তিউনিসিয়ার নির্বাচন ও 'আরব বসন্তের' ভবিষ্যৎ by ড. তারেক শামসুর রেহমান
গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ তিউনিসিয়ার এক বেকার কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট মোহাম্মদ বওকুজিজি নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে যে 'বিপ্লবের' সূচনা করেছিলেন, তার সফল সমাপ্তি ঘটেছে ২৩ অক্টোবর ২০১১ একটি সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক তিউনিসিয়া পুনর্গঠনে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়ায় একটি জাতীয় পরিষদ গঠিত হবে, যারা দেশটির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে। একই সঙ্গে
জাতীয় পরিষদ দেশটির জন্য একজন প্রেসিডেন্ট ও একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবে। সংবিধান রচিত হওয়ার পর আগামী বছর সেখানে আবার নির্বাচন হবে।
গত বছর যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তিউনিসিয়ায়, তা আরব বিশ্বে এক গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিল, যাকে বলা হচ্ছে 'আরব বসন্ত', অনেকটা সাবেক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে সংঘটিত হওয়া 'প্রাগ বসন্ত'-এর সঙ্গে যার তুলনা করা যায়। ১৯৬৮ সালের 'প্রাগ বসন্ত' ছিল সাবেক সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক বড় প্রতিবাদ। আর 'আরব বসন্ত' অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এক প্রতিবাদ। পার্থক্য হচ্ছে এক জায়গায়_'প্রাগ বসন্ত' সফল হয়নি। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তন আসেনি। এসেছিল অনেক পরে, ১৯৮৯ সালে। কিন্তু 'আরব বসন্ত' পরিবর্তন আনছে। ইতিমধ্যে তিউনিসিয়ায় বেন আলীর ২৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। মিসরে ৩০ বছরের একদলীয় শাসনের অবসান হয়েছে। হোসনি মুবারক এখন ইতিহাসের অংশ, দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর এখন বিচার হচ্ছে। কিন্তু লিবিয়ায় পরিবর্তনটা এসেছে ভিন্নভাবে। সেখানে তিউনিসিয়া কিংবা মিসরের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। বিদেশি শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপ গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। গাদ্দাফি নিজের জীবন দিয়ে বৈদেশিক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে গেলেন। ইয়েমেন আর সিরিয়ায়ও 'আরব বসন্ত'-এর ঢেউ লেগেছে। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ আর সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যে বিষয়টি বড় বেশি করে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে_'আরব বসন্ত' কী ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে পুরো আরব বিশ্বে? কোন শক্তি এখানে ক্ষমতাসীন হচ্ছে? এসব দেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকাই বা কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। বলতে দ্বিধা নেই, পুরো আরব বিশ্বে যে ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু ছিল, তাকে কোনো মতেই গণতন্ত্রসম্মত বলা যাবে না। তিউনিসিয়ায় ব্যক্তি বেন আলী ও তাঁর পরিবার ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। Democratic Constitutional Rally নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে বেন আলী ২৩ বছর ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। মিসরেও একই ধারা আমরা প্রত্যক্ষ করি।
অতিসম্প্রতি তিউনিসিয়ার নির্বাচনের পর সেখানে নতুন এক রাজনৈতিক ধারার জন্ম হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত দল এন্নাহদার বিজয় নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে যাচ্ছে তিউনিসিয়ায়। ১৯৫৬ সালে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৭ সাল থেকে বেন আলী ছিলেন ক্ষমতায়। মধ্য ষাটের দশকে এনাহদা নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর চলতি বছরের মার্চ মাসে দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দলটির শীর্ষ নেতা রশিদ আল ঘান্নুচি দীর্ঘদিন ছিলেন লন্ডনে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরই তিনি তিউনিসিয়ায় ফিরে আসেন। এনাহদা কট্টরপন্থী কোনো ইসলামিক দল নয়। একসময় দলটি মিসরের নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনীতি অনুসরণ করত। ১৯৮১ সালে দলটির জন্ম হয়েছিল। তখন দলটির নাম ছিল Islamic Tendency Movement। পরে ১৯৮৯ সালে এনাহদা বা Awakening Movement নাম ধারণ করে। দলটি ইসলাম আর গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। দলটির সঙ্গে তুরস্কের Justice and Development Party’'র অনেক মিল রয়েছে। এন্নাহদার নেতারা এটা স্বীকারও করেন। তাঁরা তিউনিসিয়ায় একটি 'তুরস্ক মডেল' অনুসরণ করতে চান। ঘান্নুচি নিজেই বলেছেন, ‘In Turkey and Tunesia there was the same movement of reconcilitation between Islam & modernity and we are the discendants of this movement’। ঘান্নুচির বক্তব্যের মধ্য