর অনুপস্থিতির পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সংসদে না থাকার বিষয়ে কড়া সমালোচনা করেন সাংসদরা।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম দশটি অধিবেশনের ২৪১ কার্যদিবসে মন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে কম উপস্থিতি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। তিনি মাত্র ৭১ কার্যদিবস সংসদে ছিলেন। তাছাড়া এমন মন্ত্রীও পাওয়া গেছে, যারা এক অধিবেশনে একদিনও সংসদে আসেননি। দ্বিতীয় অধিবেশনে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু একদিনও সংসদে ছিলেন না। যদিও তার সামগ্রিক উপস্থিতি খুব কম নয়, ১৩০ কার্যদিবস। তাছাড়া স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সপ্তম অধিবেশনের সব দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তবে উপস্থিতি বিষয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, মন্ত্রীরা সংসদে এসে বসে থাকবেন সেটি হওয়ার নয়। তাদের বাইরেও অনেক রাষ্ট্রীয় কাজ রয়েছে।
সাংসদ-মন্ত্রীদের অধিবেশনে আনার দায়িত্ব হুইপদের থাকলেও মির্জা আজম নিজেই সংসদে থেকেছেন মাত্র ৭৩ কার্যদিবস। অথচ ঢাকা বিভাগের সাংসদদের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। একই পথে রয়েছেন খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও। তার উপস্থিতি ৮৪ কার্যদিবস। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার ৮৫ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। টানা বিদেশে থাকলেও দফতরবিহীন প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ ৮৪ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের উপস্থিতি ৮৮ কার্যদিবস। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ১০৯ কার্যদিবস, সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ ১১৬ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। শ্রম এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১২৩ কার্যদিবসে সংসদে এসেছেন। এরপরেই থাকা যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার ১৩০ কার্যদিবস সংসদে আসেন। সংসদে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়া যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের উপস্থিতি সন্তোষজনক। ১৮৬ কার্যদিবসে সংসদে এসেছেন তিনি। তবে তার পাশের সংসদীয় আসনের নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ১৪০ কার্যদিবসের বেশি সংসদে আসেননি।
দেশের চেয়ে অধিকাংশ সময় বিদেশে বিদেশে কাটানো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১৪২ কার্যদিবসে সংসদে থেকেছেন। হাজিরা খাতায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্বাক্ষর পাওয়া গেছে সংসদের ১৪৩ কার্যদিবসের। তাছাড়া শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ১৫১ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হককে সংসদে পাওয়া গেছে ১৫২ কার্যদিবসে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৫৪ কার্যদিবসে সংসদে থেকেছেন। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুবুর রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে ১৫৮ দিন। আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৬১ কার্যদিবস, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন ১৬৪ কার্যদিবস, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস ১৮৮ কার্যদিবস, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়া ১৯১ কার্যদিবস এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৫ কার্যদিবস সংসদে ছিলেন। মন্ত্রীদের উপস্থিতির তালিকায় সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে ২০৯ কার্যদিবস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২০০ কার্যদিবসে সংসদে থেকেছেন। নবম অধিবেশন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এসেছেন ১৭১ কার্যদিবস।
