বাজারে আসছে নতুন ধান, আমনেও পড়তি দাম by ইফতেখার মাহমুদ
সারা দেশে নবান্নের উৎসব শুরু হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। কারণ, পাটের পর এবার আমন ধানের বাজারও মন্দা। সাধারণত আমন ওঠার আগের সময়টা অর্থাৎ নভেম্বর মাসে ধান-চালের দাম চড়া থাকে। ডিসেম্বরে নতুন ধান উঠলে দাম বাড়তে শুরু করে। এবার দাম কমতে শুরু করেছে। ফলে আমন ধানের উৎপাদন খরচ ও বাজারদর সমান হয়ে গেছে। তাই বলে বাজারে চালের দামে কোনো হেরফের হয়নি। এক মাস ধরে সারা দেশে মোটা চালের দাম একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে প্রতি কেজি মোটা চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকা, মাঝারি মানের ৩৫ থেকে ৪২ এবং সরু চাল ৩৫ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মণ ধান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস ধরে দাম নিয়মিতভাবে কমার পর চিকন ধানের দাম কিছুটা বেড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হয়েছে। সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে কৃষক পর্যায়ে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২৬ দশমিক ৬৮ টাকা দরে। অক্টোবরে এই দর ছিল ২৮ দশমিক ২৬ টাকা। ডিসেম্বর থেকে নতুন আমনের চাল বাজারে আসা শুরু হলে দাম আরও তিন থেকে চার টাকা পর্যন্ত কমতে পারে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হিসাবে প্রতি মণ ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। আর প্রতি মণ আমন ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৫৫০ টাকা। ইউরিয়া সারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ায় ও কৃষি মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ধান চাষে উৎপাদন খরচ গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ শতাংশ বেড়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। কিন্তু ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষক লোকসানের মুখে পড়ছেন বলে ব্র্যাকের গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, চলতি বছর চাষিরা পাটের দামও ভালো পাননি। আলুর দামও বেশ কম। আমনেও যদি কৃষক ভালো দাম না পান, তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, গ্রামীণ জনগণের জীবনমান কমে যাবে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেনের মতে, এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত কৃষকের জন্য প্রণোদনা দামসহ খুব শিগগির আমন ধান কেনার উদ্যোগ নেওয়া। শুষ্ক মৌসুমের সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশের উপকূলীয় এলাকার ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ, রাস্তা ও অন্যান্য অবকাঠামো মেরামত শুরু করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এতে শ্রমিকদের টাকার বদলে চাল দিলে সরকারি গুদাম খালি হবে।
মাহবুব হোসেনের পরামর্শ, বিশ্ববাজার থেকে বেশি দামে চাল না কিনে কৃষকের কাছ থেকে বেশি করে চাল কিনে রাখা উচিত। তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপরও চাপ কমে।
ভারতীয় চাল আমদানির প্রভাব: দীর্ঘ চার বছর পর ভারত সরকার বেসরকারি খাতে চাল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় চালের দর এখনো চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি অর্থাৎ ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কেজি। ফলে দেশীয় আমদানিকারকেরা খুব একটা চাল আমদানি করছেন না। উল্টো কম দামের সুযোগে ভারতে চাল পাচার হয়ে যায় কি না, সেই আশঙ্কা রয়েছে।
তবে ভারতীয় চাল আমদানি হবে, এই আশঙ্কায় বাজারে ধান-চালের দাম কমতে শুরু করেছে বলে মনে করেন খাদ্য বিভাগের সচিব বরুণ দেব মিত্র। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কৃষক যাতে আমন ধান বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকার চিন্তাভাবনা করছে।
সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত অক্টোবরে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে মাত্র নয় হাজার টন ও সেপ্টেম্বর মাসে ৯২ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। তবে সরকারি গুদামে বর্তমানে চালের মজুদ রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টন।
বিপুল পরিমাণের এই মজুদ থাকায় চালকল মালিকেরা সরকারের কাছে চাল বিক্রি করতে চাইলেও সরকার তা কিনছে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক কে এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পরিস্থিতির কথা বিবেচনা না করে বেশি করে চাল আমদানি করতে গিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বেশি দাম দিয়ে বিশ্ববাজার থেকে চাল কিনে গুদাম বোঝাই করার আগে এটা মনে রাখা উচিত ছিল যে নভেম্বর থেকে আমন ধান কাটা শুরু হবে। আমনে কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায়, সে জন্য সরকারের চাল কেনা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের গুদামে রেখে হলেও সরকারি সংগ্রহ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
উৎপাদন খরচ ও দাম সমান: কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর প্রতি কেজি আমন ধান চাষ করতে গিয়ে কৃষককে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। ধান থেকে চাল করতে গেলে খরচ দাঁড়াচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা। ইউরিয়া সার ও কৃষি মজুরের দাম বাড়ায় গত বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ দুই টাকা ৭৫ পয়সা বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও গত বছরের তুলনায় এ বছর ধানের দাম কমেছে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি মণ ধান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকারি হিসাবে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ দাঁড়াচ্ছে ৫৬০ টাকা। অথচ গত বছর প্রতি মণ ধানে ৫০০ টাকা খরচ করে মৌসুমের শুরুতেই কৃষক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় ধান বিক্রি করেছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৩৩ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হবে। এ পর্যন্ত দেশের ৫ শতাংশ এলাকায় আমন ধান কাটা হয়েছে। সাধারণত আমন ধান কেটে হাতে যা নগদ আসে, তা কৃষক বোরো চাষের জন্য বিনিয়োগ করেন। এই ধান বেশি দিন ধরে রাখা যায় বলে ফড়িয়ারা এ সময় তৎপর থাকে। কম দামে ধান কিনে তারা পরে বেশি দামে বিক্রি করে। কৃষকের লাভের গুড় চলে যায় ফড়িয়াদের পকেটে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, ধানের দর কিছুটা কম হলেও এখনো কৃষক লোকসানের মুখে পড়েনি। দাম এর চেয়ে যাতে না কমে, সে জন্য সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি আশা করেন।
গত বছর ধানের দাম বেশি থাকায় সরকার আমন সংগ্রহ করেনি। তার আগের বছর ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকার ২২ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আমন কিনেছিল খাদ্য বিভাগ। এ বছর এখনো কেনার সিদ্ধান্ত হয়নি।
No comments