থেকে এটা বোঝা যায়, এনাহদা আধুনিকতার বিরোধী নয়। এমনকি এবার নির্বাচনে এমন অনেক মহিলা এই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁরা হিজাব পরেন না এবং পর্দাও করেন না। এনাহদা বহুদলীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনে বিশ্বাসী। তিউনিসিয়ায় ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল Personal Status Code, যেখানে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সমতা আনা হয়েছিল। সেখানে পুরুষদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সমঅধিকার ভোগ করেন। এনাহদা এই Personal Status Code-এর বিরোধী নয়। ঘান্নুচির মতে, এই Personal Status Code হচ্ছে '‘as an acceptable interpretation of Islam’। ঘান্নুচির এই অভিমত যেকোনো ইসলামী মৌলবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁকে পার্থক্য করবে। মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে পারস্য অঞ্চলে নারীদের অধিকার সীমিত। বহুবিবাহ সেখানে স্বীকৃত, আর নারীরা পুরুষের মতো সমঅধিকার ভোগ করেন না। তিউনিসিয়ায় এ থেকে পার্থক্য ছিল। এখন ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এনাহদাও সমঅধিকারের পক্ষে।
তিউনিসিয়ায় নারীদের চাকরি করার ব্যাপারে কোনো বাধানিষেধ নেই। তারা স্বামীর অনুমতি না নিয়েই নিজেরা ব্যবসা করতে পারেন, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। হিজাব পরার ব্যাপারেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যা যেকোনো আরব বিশ্বে অকল্পনীয়। তিউনিসিয়ায় রাজনীতি ও স্থানীয় সরকারে নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যার সঙ্গে নরডিকভুক্ত দেশগুলোর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজে নারীদের এই অবস্থান অন্য কোনো আরব বিশ্বে দেখা যায় না। এমনি একটি দেশে ইসলামপন্থী একটি দলের নির্বাচনে বিজয় সংগত কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ঘান্নুচি হতে যাচ্ছেন তিউনিসিয়ার পরবর্তী নেতা। তাঁকে একজন সমাজবিজ্ঞানী চিহ্নিত করেছেন এভাবে_‘modernist’, but with deep roots in its Arab-Islami identity’। এটাই হচ্ছে আসল কথা। ঘান্নুচি কট্টর নন, আধুনিকমনস্ক এক মানুষ, যিনি এরাবিয়ান ও ইসলামিক ঐতিহ্য ধারণ করেন। তিনি আধুনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে 'বিপ্লব'-পরবর্তী তিউনিসিয়ায় নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চান। সম্ভবত তিনি হতে যাচ্ছেন 'তিউনিসিয়ার 'এরদোগান'। তুরস্কের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এরদোগান তাঁর আদর্শ। তুরস্কের মডেল তিনি অনুসরণ করতে চান তিউনিসিয়ায়। তবে তিউনিসিয়ার পটপরিবর্তন মিসরের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটা একটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু মিসরের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্নতর। সেখানে 'ইসলামিক ব্রাদারহুড' একটি শক্তিশালী ও ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। সমাজের সর্বত্র এদের সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। দলটি নিষিদ্ধ থাকলেও ভিন্ন সংগঠনের নামে এর কর্মীরা সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এরা একটি শক্তি। মুবারকবিরোধী আন্দোলনেও এরা অংশ নিয়েছিল। ২৮ নভেম্বর ২০১১ সেখানে সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে এনাহদার মতো 'ইসলামিক ব্রাদারহুডও' যে ভালো ফল করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
তবে মিসরের সমস্যাটা অন্যত্র। ১১ ফেব্রুয়ারি (১১) হোসনি মুবারকের পদত্যাগের পর ফিল্ড মার্শাল হোসেন তানতাবির নেতৃত্বে ২৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি সামরিক জান্তা সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। এখন শোনা যাচ্ছে, তানতাবি নিজেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আগামী বছরের শেষের দিকে অথবা ২০১৩ সালের প্রথমদিকে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সামরিক জান্তাও চাচ্ছে নয়া সংবিধানে তাদের একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এখন তানতাবির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মিসরের বিশ্বাসকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে পারে। আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন আসছে। গত ৬০ বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতিতে তিনটি ধারা লক্ষণীয়। ১৯৫২ সালে জামাল আবদুল নাসেরের মিসরের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রথম ধারা। তিনি আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়ে আরব বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, যখন আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বে ইসরায়েলি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর। ইরানি বিপ্লব ইরানকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এই বিপ্লব ওই সময় আরব বিশ্বে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। এখন 'আরব বসন্ত' চতুর্থ একটি ধারার সূচনা করল।' তিউনিসিয়ায় 'জেসমিন বিপ্লব' একটি পরিবর্তনের সূচনা করল। ইসলামপন্থী কিন্তু আধুনিকমনস্ক একটা নয়া নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে আরব বিশ্বে। এনাহদার বিজয় এ কথাই প্রমাণ করল।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