মন্ত্রীদের এ পারফম্যান্সের সামনে চিফ হুইপসহ অন্য হুইপদের উপস্থিতি কমই মনে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, হুইপদের প্রধান কাজই সংসদ পরিচালনায় স্পিকারকে সহায়তা করা। সেখানে তাদের উপস্থিতি আরও সন্তোষজনক হওয়া প্রয়োজন ছিল। চিফ হুইপ আবদুস শহীদ ২০৫ কার্যদিবস সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া হুইপ মুজিবুল হক ২২৪, আ স ম ফিরোজ ২০৭ এবং নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন ১৮৬ কার্যদিবস সংসদের অধিবেশন কক্ষে যোগ দেন।
সবচেয়ে কম উপস্থিতি : টানা সংসদ বর্জন করায় সবচেয়ে কম উপস্থিতির হিসেবে বিরোধী দলই এগিয়ে। নেতৃত্বে রয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, মাত্র ৬ কার্যদিবস। একই দলের কাজী শাহ্ মোফাজ্জাল হোসাইন কায়কোবাদ ১১ কার্যদিবস সংসদে এসেছেন। বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ ১৫ কার্যদিবস এবং মোশাররফ হোসেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বরকত উল্লা বুলু যথাক্রমে ১৮ কার্যদিবস করে সংসদে আসেন। তবে চারদলীয় জোটের বাইরে সবচেয়ে কম সংসদে এসেছেন রওশন এরশাদ ৪৩ কার্যদিবস। বিকল্প ধারার অলি আহমদ ৬৫, আওয়ামী লীগের চয়ন ইসলাম ৬৭, শেখ হেলাল ৭৭, এম আবদুল লতিফ ৮৮, নাজমুল আহসান পাপন ৮৯ এবং এইচ এম এরশাদ ১১২ কার্যদিবস সংসদে ছিলেন।
মন্ত্রী-সাংসদদের উপস্থিতি অনুপস্থিতির বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, বিরোধী দল যেখানে টানা সংসদ বর্জন করছে সেখানে সরকারি দলের মন্ত্রীরাও সংসদে না থাকলে সংসদের কার্যক্ষমতা কমে আসে। বর্তমান সংসদ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
সংসদের চিঠি : সংসদ চলাকালে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যাতে সংসদে এসে সাংসদদের বক্তব্যের নোট নেন সে জন্য জাতীয় সংসদ থেকে সব মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়। ১০ নভেম্বর সংসদের ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠি সব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের কাউন্সিলর অফিসারদের প্রশিক্ষণও দেয় সংসদ সচিবালয়। এখন থেকে মন্ত্রণালয়ের কাউন্সিল অফিসাররা প্রতিদিন সংসদ গ্যালারিতে থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতির রেকর্ড নেবেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়ে সাংসদদের বক্তব্যও রেকর্ড করবেন তারা।
সংসদ সচিবালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, মন্ত্রী যদি কোনো কারণে সংসদে উপস্থিত না থাকতে পারেন তাহলে অন্তত একদিন আগে লিখিতভাবে সংসদকে জানাতে হবে যে তার পক্ষে কোন মন্ত্রী প্রশ্নোত্তর বা নোটিশের জবাব দেবেন। চিঠির কথা স্বীকার করলেও ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান বলেন, মন্ত্রীদের সংসদে উপস্থিত করার দায়িত্ব আমাদের নয়। এটি তার এখতিয়ারের অনেক বাইরে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আর চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ বলেন, সংসদের পক্ষ থেকে দেওয়া এ চিঠিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, মন্ত্রীদের সংসদের বাইরে দায়িত্ব থাকলেই কেবল তারা সংসদে অনুপস্থিত থাকেন। বাকি সময় মন্ত্রীদের সংসদে পাওয়া যায় বলেও দাবি করেন তিনি।
নতুন উদ্যোগ : বর্তমানে সাংসদ এবং মন্ত্রীদের অনেকে সংসদে এলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বাক্ষর করতে ভুলে যান বলে জানিয়েছে সূত্র। অনেকে আবার একদিনে কয়েক দিনের স্বাক্ষরও করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ স্বাক্ষর করেই সংসদ ত্যাগ করেন। এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে অধিবেশন কক্ষের সব দরজায় বিশেষ যন্ত্রচালিত দরজা বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যাতে করে সহজেই জানা যাবে কে কখন অধিবেশন কক্ষে ঢুকেছেন বা বেরিয়ে গেছেন।
গত ২৭ অক্টোবর সংসদ অধিবেশনে মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি বিষয়ে সরকারি দলের সিনিয়র সাংসদরা সমালোচনা করেন। তোফায়েল আহমেদ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আরও কয়েকজন বলেন, কেবল প্রধানমন্ত্রী সংসদে থাকলেই মন্ত্রীরা সংসদে থাকেন। এ সময় স্পিকারের আসনে থাকা সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুও কঠোর