গত বছর যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তিউনিসিয়ায়, তা আরব বিশ্বে এক গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিল, যাকে বলা হচ্ছে 'আরব বসন্ত', অনেকটা সাবেক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে সংঘটিত হওয়া 'প্রাগ বসন্ত'-এর সঙ্গে যার তুলনা করা যায়। ১৯৬৮ সালের 'প্রাগ বসন্ত' ছিল সাবেক সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক বড় প্রতিবাদ। আর 'আরব বসন্ত' অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এক প্রতিবাদ। পার্থক্য হচ্ছে এক জায়গায়_'প্রাগ বসন্ত' সফল হয়নি। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তন আসেনি। এসেছিল অনেক পরে, ১৯৮৯ সালে। কিন্তু 'আরব বসন্ত' পরিবর্তন আনছে। ইতিমধ্যে তিউনিসিয়ায় বেন আলীর ২৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। মিসরে ৩০ বছরের একদলীয় শাসনের অবসান হয়েছে। হোসনি মুবারক এখন ইতিহাসের অংশ, দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর এখন বিচার হচ্ছে। কিন্তু লিবিয়ায় পরিবর্তনটা এসেছে ভিন্নভাবে। সেখানে তিউনিসিয়া কিংবা মিসরের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। বিদেশি শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপ গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। গাদ্দাফি নিজের জীবন দিয়ে বৈদেশিক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে গেলেন। ইয়েমেন আর সিরিয়ায়ও 'আরব বসন্ত'-এর ঢেউ লেগেছে। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ আর সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যে বিষয়টি বড় বেশি করে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে_'আরব বসন্ত' কী ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে পুরো আরব বিশ্বে? কোন শক্তি এখানে ক্ষমতাসীন হচ্ছে? এসব দেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকাই বা কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। বলতে দ্বিধা নেই, পুরো আরব বিশ্বে যে ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু ছিল, তাকে কোনো মতেই গণতন্ত্রসম্মত বলা যাবে না। তিউনিসিয়ায় ব্যক্তি বেন আলী ও তাঁর পরিবার ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। Democratic Constitutional Rally নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে বেন আলী ২৩ বছর ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। মিসরেও একই ধারা আমরা প্রত্যক্ষ করি।
অতিসম্প্রতি তিউনিসিয়ার নির্বাচনের পর সেখানে নতুন এক রাজনৈতিক ধারার জন্ম হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত দল এন্নাহদার বিজয় নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে যাচ্ছে তিউনিসিয়ায়। ১৯৫৬ সালে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৭ সাল থেকে বেন আলী ছিলেন ক্ষমতায়। মধ্য ষাটের দশকে এনাহদা নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর চলতি বছরের মার্চ মাসে দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দলটির শীর্ষ নেতা রশিদ আল ঘান্নুচি দীর্ঘদিন ছিলেন লন্ডনে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরই তিনি তিউনিসিয়ায় ফিরে আসেন। এনাহদা কট্টরপন্থী কোনো ইসলামিক দল নয়। একসময় দলটি মিসরের নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনীতি অনুসরণ করত। ১৯৮১ সালে দলটির জন্ম হয়েছিল। তখন দলটির নাম ছিল Islamic Tendency Movement। পরে ১৯৮৯ সালে এনাহদা বা Awakening Movement নাম ধারণ করে। দলটি ইসলাম আর গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। দলটির সঙ্গে তুরস্কের Justice and Development Party’'র অনেক মিল রয়েছে। এন্নাহদার নেতারা এটা স্বীকারও করেন। তাঁরা তিউনিসিয়ায় একটি 'তুরস্ক মডেল' অনুসরণ করতে চান। ঘান্নুচি নিজেই বলেছেন, ‘In Turkey and Tunesia there was the same movement of reconcilitation between Islam & modernity and we are the discendants of this movement’। ঘান্নুচির বক্তব্যের মধ্য থেকে এটা বোঝা যায়, এনাহদা আধুনিকতার বিরোধী নয়। এমনকি এবার নির্বাচনে এমন অনেক মহিলা এই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁরা হিজাব পরেন না এবং পর্দাও করেন না। এনাহদা বহুদলীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনে বিশ্বাসী। তিউনিসিয়ায় ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল Personal Status Code, যেখানে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সমতা