সমালোচনা করেন। ওই দিন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি তার পক্ষে প্রশ্নোত্তর দেওয়ার দুই বিকল্প মন্ত্রীও অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে ওই মন্ত্রণালয়ের সব প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়। অথচ অন্যান্য প্রশ্নোত্তর তখনও চলছিল। সংসদ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদের চার দশকের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। মন্ত্রীর অনুপস্থিতির পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সংসদে না থাকার বিষয়ে কড়া সমালোচনা করেন সাংসদরা।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম দশটি অধিবেশনের ২৪১ কার্যদিবসে মন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে কম উপস্থিতি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। তিনি মাত্র ৭১ কার্যদিবস সংসদে ছিলেন। তাছাড়া এমন মন্ত্রীও পাওয়া গেছে, যারা এক অধিবেশনে একদিনও সংসদে আসেননি। দ্বিতীয় অধিবেশনে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু একদিনও সংসদে ছিলেন না। যদিও তার সামগ্রিক উপস্থিতি খুব কম নয়, ১৩০ কার্যদিবস। তাছাড়া স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সপ্তম অধিবেশনের সব দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তবে উপস্থিতি বিষয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, মন্ত্রীরা সংসদে এসে বসে থাকবেন সেটি হওয়ার নয়। তাদের বাইরেও অনেক রাষ্ট্রীয় কাজ রয়েছে।
সাংসদ-মন্ত্রীদের অধিবেশনে আনার দায়িত্ব হুইপদের থাকলেও মির্জা আজম নিজেই সংসদে থেকেছেন মাত্র ৭৩ কার্যদিবস। অথচ ঢাকা বিভাগের সাংসদদের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। একই পথে রয়েছেন খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও। তার উপস্থিতি ৮৪ কার্যদিবস। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার ৮৫ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। টানা বিদেশে থাকলেও দফতরবিহীন প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ ৮৪ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের উপস্থিতি ৮৮ কার্যদিবস। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ১০৯ কার্যদিবস, সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ ১১৬ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। শ্রম এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১২৩ কার্যদিবসে সংসদে এসেছেন। এরপরেই থাকা যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার ১৩০ কার্যদিবস সংসদে আসেন। সংসদে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়া যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের উপস্থিতি সন্তোষজনক। ১৮৬ কার্যদিবসে সংসদে এসেছেন তিনি। তবে তার পাশের সংসদীয় আসনের নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ১৪০ কার্যদিবসের বেশি সংসদে আসেননি।
দেশের চেয়ে অধিকাংশ সময় বিদেশে বিদেশে কাটানো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১৪২ কার্যদিবসে সংসদে থেকেছেন। হাজিরা খাতায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্বাক্ষর পাওয়া গেছে সংসদের ১৪৩ কার্যদিবসের। তাছাড়া শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ১৫১ কার্যদিবস সংসদে থেকেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হককে সংসদে পাওয়া গেছে ১৫২ কার্যদিবসে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৫৪ কার্যদিবসে সংসদে থেকেছেন। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুবুর রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে ১৫৮ দিন। আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৬১ কার্যদিবস, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন ১৬৪ কার্যদিবস, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস ১৮৮ কার্যদিবস, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়া ১৯১ কার্যদিবস এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৫ কার্যদিবস সংসদে ছিলেন। মন্ত্রীদের উপস্থিতির তালিকায় সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে ২০৯ কার্যদিবস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২০০ কার্যদিবসে সংসদে থেকেছেন। নবম অধিবেশন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এসেছেন ১৭১ কার্যদিবস।
মন্ত্রীদের এ পারফম্যান্সের সামনে চিফ হুইপসহ অন্য হুইপদের উপস্থিতি কমই মনে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, হুইপদের প্রধান কাজই সংসদ পরিচালনায় স্পিকারকে সহায়তা করা। সেখানে তাদের উপস্থিতি আরও সন্তোষজনক হওয়া প্রয়োজন ছিল। চিফ হুইপ আবদুস শহীদ ২০৫ কার্যদিবস সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া হুইপ মুজিবুল হক ২২৪, আ স ম ফিরোজ ২০৭ এবং নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন ১৮৬ কার্যদিবস সংসদের অধিবেশন কক্ষে যোগ দেন।
সবচেয়ে কম উপস্থিতি : টানা সংসদ বর্জন করায় সবচেয়ে কম উপস্থিতির হিসেবে বিরোধী দলই এগিয়ে। নেতৃত্বে রয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, মাত্র ৬ কার্যদিবস। একই দলের কাজী শাহ্ মোফাজ্জাল হোসাইন কায়কোবাদ ১১ কার্যদিবস সংসদে এসেছেন। বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ ১৫ কার্যদিবস এবং মোশাররফ হোসেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বরকত উল্লা বুলু যথাক্রমে ১৮ কার্যদিবস করে সংসদে আসেন। তবে চারদলীয় জোটের বাইরে সবচেয়ে কম সংসদে এসেছেন রওশন এরশাদ ৪৩ কার্যদিবস। বিকল্প ধারার অলি আহমদ ৬৫, আওয়ামী লীগের চয়ন ইসলাম ৬৭, শেখ হেলাল ৭৭, এম আবদুল লতিফ ৮৮, নাজমুল আহসান পাপন ৮৯ এবং এইচ এম এরশাদ ১১২ কার্যদিবস সংসদে ছিলেন।
মন্ত্রী-সাংসদদের উপস্থিতি অনুপস্থিতির বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, বিরোধী দল যেখানে টানা সংসদ বর্জন করছে সেখানে সরকারি দলের মন্ত্রীরাও সংসদে না থাকলে সংসদের কার্যক্ষমতা কমে আসে। বর্তমান সংসদ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
সংসদের চিঠি : সংসদ চলাকালে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যাতে সংসদে এসে সাংসদদের বক্তব্যের নোট নেন সে জন্য জাতীয় সংসদ থেকে সব মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়। ১০ নভেম্বর সংসদের ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠি সব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের কাউন্সিলর অফিসারদের প্রশিক্ষণও দেয় সংসদ সচিবালয়। এখন থেকে মন্ত্রণালয়ের কাউন্সিল অফিসাররা প্রতিদিন সংসদ গ্যালারিতে থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতির রেকর্ড নেবেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়ে সাংসদদের বক্তব্যও রেকর্ড করবেন তারা।
সংসদ সচিবালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, মন্ত্রী যদি কোনো কারণে সংসদে উপস্থিত না থাকতে পারেন তাহলে অন্তত একদিন আগে লিখিতভাবে সংসদকে জানাতে হবে যে তার পক্ষে কোন মন্ত্রী প্রশ্নোত্তর বা নোটিশের জবাব দেবেন। চিঠির কথা স্বীকার করলেও ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান বলেন, মন্ত্রীদের সংসদে উপস্থিত করার দায়িত্ব আমাদের নয়। এটি তার এখতিয়ারের অনেক বাইরে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আর চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ বলেন, সংসদের পক্ষ থেকে দেওয়া এ চিঠিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, মন্ত্রীদের সংসদের বাইরে দায়িত্ব থাকলেই কেবল তারা সংসদে অনুপস্থিত থাকেন। বাকি সময় মন্ত্রীদের সংসদে পাওয়া যায় বলেও দাবি করেন তিনি।
নতুন উদ্যোগ : বর্তমানে সাংসদ এবং মন্ত্রীদের অনেকে সংসদে এলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বাক্ষর করতে ভুলে যান বলে জানিয়েছে সূত্র। অনেকে আবার একদিনে কয়েক দিনের স্বাক্ষরও করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ স্বাক্ষর করেই সংসদ ত্যাগ করেন। এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে অধিবেশন কক্ষের সব দরজায় বিশেষ যন্ত্রচালিত দরজা বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যাতে করে সহজেই জানা যাবে কে কখন অধিবেশন কক্ষে ঢুকেছেন বা বেরিয়ে গেছেন।
No comments