আনা হয়েছিল। সেখানে পুরুষদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সমঅধিকার ভোগ করেন। এনাহদা এই Personal Status Code-এর বিরোধী নয়। ঘান্নুচির মতে, এই Personal Status Code হচ্ছে '‘as an acceptable interpretation of Islam’। ঘান্নুচির এই অভিমত যেকোনো ইসলামী মৌলবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁকে পার্থক্য করবে। মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে পারস্য অঞ্চলে নারীদের অধিকার সীমিত। বহুবিবাহ সেখানে স্বীকৃত, আর নারীরা পুরুষের মতো সমঅধিকার ভোগ করেন না। তিউনিসিয়ায় এ থেকে পার্থক্য ছিল। এখন ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এনাহদাও সমঅধিকারের পক্ষে।
তিউনিসিয়ায় নারীদের চাকরি করার ব্যাপারে কোনো বাধানিষেধ নেই। তারা স্বামীর অনুমতি না নিয়েই নিজেরা ব্যবসা করতে পারেন, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। হিজাব পরার ব্যাপারেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যা যেকোনো আরব বিশ্বে অকল্পনীয়। তিউনিসিয়ায় রাজনীতি ও স্থানীয় সরকারে নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যার সঙ্গে নরডিকভুক্ত দেশগুলোর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজে নারীদের এই অবস্থান অন্য কোনো আরব বিশ্বে দেখা যায় না। এমনি একটি দেশে ইসলামপন্থী একটি দলের নির্বাচনে বিজয় সংগত কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ঘান্নুচি হতে যাচ্ছেন তিউনিসিয়ার পরবর্তী নেতা। তাঁকে একজন সমাজবিজ্ঞানী চিহ্নিত করেছেন এভাবে_‘modernist’, but with deep roots in its Arab-Islami identity’। এটাই হচ্ছে আসল কথা। ঘান্নুচি কট্টর নন, আধুনিকমনস্ক এক মানুষ, যিনি এরাবিয়ান ও ইসলামিক ঐতিহ্য ধারণ করেন। তিনি আধুনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে 'বিপ্লব'-পরবর্তী তিউনিসিয়ায় নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চান। সম্ভবত তিনি হতে যাচ্ছেন 'তিউনিসিয়ার 'এরদোগান'। তুরস্কের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এরদোগান তাঁর আদর্শ। তুরস্কের মডেল তিনি অনুসরণ করতে চান তিউনিসিয়ায়। তবে তিউনিসিয়ার পটপরিবর্তন মিসরের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটা একটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু মিসরের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্নতর। সেখানে 'ইসলামিক ব্রাদারহুড' একটি শক্তিশালী ও ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। সমাজের সর্বত্র এদের সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। দলটি নিষিদ্ধ থাকলেও ভিন্ন সংগঠনের নামে এর কর্মীরা সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এরা একটি শক্তি। মুবারকবিরোধী আন্দোলনেও এরা অংশ নিয়েছিল। ২৮ নভেম্বর ২০১১ সেখানে সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে এনাহদার মতো 'ইসলামিক ব্রাদারহুডও' যে ভালো ফল করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
তবে মিসরের সমস্যাটা অন্যত্র। ১১ ফেব্রুয়ারি (১১) হোসনি মুবারকের পদত্যাগের পর ফিল্ড মার্শাল হোসেন তানতাবির নেতৃত্বে ২৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি সামরিক জান্তা সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। এখন শোনা যাচ্ছে, তানতাবি নিজেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আগামী বছরের শেষের দিকে অথবা ২০১৩ সালের প্রথমদিকে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সামরিক জান্তাও চাচ্ছে নয়া সংবিধানে তাদের একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এখন তানতাবির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মিসরের বিশ্বাসকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে পারে। আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন আসছে। গত ৬০ বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতিতে তিনটি ধারা লক্ষণীয়। ১৯৫২ সালে জামাল আবদুল নাসেরের মিসরের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রথম ধারা। তিনি আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়ে আরব বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, যখন আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বে ইসরায়েলি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর। ইরানি বিপ্লব ইরানকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এই বিপ্লব ওই সময় আরব বিশ্বে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। এখন 'আরব বসন্ত' চতুর্থ একটি ধারার সূচনা করল।' তিউনিসিয়ায় 'জেসমিন বিপ্লব' একটি পরিবর্তনের সূচনা করল। ইসলামপন্থী কিন্তু আধুনিকমনস্ক একটা নয়া নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে আরব বিশ্বে। এনাহদার বিজয় এ কথাই প্রমাণ করল।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments